ট্রাম্প কেন পাগলাঘণ্টি বাজিয়ে চলেছেন

ডোনাল্ড ট্রাম্প
ডোনাল্ড ট্রাম্প

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের এখনো মাস তিনেক বাকি, কিন্তু নির্বাচন স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত হবে কি না, তা নিয়ে এখনই শোরগোল তুলেছেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তিনি বলেছেন, ডাকযোগে ভোট দেওয়ার যে ব্যবস্থা চালু আছে, তা অব্যাহত থাকলে নভেম্বরের নির্বাচনের ফলাফল বৈধ হবে না।

বিষয়টা কিছুটা হাস্যকরই বটে। তিনি দেশের প্রেসিডেন্ট, যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ অঙ্গরাজ্যে তাঁর রিপাবলিকান পার্টির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। মার্কিন সিনেট তাঁর দলের নিয়ন্ত্রণে। এমনকি বিচার বিভাগেও স্পষ্ট রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রণ। তারপরেও যদি স্বচ্ছ ও সন্দেহশূন্য নির্বাচন করা সম্ভব না হয়, সে দায়ভার তাঁর ঘাড়েই পড়ার কথা। কিন্তু তিনি দোষ চাপাচ্ছেন বিরোধী ডেমোক্র্যাট, চীন ও মার্কিন ডাক বিভাগের ঘাড়ে। উপরন্তু, সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণের বদলে তিনি অনবরত নিজের আপত্তির কথাই বলে যাচ্ছেন। ভেবে দেখুন, বাংলাদেশে যদি ক্ষমতাসীন সরকার নির্বাচনের আগেই কারচুপির দোষ বিরোধী দলের ওপর চাপাত, তাহলে অট্টহাসি উঠত। ট্রাম্পের কথায়ও হাস্য উদ্রেক হয়েছে।

আমেরিকায় ডাকযোগে ভোট দেওয়া নতুন কোনো ব্যবস্থা নয়; অধিকাংশ অঙ্গরাজ্যেই এটা আছে। আগামী নির্বাচনেও থাকবে। কোনো কোনো অঙ্গরাজ্যে, যেমন কলোরাডো, ইউটাহ, ওরেগন, হাওয়াই ও ওয়াশিংটনে সব নির্বাচনই সম্পূর্ণ ডাকের মাধ্যমে হয়। কেউ কখনো তার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। এবার হঠাৎ কী হলো? বস্তুত, আগের চেয়ে ডাক-ভোটের প্রয়োজনীয়তা এখন বেশি। করোনাভাইরাস নিয়ে এখন চারদিকে আতঙ্ক, এই অবস্থায় বিশেষত বয়স্করাসহ অনেকেই সশরীরে ভোটকেন্দ্রে যেতে ইতস্তত করবেন। সে আশঙ্কা মাথায় রেখে অনেক রাজ্যেই ডাক-ব্যালটের ব্যবস্থা সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ট্রাম্পের অভিযোগ, ডাক-ব্যালটের মাধ্যমে ভোট হলে মহা কারচুপি হবে। একজনের ভোট অন্যে দেবে, ব্যালট বাক্স চুরি হবে, এমনকি চীন বা অন্য কোনো দেশ থেকে মিথ্যা ব্যালট ছাপিয়ে বিলির ব্যবস্থাও হতে পারে।

ট্রাম্প এই অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ দেখাননি। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ মনে করেন, তাঁর অভিযোগ ভিত্তিহীন; কারণ, ডাক-ব্যালট অত্যন্ত নিরাপদ। রিপাবলিকান-নিয়ন্ত্রিত ইউটাহ অঙ্গরাজ্যের একজন নির্বাচনী কর্মকর্তা ট্রাম্পকে অভয় দিয়ে বলেছেন, কারচুপির সম্ভাবনা কার্যত শূন্য। একেক রাজ্যের একেক রকম ব্যালট পেপার, তার ছাপার স্টাইল একেক রকম, এমনকি কাগজের ওজন পর্যন্ত ভিন্ন। এত সব ঝামেলা ঠেলে কেউ ডাক-ব্যালট ছেপে বিলি করবে, তা অসম্ভব।

তাহলে ট্রাম্প এমন অভিযোগ করছেন কেন? আসলে তিনি আগামী নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে আগাম সন্দেহ জাগাতে চান। যদি তিনি হেরে যান, যার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে, তাহলে ফল প্রত্যাখ্যান করে হোয়াইট হাউসে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকবেন। হাসিঠাট্টার কথা নয়, এই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন তাঁর ডেমোক্রেটিক প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেন। নিউইয়র্কের গভর্নর এন্ড্রু কুওমো বলেছেন, নভেম্বরে নির্ঘাত ট্রাম্পের ভরাডুবি হবে, তাই তিনি এখন থেকেই ‘ভোট জালিয়াতির’ ধুয়া তুলেছেন। পেনসিলভানিয়ার সাবেক রিপাবলিকান গভর্নর টিম রিজ বলেছেন, ‘আমার তো মনে হয়, ট্রাম্প আগামী নির্বাচনের শুদ্ধতা নিয়ে নয়, নিজের ভাগ্য নিয়েই বেশি চিন্তিত।’

ধারণা করা হয়, ডাক-ব্যালটের ব্যবস্থা থাকলে বয়স্করা ছাড়াও স্বল্পবিত্তের মানুষদের সুবিধা, তারা বেশি সংখ্যায় ভোটে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। স্বল্পবিত্ত মানে আফ্রিকান-আমেরিকান ও বিভিন্ন জাতের বাদামি মানুষ, যারা বরাবর ডেমোক্র্যাটদের ভোট দিয়ে থাকে। ট্রাম্পের সেটা পছন্দ হওয়ার কথা নয়। ডাক-ভোট বাতিলের দাবির হয়তো এটাই আসল কারণ। ট্রাম্পের অন্য অভিযোগ, ডাক বিভাগের গাফিলতির জন্য ডাক-ব্যালট গণনায় বিলম্ব হবে। দেখা যাবে ৩ নভেম্বরের ভোটের ফল পেতে কয়েক সপ্তাহ মায় কয়েক বছর লেগে যেতে পারে। বিলম্ব হওয়া অসম্ভব নয়, কিন্তু নির্বাচন কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব বিলম্ব এড়ানোর সব আগাম ব্যবস্থা নেওয়া। ট্রাম্প প্রশাসন উল্টো পথ নিয়েছে। নির্বাচনের ঠিক আগে আগে তারা মার্কিন ডাক বিভাগে বড় রকমের পরিবর্তন আনছে। ডাক ব্যবস্থা বিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতা নেই এমন একজনকে পোস্টমাস্টার জেনারেল পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাঁর যোগ্যতা হলো, তিনি ট্রাম্পের প্রচারাভিযানে বড় চাঁদাদাতা। তিনি ইতিমধ্যে ডাক বিভাগের শীর্ষ পর্যায়ে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছেন। নির্বাচনী কাজে অভিজ্ঞ অনেককে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। ডাক কর্মচারীদের ওভারটাইমের ব্যবস্থাও রদ করেছেন। ফলে ডাক বিলিতে শিথিলতা এসেছে। ডেমোক্র্যাটরা এই অনিয়মের তদন্ত চাইছেন। সিনেটর কমলা হ্যারিস বলেছেন, ডাক বিভাগকে যখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, ঠিক তখনই তার সর্বনাশ করার আয়োজন চলছে।

সব প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা সুস্থ গণতন্ত্রের একটি পূর্বশর্ত। অনেক গণতান্ত্রিক দেশে ভোটদান বাধ্যতামূলক। যেমন বেলজিয়ামে যৌক্তিক কারণ ছাড়া ভোট দিতে ব্যর্থ হলে জরিমানার ব্যবস্থা রয়েছে। অথচ অগ্রসর গণতন্ত্রের দেশ আমেরিকায় কোনো কোনো দলের প্রধান লক্ষ্য অপছন্দের নাগরিকদের ভোটদান ঠেকানোর ব্যবস্থা। উদাহরণ হিসেবে জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যটি রক্ষণশীল, অর্থাৎ রিপাবলিকান-প্রভাবিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আফ্রিকান-আমেরিকান নাগরিকেরা রিপাবলিকানদের বিপক্ষে ভোট দিয়ে থাকে। তাই কীভাবে তাদের ভোট দেওয়া থেকে বিরত রাখা যায়, তার চেষ্টার বিরাম নেই। অনেক সময় এই যুক্তি, সেই যুক্তি দেখিয়ে ভোটার তালিকা থেকে তাদের নাম বাদ দেওয়া হয়। পরিচয়পত্র দেখানোর দাবি তোলা হয়। অথবা আফ্রিকান-আমেরিকান মহল্লা থেকে বহু দূরে ভোটকেন্দ্র খোলা হয়, যাতে খুব বেশি লোক সেখানে না যায়।

জর্জিয়ায় ২০১৮ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনেই ধরা পড়েছিল, ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান প্রশাসন কীভাবে আফ্রিকান-আমেরিকানদের ভোটাধিকার সীমিত করতে চায়। ডেমোক্র্যাটদের অভিযোগ, রিপাবলিকানদের কারসাজিতে সেখানে কয়েক লাখ ভোট বাতিল হয়েছে। সে কারণেই ২০১৮ সালে গভর্নর পদে ডেমোক্রেটিক প্রার্থী স্টেসি এব্রামস অল্প ব্যবধানে পরাস্ত হন। গত জুনে বাছাই পর্বের নির্বাচন ছিল। তখনো দেখা গেল একই সমস্যা। শ্বেতাঙ্গ এলাকায় সমস্যা নেই, কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গপ্রধান এলাকায় ভোট গণনা মেশিন অকেজো, পর্যাপ্ত ভোটকর্মী নেই, অথবা ডাক-ব্যালটের ব্যবস্থা নেই। এই অব্যবস্থার কারণে অনেক জায়গায় ভোটারদের পাঁচ-ছয় ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। এক ডেমোক্র্যাট সিনেটর বলেছেন, আগামী নির্বাচনেও একই কাণ্ডের পুনরাবৃত্তি হলে গণতন্ত্রের জন্য তা হবে খুবই খারাপ। তাঁর কথায়, এখনই পাগলাঘণ্টি বাজানো দরকার, হাতে বেশি সময় নেই।

পাগলাঘণ্টি যাঁর বাজানোর কথা, সেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঠিকই সে ঘণ্টি বাজিয়ে চলেছেন। কিন্তু আগুন নেভানোর জন্য লোক পাঠানোর ইচ্ছা তাঁর আছে বলে মনে হয় না। তিনি হয়তো ভাবছেন, ঘণ্টা যত জোরে বাজবে, নির্বাচনী ফলাফলের বৈধতা তত প্রশ্নবিদ্ধ হবে। কিন্তু এর ফলে যে আমেরিকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে, সে বিপদ তিনি ঠেকাবেন কীভাবে?

হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক