দুর্ঘটনা ও বিস্ফোরণের ঝুঁকি

বৈরুতে রাসায়নিক মজুতের বিস্ফোরণ স্মরণ করিয়ে দিল যে বিশ্ব কতটা অনিরাপদে আছে। সরকারগুলোর বোধোদয় ঘটছে। সিডনি ও চেন্নাই সরাচ্ছে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের মজুত। তবে ব্যতিক্রম সম্ভবত বাংলাদেশ। প্রতিটি গণ–প্রাণহারী দুর্ঘটনার পরে পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক–সংশ্লিষ্ট স্থাপনাগুলো সরানোর কথা ওঠে। পরে এ থেকে একসময় গণমাধ্যমের চোখ সরে, সরকারেরও চোখ সরে যায়। এভাবেই চলছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কারও কোনো জবাবদিহি নেই। রাজধানী ঢাকাসহ ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোর যত্রতত্র ছোট-বড় রাসায়নিক স্থাপনা রয়েছে। কিন্তু এর সঠিক পরিসংখ্যান কারও জানা নেই।

তবে বৈরুতের ভয়াবহ বিস্ফোরণ এবং প্রায় ১৫০ জনের প্রাণহানি ও চার হাজারের বেশি আহত হওয়ার যে ঘটনাটি ঘটেছে, এমন ঘটনা ঘটার ঝুঁকি থেকে বাংলাদেশ মুক্ত নয়। বৈরুতের চেয়ে ঢের বেশি পরিমাণ রাসায়নিক বাংলাদেশে অনিরাপদ অবস্থায় মজুত থাকতে পারে। শুধু এক তৈরি পোাশাকশিল্প খাতের জন্যই বছরে বিপুল পরিমাণ রাসায়নিকের মজুত থাকে। কিন্তু তার রক্ষণাবেক্ষণ দীর্ঘকাল ধরে উদ্বেগের বিষয় হয়ে আছে। পুরান ঢাকায় বারবার দুর্ঘটনা ঘটে। আর শুধু সে কারণেই এগুলো স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে থাকে। অন্যান্য ক্ষেত্রের অনিরাপদ মজুত ও হ্যান্ডলিং নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য নেই। 

তবে রাসায়নিক দ্রব্যাদির মজুত ও তদারকির ক্ষেত্রে আন্তঃসংস্থাগুলোর মধ্যে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত হয়ে আছে। কিন্তু সেগুলোর বাস্তবায়নের গতি খুবই মন্থর। ফায়ার ব্রিগেড, কারখানা পরিদর্শন সংস্থা ডাইফি, বিস্ফোরক বা পরিবেশ অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন বা শিল্প মন্ত্রণালয়ের কাছে এ বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা বা অজুহাত রয়েছে। এগুলোই প্রমাণ করে যে এদের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। তবে সমন্বয়হীনতা যে ভয়ংকর, সেই উদ্বেগ পর্যন্ত কর্তাব্যক্তিদের আচরণে প্রতীয়মান হয় না। প্রত্যেকর কাছেই কমবেশি প্রত্যেককে দায়ী করে দেওয়া ব্যাখ্যার ঝাঁপি রয়েছে, যা রাসায়নিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি উন্নয়নের অন্তরায়।

দুঃখের বিষয়, রাসায়নিক পণ্য বা দ্রব্যের আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক নেটওয়ার্ক ও সহযোগিতার জায়গাগুলোও খুবই ঢিলেঢালা। রাসায়নিক প্রেরণ ও গ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে ন্যূনতম কোনো নেটওয়ার্কিং নেই। আর দশটা পণ্য আমদানি–রপ্তানির মতোই রাসায়নিক দ্রব্যের প্রায় অবাধ বিকিকিনি চলছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক পণ্যদ্রব্য এসে থাকে। কিন্তু এর মজুত ও ব্যবহার তদারকির জন্য দ্বিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয় কোনো ধরনের ব্যবস্থা বিদ্যমান নেই। অথচ সার্কের আওতায় এ রকম একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলা কোনো কঠিন কাজ নয়।

নিমতলী ও চকবাজারের চুড়িহাট্টায় দুটি দুর্ঘটনার ভয়াবহ স্মৃতি যদি আমরা এত সহজেই ভুলে যাই, তবে তার চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কিছু হতে পারে না। শুধু পুরান ঢাকাতেই ছোট–বড় মিলিয়ে কয়েক হাজার রাসায়নিক দাহ্য বস্তুর গুদাম আছে, যা অচিহ্নিত। এর মধ্যে সিংহভাগই বাসাবাড়িতে। বিস্ফোরক অধিদপ্তরের লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ রাখাটা নাগরিক নিরাপত্তা একদম বাড়ায়নি। কারণ, এ খাতের বেআইনি তৎপরতা একদম থেমে নেই। এ খাতেও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের অবৈধ প্রভাব ও হস্তক্ষেপ স্পষ্ট। অবশ্য অতদারকিতে থাকা এ রকম স্থাপনার ছড়াছড়ি দেশজুড়েই রয়েছে।

রাসায়নিক পল্লির নির্মাণকাজ শেষ করা এবং সেখানে পরিকল্পিতভাবে সবার স্থাপনা সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ। তবে বৈরুতের বিয়োগান্ত অধ্যায় থেকে একটা শিক্ষা নেওয়া জরুরি। অতিমারির পরিস্থিতি সত্ত্বেও কিছু উদ্যোগ নেওয়া যায়। প্রথমত, সারা দেশে রাসায়নিক গুদাম বা স্থাপনার ওপর একটি ব্যাপকভিত্তিক সমীক্ষা চালানো। সবাই গোপনীয়তা বজায় রাখেন। তাই সরকারই কেবল এটা করতে পারবে। এ বিষয়ে কোনো সীমিত সমীক্ষাও নেই। দ্বিতীয়ত, অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে একটি নীতিমালা তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। তৃতীয়ত, একটি আঞ্চলিক উদ্যোগ নিতে কূটনৈতিক পদক্ষেপের শুরু করাটাও অপরিহার্য।