টিকটক বিতর্ক, ইন্টারনেটের বিভাজন ও স্নায়ুযুদ্ধ ২.০

বাংলাদেশে সম্প্রতি টিকটকের উঠতি তারকা ‘অপু ভাই’য়ের গ্রেপ্তারের ঘটনাকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছাড়িয়ে মূলধারার গণমাধ্যমেও মোটামুটি একটা বিতর্কের ঝড় বয়ে গেছে। রুপালি পর্দার বিপরীতে ইউটিউবের তারকা হিরো আলমের মতো অনেকটা ‘বড়’দের আড়ালেই অপু ভাইয়ের মতো বেশ কিছু টিকটক তারকার আবির্ভাব ঘটেছে। রাফিভাইইউ নামের এক তারকার অনুসারী আছেন ৭০ লাখ। ফেসবুক বা টুইটারের মতো মূলধারার মাধ্যমে দাপট আছে এমন সব বাংলাদেশি ‘বড় তারকা’দেরও এত বিপুলসংখ্যক ফলোয়ার কারও আছে কি না, সন্দেহ। বয়সে ছোট কিশোর-তরুণদের মধ্যে টিকটক অল্প সময়েই বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

চীনা এই অ্যাপ প্রথমে আন্তর্দেশীয় কূটনীতিতে বিরোধের বিষয় হয়েছে ভারতে। লাদাখে চীনা সৈন্যদের সঙ্গে সংঘাতের পরিণতিতে ভারত টিকটকসহ অর্ধশতাধিক চীনা অ্যাপ নিষিদ্ধ করেছে। অপু ভাইয়ের গ্রেপ্তারের পর বাংলাদেশিদের মধ্যে এমন আলোচনাও ওঠে যে বাংলাদেশেও হয়তো এটি নিষিদ্ধ হতে যাচ্ছে। ভারতের সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতার কারণেই হয়তো এমন ধারণা ছড়িয়েছিল। ওদিকে যুক্তরাষ্ট্রও সে দেশে টিকটকের ব্যবসা সে দেশের কোনো কোম্পানির কাছে আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিক্রি না করে দিলে নিষিদ্ধ করার হুঁশিয়ারি দিয়েছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে টিকটককেন্দ্রিক বিরোধ আসলে তথ্যপ্রযুক্তি ঘিরে আসন্ন এক বৃহত্তর কূটনৈতিক লড়াইয়ের আলামত। তবে লড়াইটা যে বিপজ্জনক রূপ নিতে যাচ্ছে, তা বিশ্বায়নের অনেক অর্জনকেই নস্যাৎ করে দিতে পারে। 

যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, ট্রাম্প প্রশাসনের চীনবিরোধী হুংকার ততই বাড়ছে। কোভিড–১৯ মহামারি মোকাবিলায় অবিশ্বাস্য ব্যর্থতার দরুন ৫০ লাখ আক্রান্ত এবং প্রায় দেড় লাখ মৃত্যুর দায় নিয়ে পুনর্নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিদেশনীতিতে কিছুটা সাফল্য তাঁর জন্য খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। কোভিড–১৯কে চীনা ভাইরাস অভিহিত করা থেকে শুরু করে উইঘুর মুসলিম নিপীড়ন এবং হংকংয়ের স্বশাসন নিয়ে নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর এখন ইন্টারনেট নিয়েও শুরু হয়েছে নতুন লড়াই। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ৬ আগস্ট ইন্টারনেটকে চীনের প্রভাবমুক্ত করার ক্লিন পাথ নামের পরিকল্পনার বিস্তারিত প্রকাশ করেছেন। তথ্যপ্রযুক্তির প্রতিযোগিতায় চীন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠার পটভূমিতে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক স্বার্থ ও নিরাপত্তাগত বিবেচনায় নেওয়া এই পরিকল্পনার পরিণতি অনেকের মতে হবে ইন্টারনেট বিভাজন। নতুন সূচিত চীন-মার্কিন স্নায়ুযুদ্ধে (২.০ সংস্করণ) দুই পক্ষের জন্য দুটি আলাদা ইন্টারনেট বলয় তৈরির সম্ভাবনা এখন অন্যদের জন্য নতুন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

চীনা সরকারের পররাষ্ট্রনীতির প্রতিফলন ঘটে যে কাগজটিতে, সেই গ্লোবাল টাইমস–এর সম্পাদক হু সিজিন সেদিনই এক টুইটে বলেন, পম্পেওর এই পদক্ষেপের মানে দাঁড়াবে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারনেট–সংযোগ ছিন্ন করা। এর মৌলিক পরিণতি হবে মানবতার বিভাজন। সহযোগিতা এবং সম্পর্ক বিনিময়ে ছেদ ঘটলে উভয় দেশই সংঘাতের পথে এগোবে এবং যুদ্ধের ঝুঁকি তৈরি হবে।

মাইক পম্পেও ক্লিন পাথ বা ক্লিন নেটওয়ার্ক নামের যে ব্যবস্থা তৈরির পরিকল্পনার কথা বলছেন, তার জন্য পাঁচটি পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেছেন। প্রথমত, ক্লিন ক্যারিয়ার বা পরিচ্ছন্ন বাহক, অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য বিদেশি গন্তব্যের মধ্যকার আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগে চীনা কোনো টেলিকম কোম্পানির কোনো ভূমিকা থাকতে পারবে না। এ জন্য যুক্তরাষ্ট্রের টেলিকম নিয়ন্ত্রক সংস্থা এফসিসি যাতে চায়না টেলিকমসহ তিনটি চীনা কোম্পানিকে দেওয়া অনুমতি বাতিল করে, সেই লক্ষ্যে তারা কাজ শুরু করেছে।

দ্বিতীয় পদক্ষেপকে তাঁরা বলছেন ক্লিন স্টোর। যার মানে হচ্ছে গুগল অ্যাপ স্টোর বা অ্যাপল অ্যাপ স্টোরের মতো অ্যাপ বিতরণকারী প্ল্যাটফর্মকে চীনা অ্যাপমুক্ত করা। টিকটক, উইচ্যাটের (ফেসবুকের মতো চীনা সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম) মতো অ্যাপ নিষিদ্ধ করা। এর কারণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তি হচ্ছে এসব অ্যাপ আমেরিকান নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্যের জন্য ঝুঁকি তৈরি করবে।

তৃতীয়ত, ক্লিন অ্যাপস। হুয়াওয়ের মতো যুক্তরাষ্ট্রের বিবেচনায় ‘অবিশ্বস্ত’ টেলিফোন ডিভাইস প্রস্তুতকারকেরা যাতে যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় অ্যাপসগুলো আগে থেকেই অন্তর্ভুক্ত (প্রিইনস্টল) করতে না পারে, সেই ব্যবস্থা করা। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, হুয়াওয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সহযোগী এবং চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নজরদারি নীতি বাস্তবায়নের অংশীদার।

চতুর্থত, ক্লিন ক্লাউড। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের তথ্যভান্ডার ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহারে বর্তমানে যে ক্লাউডবেইজড সিস্টেম ব্যবহার করে তার সুরক্ষার যুক্তি দেখিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পম্পেও এই পদক্ষেপের পটভূমি ব্যাখ্যা করেন। পম্পেও বলেছেন, ‘অধিকাংশ আমেরিকানের স্পর্শকাতর ব্যক্তিগত তথ্য, আমাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সবচেয়ে মূল্যবান মেধাস্বত্বের সম্পদ, যার মধ্যে কোভিডের টিকা গবেষণাও রয়েছে, সেগুলোতে ক্লাউডভিত্তিক ব্যবস্থায় কেউ অনধিকার প্রবেশ করুক তা প্রত্যাশিত নয়।’ তিনি এ ক্ষেত্রে আলিবাবা, বাইদু, চায়না মোবাইল, চায়না টেলিকম এবং টেনসেন্ট কোম্পানিগুলোর নামও উল্লেখ করেন। চীনে ক্লাউড সেবা প্রদানকারী কোম্পানিগুলোর তথ্য সংগ্রহ, মজুত এবং তা নিয়ে কাজ করার ক্ষমতা সীমিত করার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর বাণিজ্য বিভাগসহ অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে কাজ করবে বলেও তিনি জানান।

পঞ্চমত, ক্লিন কেব্‌ল। বাকি বিশ্বের সঙ্গে সংযোগের ক্ষেত্রে সাগরতলে বসানো কেব্‌লে বাহিত তথ্যপ্রবাহে যুক্তরাষ্ট্রের কথায় চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নজরদারি বা চুরি এড়াতে তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও কোম্পানির সঙ্গে কাজ করবে। সাগরতলের এই কেব্‌ল প্রতিষ্ঠায় হুয়াওয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী পম্পেও বলছেন, চীনের রাষ্ট্র–সমর্থিত সাগরতলের প্রযুক্তির সুবাদে হুয়াওয়ে এ ক্ষেত্রে অন্যান্য কোম্পানির চেয়ে কম খরচে কাজ করার সুযোগ নিয়েছে। তাঁর কথায়, তাঁরা এটা আর চলতে দিতে পারেন না।

কয়েক দশক ধরে ইন্টারনেট বিশ্বায়নকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছে। পৃথিবী মানুষের প্রায় হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। ভৌগোলিক দূরত্ব এখন আর বন্ধুত্ব বা আত্মীয়তার বন্ধনে কোনো বাধা নয়। তথ্য এবং জ্ঞানের আদান-প্রদান এখন চোখের পলকেই সম্ভব। তবে অর্পূণতা যা আছে তা হচ্ছে কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলোর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ এবং বিধিনিষেধের কারণে। যে কারণে চীন বাকি বিশ্ব থেকে কিছুটা আলাদা। সেখানে ফেসবুক নেই, অনেকে বিকল্প পথে তা ব্যবহার করেন। সে জায়গায় আছে তাদের নিজস্ব নেটওয়ার্ক উইচ্যাট। গুগল নেই, আছে বাইদু। বলা হয় ইন্টারনেটে চীনের আছে ‘গ্রেট ফায়ারওয়াল’। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ক্লিন নেটওয়ার্ক পরিকল্পনায় তৈরি হবে পাল্টা মহাপ্রাচীর। চীনের অন্তর্মুখী ব্যবস্থা তাতে যে আরও শক্তিশালী হবে, সন্দেহ নেই।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনের প্রতিবেশীদের মধ্যে বেশ কয়েকটি দেশ আছে, যেখানে উইচ্যাট বেশ জনপ্রিয়। বাংলাদেশেও ছাত্রছাত্রী এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে সীমিত আকারে এর ব্যবহার দেখা যায়। আর মোবাইল ও বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইসের ক্ষেত্রে বাংলাদেশসহ এশিয়া-আফ্রিকার অনেক দেশই ‘বিশ্বের কারখানা’র পরিচিতি পাওয়া চীনের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। ইন্টারনেটের বিভাজনের প্রভাব তাই আমাদের মতো দেশগুলোর ওপর পড়তে বাধ্য। যুক্তরাষ্ট্র এবং তার রাজনৈতিক মিত্রদের সঙ্গেও আমাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক এবং রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা রয়েছে।

বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতার পরিণতিতে ইন্টারনেটে দুটো বলয় তৈরি হলে তা হবে বাংলাদেশের জন্য এক নতুন বিপদ। প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কি এই সম্ভাব্য বিপদের গুরুত্ব বুঝতে পারছি? আর তা মোকাবিলায় আমাদের কূটনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত অবস্থানই বা কী? 


কামাল আহমেদ সাংবাদিক