কুম্ভকর্ণের ঘুম এবং পরীক্ষার শিক্ষা

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

শিক্ষার নামে বিপুল বইয়ের বোঝা, তার ওপর পরীক্ষার বোঝা চাপিয়ে শৈশব চুরির অভিযোগ সবার এবং তা বহু পুরোনো। কিন্তু সে বোঝা নামানোর কোনো উদ্যোগ নেই, যা আছে তা হলো বোঝা বাড়ানো। কারা এ কাজের সঙ্গে যুক্ত, তা–ও স্পষ্ট নয়। কেউ দায় স্বীকার করে না। সবার জবাব অস্পষ্ট এবং বাংলাদেশের সংস্কৃতি মোতাবেক অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নিজেকে সাধু সাজানোর কৌশল।

বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া অনিশ্চিত, পরীক্ষাও অনিশ্চিত। কিন্তু প্রাথমিক সমাপনী নিয়ে কোনো কোনো মহলের কথাবার্তা চরম নৈরাজ্যকর। এমন পরিস্থিতিতে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া ও পরীক্ষা নিয়ে মা–বাবা-অভিভাবকের ঘুম হারাম। তাঁদের স্বপ্ন চুরমার হয়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ খবরেও ধোঁয়াশা কাটছে না। জানানো হচ্ছে, এ বছর প্রাথমিক সমাপনী আর জেএসসি পরীক্ষা ‘নাও হতে পারে’। আবার গতকাল জানা গেল, এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। কারও কাছে সুস্পষ্ট কোনো জবাব নেই। অপ্রয়োজনীয়, নির্যাতনমূলক এ পরীক্ষা দুটো চিরতরে বন্ধের কোনো চিন্তাভাবনা নেই কর্তাদের মাথায়।

দুটো পরীক্ষাই নিতান্ত অপ্রয়োজনীয় ও নির্যাতনমূলক; দুর্নীতিতে ঠাসা। এ দুটো পরীক্ষায় মিলে সম্ভাব্য পরীক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ! এই দুই পরীক্ষার বিপুল–বিশাল কর্মযজ্ঞে রাষ্ট্রের সুবিপুল শ্রমঘণ্টা নষ্ট হয়। সেই সঙ্গে ঘটে শত শত কোটি টাকার শ্রাদ্ধ। কিন্তু এর সুফল শূন্য। শিক্ষা নিয়ে দীর্ঘকাল কাজ করেন রাশেদা কে চৌধূরী। তিনি সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। এই পরীক্ষা বন্ধের জন্য তিনিও বারবার আবেদন জানাচ্ছেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা। অবশেষে জানা গেল, বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিট ছয় দফা প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। এখন সেসব নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে জাতিকে জানাবে পরীক্ষা হবে কি হবে না। (জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষার বিষয় কমানোসহ ৬ বিকল্প প্রস্তাব, প্রথম আলো, ৮ আগস্ট, ২০২০)।

উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার অনিশ্চয়তাও কাটেনি। স্নাতক বা মাস্টার্স নিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাথাব্যথা নেই। আবার অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন ক্লাস, পরীক্ষা নিয়ে তরতরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এদিকে সবে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি–প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু কবে, কীভাবে পাঠদান শুরু করা যাবে, তা কেউ জানে না।

বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিট দুই দশক ধরে কাজ করছে। তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ হয় না। কিন্তু এ পর্যন্ত এই ইউনিটের কোন কাজ দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় কী সুফল দিয়েছে, তা আমজনতা জানে না, বোঝেও না। পড়ুয়াদের লেখাপড়া নিয়ে এই দপ্তরের মাথাব্যথা নেই। তারা পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত। সিলেবাস ছাঁটকাট করে পরীক্ষা, কম বিষয়ে পরীক্ষা, অর্ধেক নম্বরে পরীক্ষা, সেশন পিছিয়ে পরীক্ষা, অটো প্রমোশন এমন সব পরস্পরবিরোধী কথামালায় ঠাসা নিদান এখন মন্ত্রণালয়ের পরীক্ষাগারে!

বড়দের নিয়ে এমন আজগুবি পরীক্ষা–নিরীক্ষা চালাতে তাদের সাহসে কুলায় না। সেখানে প্রতিবাদের শঙ্কা কাজ করে। যত গিনিপিগ আমাদের শিশুরা। শিক্ষায় আধুনিকতার ছোঁয়া নেই; কিন্তু পরীক্ষার চাপে শিশু এবং শিক্ষক উভয়ই জেরবার। মা–বাবার ঘুম হারাম। আখেরে জাতির পঙ্গুত্ব বরণ। প্রথম আলোকে রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ‘কোনোভাবেই প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি পরীক্ষা নেওয়া উচিত নয়। এই পরীক্ষার সনদ কোনো কাজেও আসে না’ (জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষায় বিষয় কমানোসহ ৬ বিকল্প প্রস্তাব, প্রথম আলো, ৮ আগস্ট, ২০২০)।

তাহলে এসব পরীক্ষা নেওয়ার মচ্ছব কেন? এর একটি বড় কারণ, এ দেশের এলিট শ্রেণি এ শিক্ষাব্যবস্থার একেবারে বাইরে। বাংলাদেশে যে বিশাল মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটেছে তারাও এর বাইরে। দেশের মন্ত্রী, সাংসদ, সামরিক-বেসামরিক বড় আমলা, বণিক, চিকিৎসক, ব্যাংকার তো বটেই ছোট আমলা, মাঝারি ব্যবসায়ীরাও তাঁদের সন্তানদের এ ব্যবস্থার বাইরে নিয়ে গেছেন। বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিটে যাঁরা নিদান দিচ্ছেন, তাঁদের সন্তানেরাও এর বাইরে। এ নিদান শুধু দেশের সাধারণ মানুষের জন্য বহাল। তাদের সন্তানদের দমিয়ে রাখার কূটকৌশল হলো এসব পরীক্ষার ফাঁদ। সেগুলো আরও জোরদার করা হচ্ছে রাষ্ট্রের বিপুল অর্থের অপচয় ঘটিয়ে, মেধা বিকাশের সব দরজা বন্ধ করে দিয়ে।

তাহলে বিকল্প কি নেই? আছে, অবশ্যই আছে। আর তা হলো প্রাথমিক সমাপনী ও ইবতেদায়ি এবং জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষা চিরতরে বন্ধ করা, স্কুলেই পরীক্ষা নিয়ে পড়ুয়াদের পরের শ্রেণিতে তোলার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা। মন্ত্রণালয়ের উচিত কেবল এ পথেই কাজ শুরু করা।

আমিরুল আলম খান: যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান।
[email protected]