জল নামলেও জ্বালা নামে না

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলার সাহেবের আলগাচর
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলার সাহেবের আলগাচর

‘নদী তো ঘরোত চলি আসচে। কোটে যাই না যাই, কোনো ঠিকানা নাই। ঘরের অর্ধেক ভাঙি গেইচে। বাকিটা নিয়া যাওয়ার জাগা নাই’, কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার চতুরা গ্রামের রাজিয়া বেগম কথাগুলো বলছিলেন। পাশেই বাড়ি ভাঙা স মিলের শ্রমিক আহম্মদ আলীর। তিনি বলছিলেন, ‘সারা জীবন যা কামাই করছি সোগ ভাঙি গেল।’ নদীপারের বাসিন্দা মোশারফ হোসেন বললেন, ‘পানি কমলেও দুর্ভোগ কমে নাই। গবাদিপশুর খাবার নাই। খ্যাত-খামার শেষ। অনেক ঘরবাড়ি ভাঙা। রোগ বাড়চে। নদীর ভাঙন চলছে।’

যাঁরা মনে করেন পানি কমলেই সংকট দূর হয়, তাঁদের স্বস্তির ঢেকুর তোলার কোনো কারণ নেই। পানি কমলেও বানভাসিদের অন্তহীন দুর্গতির মধ্যেই থাকতে হয়। বরং যখন পানি থাকে, তখন অনেক সহৃদয় মানুষ তাঁদের পাশে থাকেন। সরকারও কিছুটা পাশে থাকে। পানি নেমে গেলে বানভাসিরা কার্যত একা হয়ে পড়েন। একাই মোকাবিলা করেন সংকট। পানি কমে গেলেই গণমাধ্যমে দুর্গতদের নিয়ে আর তেমন কোনো খবর পরিবেশিত হয় না। দেশের অসংখ্য আলোচনায় চাপা পড়ে এসব দুর্গত মানুষের দিনলিপি। বানভাসিরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। সারা বছর ধরে যেটুকু গুছিয়ে নেন, তা আবার পরের বছরের বন্যায় নিঃশেষ হয়। এ রকম এক জীবন চক্রে আবর্তিত হয় দেশের নদী-তীরবর্তী কিংবা চরাঞ্চলের লাখো মানুষের জীবন।

এ বছর প্রায় দেড় মাস ডুবে থাকার পর দুর্গত এলাকার পানি কমছে। কিন্তু এই দেড় মাসে পানির নিচে ডুবে থাকা বাড়ির যে ক্ষতি হয়েছে, সেই ক্ষতি পূরণ করার মতো সক্ষমতা তাঁদের নেই। যে সামান্য টাকাপয়সা তাঁদের ছিল, সেগুলো কোভিড-১৯-এর কারণে কর্মহীন হয়ে শেষ করেছেন। সামর্থ্যের চেয়েও বেশি ঋণ নিয়েছেন স্থানীয় মহাজনদের কাছ থেকে। দীর্ঘ বন্যায় তাঁরা চোখে অন্ধকার দেখছেন। তাই পানি কমে গেলেও তাঁদের কাছে টাকা না থাকায় দুর্ভোগ থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছেন না।

বন্যার কারণে লাখ লাখ হেক্টর জমি এখন ফসলশূন্য। রোপণের মতো চারাও নেই। ধান রোপণের সময়ও শেষ হয়ে আসছে। সবজি যা লাগানো ছিল, সেগুলো বন্যায় শেষ। বিশেষ করে কৃষিশ্রমিকেরা দিশেহারা। কৃষিশ্রমিকদের অনেকেই কৃষিকাজ ছাড়া আর কিছুই করতে পারেন না। কৃষিকাজ না থাকলে তাঁরা বেকার হয়ে পড়েন। ছোট ছোট গৃহস্থও অভাবের মধ্যেই পড়েছেন। পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকেই। কী এক বিপন্ন জীবন তাঁদের! বাড়ি হারিয়ে যাঁরা গৃহহীন-ভূমিহীন হয়ে পড়েছেন, পানি নেমে গেলেই তাঁদের কষ্ট দূর হওয়ার নয়। একখণ্ড জমি কিনতে তাঁদের অপেক্ষা করতে হবে কয়েক বছর। তারপর হয়তো নিজের জমিতে বাড়ি করার পরিকল্পনা করতে পারবেন। যে ক্ষতি তাঁদের হচ্ছে, তা অপূরণীয়। সরকার তো চার-পাঁচ বছর আগে বন্যায় ভেঙে যাওয়া অনেক সেতু কিংবা সড়ক এখনো ঠিক করতে পারেনি।

যাঁর বাড়ি ভেঙে গেছে, পানি কমলেও তাঁর তো যাওয়ার ঠিকানা নেই। পানি কমলেও তিনি বাস্তুহীন। যাঁর ফসলের সর্বনাশ হয়েছে, তিনি তো পানি কমে গেলেও ফসল ফিরে পাচ্ছেন না। যাঁর পুকুর ডুবে গেছে, তিনি তো আর মাছ ফিরে পাচ্ছেন না। যাঁরা বন্যার পানি নেমে যাওয়ায় ঘরে ফিরছেন, তাঁদের অনেকেই সাপের কামড়ের শিকার হচ্ছে। শণ দিয়ে দেওয়া ঘরের বেড়া পচে গেছে। অনেকের বাড়িতে প্রচুর পলি জমেছে। অসহায় মানুষ কার কাছে যাবেন?

সরকার এসব মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মতো কল্যাণকামী হয়ে উঠতে পারেনি। তাঁদের যাওয়ার বড় জায়গা স্থানীয় মহাজন। তাঁরা জানেন, এসব মহাজন তাঁদের কাছে অনেক টাকা সুদ নেবেন। তারপরও আর কোনো উপায় থাকে না। উন্নয়নশত্রু সুদখোররাই তাঁদের নিয়তি হয়ে ওঠেন।

কোভিড-১৯ এবং বন্যায় দিশেহারা হয়ে অনেকেই দ্বারস্থ হয়েছেন স্থানীয় মহাজনদের। ঢাকায় রাজমিস্ত্রির জোগানদার (সহকারী) ছিলেন আলমগীর হোসেন। কর্মহীন হয়ে বাড়িতে ফিরেছেন। তিনি বলছিলেন, ‘২০ হাজার টাকা নিছি সুদের পর। মাসে দুই হাজার টাকা সুদ। কাম নাই, বাড়ি ভাঙা। টাকা কাঁই দেবে? সুদের পর নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।’ রাজিয়া বেগম বলছিলেন, ‘হামরা ১০ হাজার টাকা নিছি। টাকা ধার দেওয়ার মানুষ নাই। হাজারে ১০০ টাকা সুদ।’ তবে বাড়ি ভাঙা আহম্মদ হোসেন বললেন, ‘আমি সুদের পর টাকা নেই নাই। দোকানে বাকি খাই, আর স মিল থাকি অগ্রিম টাকা নিছি। এইভাবে বাড়ির কাজ করতেছি।’ বন্যাদুর্গত মানুষদের মধ্যে এখন অধিক হারে মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণের প্রবণতা বেড়েছে অনেক গুণ। সরকারিভাবে এঁদের তালিকা সংগ্রহ করে এই টাকা এককালীন অথবা বিনা সুদের দেওয়ার ব্যবস্থা করা সম্ভব হলে তাঁরা অনেকটা রক্ষা পেতেন।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে তাকালেই সারা বছরের সামান্য সহায়তা কার্যক্রম চোখে পড়বে। সরকার দেশের সব জেলার জন্য বছরে একবার দুর্যোগকালীন সহায়তা দিয়ে থাকে। যে জেলায় দুর্যোগ নামবে সে জেলাতেও, যে জেলায় দুর্যোগ নেই সেই জেলাতেও ত্রাণ দেওয়া হয়। আর যখন কোথাও দুর্যোগ সীমাহীন হয়ে ওঠে, তখন সান্ত্বনামূলক সহায়তা দেওয়া হয়। সেই ত্রাণসহায়তাতেও আছে অবিশ্বাস্য বৈষম্য। ব্যাপক ক্ষতির শিকার জনপদের জন্য যে বিশেষ ব্যবস্থা প্রয়োজন, সেটি কখনোই হয় না। অপ্রতুল সহায়তা এবং বন্যা প্রতিরোধক ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ার কারণে নদী-তীরবর্তী এবং চর জীবনের দুর্ভোগ শুধু বাড়ছেই।

সারা দেশে চরাঞ্চল এবং নদী-তীরবর্তী মানুষের দুর্ভোগ প্রায় অভিন্ন। এসব মানুষের জীবনকে নিরাপদ করার জন্য সরকারের নীতিগত পরিবর্তন প্রয়োজন। বন্যার কারণ তো জানাই আছে। সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করলে বন্যা কমিয়ে আনা সম্ভব। আর প্রতিবছর যেসব এলাকায় বন্যা হবে, সংকট সমাধানের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দেড় মাসের বন্যায় মাত্র ১০ কেজি চাল সরকার দেবে, এটি হতে পারে না। বাড়িঘর মেরামত, চিকিৎসা কিংবা ফসল উৎপাদনে দুর্গত মানুষ পর্যাপ্ত সহায়তা পাবেন না, এটি আমাদের কাম্য নয়। কৃষক ও জেলেদের হাত ধরে খাদ্য ও মৎস্য সম্পদে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার গর্ববোধ আমরা করি। বিপদে সরকার আস্থার সঙ্গে পর্যাপ্ত সহায়তা নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত সেই কৃষক, জেলেসহ অন্যদের পাশে দাঁড়াবে, এটাই আমাদের কাম্য।

তুহিন ওয়াদুদ: রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং রিভারাইন পিপল–এর পরিচালক