প্রণোদনার ঘোষণা ও প্রাপ্তির মধ্যে মিল কোথায়

বাংলাদেশে প্রায় প্রতি হপ্তায় একটি করে চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটে। বা বলা যায়, কোনো একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করা হয়। বেশির ভাগ ঘটনাই ট্র্যাজেডি অথবা মেলোড্রামা। সাধারণ ঘটনাকে মিডিয়ার সহযোগিতায় নাটকীয়ভাবে উপস্থাপন করা হয়, যা পাঠক, শ্রোতা, দর্শকের কাছে উপভোগ্য না হয়েই পারে না। ঘটনাগুলো সাধারণত তিন–চার দিনব্যাপী প্রচারিত ও আলোচিত হয়। তারপর নীরবতা নামে। তবে মানুষের মনে শুধু পাত্রপাত্রীদের স্মৃতিটুকু থাকে অম্লান।

সাপ্তাহিক নাটকীয় ঘটনাগুলো সর্বসাধারণের আলোচনার বিষয়বস্তু হওয়ায় জাতীয় জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ অথচ অচাঞ্চল্যকর বিষয় নীরবতার পাথরের নিচে চাপা পড়ে যায়। বড়জোর টিভি চ্যানেল ও পত্রিকায় প্রতিবেদন হয়, সমস্যার সমাধান হয় না। বরং কখনো সমস্যা আরও তীব্র হয়।

কোভিড-১৯ এক অভাবিত আকস্মিক বিপদ। এই বিপদ থেকে মুক্তি পেতে সরকারের ভূমিকাই প্রধান। সরকার ও জনগণ সম্মিলিতভাবে কাজ করলে এই বিপদ মোকাবিলা করা সহজ হয়। কোভিডের প্রাদুর্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা রকম প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। কোনো কোনো প্রণোদনার ঘোষণা খুবই শ্রুতিমধুর। এবং তা যখন হাতে আসে, সেটি অতি আনন্দের। কিন্তু ঘোষণার পর তা যখন আর পাওয়া যায় না, তখন যে হতাশা জাগে, সেটি প্রায় প্রিয়জন হারানোর ব্যথার সমান। যেমন আড়াই মাস আগে করোনাকালীন কৃষিতে প্রণোদনা দিতে পাঁচ হাজার কোটি টাকা কৃষিঋণ বিতরণের ঘোষণা দেওয়া হয়। আগে ব্যাংকভেদে কৃষিঋণের সুদ ছিল ৯-১০ শতাংশ। এই ঋণের শতকরা সুদ ৪ টাকা। কৃষকেরা, বিশেষত সংখ্যাগরিষ্ঠ বর্গাচাষিরা খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত ওই ঋণের টাকার কত শতাংশ কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে, তা নিয়েই প্রশ্ন। অনেকের সন্দেহ, ৫ শতাংশও বিতরণ হয়নি।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে কৃষিতে যে অগ্রগতি হয়েছে, তাতে বর্গাচাষিদের অবদান ৮০ শতাংশ। যে কৃষকের যৎসামান্য জমি আছে, তাঁর চেয়ে বর্গাচাষিদের প্রণোদনা দরকার বেশি। কিন্তু বর্তমানে ৪ শতাংশ সুদে যে ঋণের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, সে টাকার ২ শতাংশও এখন পর্যন্ত ছোট বর্গাচাষিরা পাননি। কৃষি ব্যাংক ও অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে ঋণের আবেদন করতে যেসব শর্ত পূরণ করতে হয় এবং কাগজপত্র জমা দিতে হয়, তা অনেক অক্ষরজ্ঞানহীন কৃষকের পক্ষে সম্ভব নয়। অনেকের পক্ষে লোহার গেট পার হয়ে ব্যাংকের ভেতরে গিয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করাই সম্ভব হয় না। ছোট ও মাঝারি বর্গাচাষিরা যদি অত দলিলপত্রের ভাষাই বুঝতেন, তাহলে পাবলিক সার্ভিস কমিশনে পরীক্ষা দিয়ে এসি রুমে বসে সরকার চালাতেন; লাঙল, মই, কাস্তে, নিড়ানি নিয়ে মাঠে মাঠে রোদ-বৃষ্টিতে পড়ে থাকতেন না।

ছোট চাষি ও বর্গাচাষিরা ঋণখেলাপি হন না। বাংলাদেশে যিনি ঋণখেলাপি হতে পারেন না, তাঁর কোনো দাম নেই। ছোট কৃষকেরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা মেরে দিয়েছেন এমন দৃষ্টান্ত নেই। বরং ঋণ শোধ করতে না পেরে অনেকে জেলে আছেন। বড় অঙ্কের খেলাপিদের জন্য জেলখানা নয়। জেলে যাওয়ার উপক্রম হলে তাঁরা আশ্রয় নেন তাঁদের বিদেশের ‘সেকেন্ড হোমে’। কৃষকের ঋণ সুদে-আসলে আদায় করা হয় তাঁর গলায় গামছা দিয়ে।

কৃষিঋণ দেওয়া হয় ১৮ মাসের জন্য। প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো আছেই, ক্ষেত্রবিশেষে অন্যান্য সমস্যাও আছে। যেমন কলাচাষি ১৮ মাসে টাকাটা না–ও তুলতে পারেন। ১২ থেকে ১৫ মাস বয়সী ছাগলের বাচ্চা কেনার জন্য তিন হাজার টাকা ঋণ পেতে পারেন। বর্তমানে এক বছর বয়সী একটা ছাগল তিন হাজার টাকায় কিনতে পাওয়া কঠিন। এক বছর লালনপালনের পর তার দাম ছয়-সাত হাজার টাকার বেশি হয় না। এক বছর থেকে সোয়া বছর বয়সী একটি গরুর বাছুরের জন্য ৩০ হাজার টাকা ঋণ বরাদ্দ। এক বছর পোষার পর তার যা দাম ওঠে, তাতে খরচে পোষায় না। কৃষিঋণে ছোট চাষি ও বর্গাচাষিরা যে বিশেষ লাভবান হন তা নয়। তাঁরা কোনোরকমে টিকে থাকেন, তবে লাভবান হয় জাতীয় অর্থনীতি।

পাটের মতো চামড়া বাংলাদেশের একটি সম্পদ। কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়া নিয়ে যে আত্মঘাতী খেলা চলছে, আজ কয়েক বছর ধরে তা দেখার কেউ নেই আমাদের রাষ্ট্রে। গত বছরের চামড়া কেলেঙ্কারির পরে কারও না বোঝার কথা নয় এবারও কী ঘটতে পারে। বাংলার মাটিতে বুদ্ধিমানেরা কোনো একটা উপলক্ষে প্রণোদনা চায় এবং ব্যাংকঋণের জন্য হাত বাড়িয়ে থাকে। কারণ, এ দেশে ব্যাংকঋণ বেহেশতের চাবি। ও জিনিস একবার হাতে এলে আর ফেরত না দিলেও চলে। গতবারের ঘটনার পর দায়িত্বপ্রাপ্তদের ১১ মাস ঘুমিয়ে থাকার কথা নয়। কিন্তু ঘুমিয়ে না থাকলেও চোখ বন্ধ করেই ছিলেন। চামড়া খাতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে এ বছর ৩১ মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩ হাজার ৮৭ কোটি টাকা। যে খাতে বিপুল খেলাপি ঋণ, সেখানে এবারও ঈদের আগে চামড়া ব্যবসায়ীদের নতুন ৬০০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এতে একেবারে প্রত্যক্ষভাবে নষ্ট পুঁজিপতি ও ফড়িয়াদের পক্ষ অবলম্বন করা হয়েছে। কোরবানির চামড়ার দাম এবার অযৌক্তিকভাবে কম নির্ধারণ করা হয়। গরিব মানুষেরা এই সময় দুটো টাকা উপার্জন করে। তাদের বাড়া ভাতে ছাই ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। চামড়ার মতো মূল্যবান সম্পদ ধ্বংস হয় গেল ট্যানারির মালিক ও ফড়িয়াদের কারসাজিতে।

সংসদীয় গণতন্ত্রে যিনি যে বিভাগের মন্ত্রী, তিনি তার সর্বময় কর্তা। সেই বিভাগের নাড়িনক্ষত্র সম্পর্কে তাঁর মোটামুটি ধারণা থাকতে হবে। তিনি ওই মন্ত্রণালয়ের প্রভু ও প্রশাসক। গত বছর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী বলেছিলেন, তাঁর ‘শিক্ষা’ হয়ে গেছে। দেশবাসীকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন, ‘আগামী বছর দেখব।’ বিষয়টি শুধু দেখার নয়, কাজ করার। তিনি কি তাঁর অঙ্গীকার রক্ষা করেছেন? জনগণের ও জাতির অর্থনীতির স্বার্থ রক্ষা করেছেন?

ঈদের দুদিন আগে ঘোষণা দেওয়া হলো, কাঁচা ও ওয়েট–ব্লু চামড়া রপ্তানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। খুব বেশি জ্ঞান-বুদ্ধির দরকার হয় না, সাধারণ আক্কেলে বোঝা যায় যে হুট করে রপ্তানির কথা বলা হলো আর বিভিন্ন দেশ তা কেনার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ল। রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনা কোনো ছেলেখেলা নয়। সাধারণ মানুষের ধারণা, অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে গোষ্ঠী ও ব্যক্তিস্বার্থে এই খাতকে ধ্বংস করা হচ্ছে। দেশে জবাবদিহি বলে কিছু থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জনগণের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতো।

কোভিড মহামারির মধ্যেই পাটচাষি, ক্ষুদ্র পাট ব্যবসায়ী, পাটকলশ্রমিক ও পাটশিল্পের কপাল পুড়ল। সেই পোড়া কপালে যেটুকু প্রলেপ সরকার দিতে চাইছে, সেটা ঠিক জায়গায় পড়ছে কি না, তা পর্যবেক্ষণের কেউ নেই। চাকরিচ্যুত পাটকলশ্রমিকদের ছেলেমেয়েরা এবার ঈদের দিন একটু ফিরনি মুখে দিতে পেরেছে কি না সন্দেহ। ক্ষুদ্র পাট ব্যবসায়ীদের বিগত বছরগুলোর বকেয়া টাকাটা বিজেএমসি পরিশোধের প্রয়োজন বোধ করেনি। তাঁদের অবস্থা শোচনীয়।

কাউকে তার উপকারার্থে অর্থ বা কোনো কিছু দেওয়ার ঘোষণা একটি বিমূর্ত ব্যাপার। আর টাকা হলো একটি বস্তু। যতক্ষণ ওই বস্তু কারও হাতে না যাচ্ছে, ততক্ষণ ওই ঘোষণার কোনো দাম নেই। করোনাকালে যত প্রণোদনার কথা ঘোষিত হয়েছে, তার কতটা ভোক্তার কাছে পৌঁছেছে, তা পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন না করলে ভবিষ্যতে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা স্বাভাবিক রাখা সম্ভব হবে না।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক