এত অপরাধ এত দুর্নীতি, রাজনীতিটা কোথায়?

ইংরেজ ভাগ্যান্বেষী রবার্ট ক্লাইভ বাল্যকালে ছিলেন বখাটে, যুবক বয়সে মারকুটে এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এজেন্ট হিসেবে সুযোগসন্ধানী। ভারতবর্ষে এসেছিলেন ভাগ্যান্বেষী হিসেবে, ফিরে গেলেন ধনী ব্যারনের তকমা ‘লর্ড’ হয়ে। বাংলা লুণ্ঠন স্বদেশে তাঁর দুর্নাম মুছে দিয়েছিল। সেই বাংলাদেশে এখন হাজারো সুযোগসন্ধানী লর্ড ক্লাইভ। সুযোগসন্ধানীরা এখনো এলেবেলে চরিত্র থেকে রাতারাতি ‘লর্ড’ হয়ে যান। দেশের ভেতর বেশুমার দুর্নীতির শিরোমণি বিদেশের ‘বেগমপাড়া’ নিবাসী সম্মানিত ধনবান বনে গেছেন, তা গুনেও শেষ করা যাবে না। এটাই রবার্ট ক্লাইভের দেখানো সফলতার সহজ পথ। সহজই তো, লুটপাট ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছানোর আগে পর্যন্ত এঁদের টিকির খবর জনগণ জানতে পারে না। যখন জানতে পারা যায়, তখন তাঁদের ধরা যায় না। ধরাছোঁয়ার বাইরে—কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপে চলে যাওয়ার পরই দুদক ‘হক মাওলা’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ ধরনের নড়াচড়ায় ধুলা যত ওড়ে, কম্বল ততটা পরিষ্কার হয় না।

স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির সিন্ডিকেটের সম্মুখভাগের সেনাপতি মিঠুর কথাই ধরা যাক। করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্য খাতের লেজেগোবড়ে অবস্থার মধ্যেই জানা গেল, এই খাতের ব্যাপক লুটপাটের সঙ্গে জড়িত মোতাজজেরুল ইসলাম ওরফে মিঠু। জানতে জানতেই বেলা বয়ে গেল। ঘুঘু পাখির তত দিনে ধান খাওয়া শেষ। পাখি তত দিনে উড়ে গিয়ে জুড়ে বসেছে মার্কিন মুলুকে। সেখানে মিঠু সাহেব ১৬ কোটি টাকা দামের বাড়ি কিনেছেন, চড়ছেন রাজকীয় রোলস রয়েস গাড়িতে। ব্যবসার কাজে ওড়াউড়ি করছেন বিভিন্ন দেশে। এভাবে কিছুদিন কাটাতে পারলেই তাঁকে আর পায় কে? সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা নিয়ে কানাডায় চম্পট দেওয়া পিকে হালদারের টিকিটাও আর কেউ ছুঁতে পারবে না।

প্রথম আলোর আজকের খবরও সেই কথা বলছে, ‘মোতাজজেরুল ওরফে মিঠুকে আর পাওয়া যাবে না, এটা নিশ্চিত হয়েই সিএমএসডির সদ্য প্রয়াত পরিচালকের অভিযোগ খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। কারণ, সরকারের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের অব্যাহত আশীর্বাদ তিনি পেয়ে আসছেন। এর আগেও তাঁর বিরুদ্ধে দুদক তথ্য সংগ্রহ করেছিল, দোষ খুঁজে পায়নি।’  কী সুন্দর বন্দোবস্ত, কোনো হইচই নেই।

একসময় লর্ড ক্লাইভেরা এই দেশ লুণ্ঠন করে লন্ডন গড়েছেন, তারপর জমিদার-মহাজনেরা লুটে নিয়ে গড়েছেন কলকাত্তাই প্রাসাদ, পাকিস্তানিরা বাড়িয়েছেন ইসলামাবাদ-করাচির শানশওকত। দেশি হোক, বিদেশি হোক, এঁদের কাছে দেশটা ছিল টাকা বানাবার কারখানা। বাঙালিই করুক বা অবাঙালি, সম্পদ শোষণের এই কায়দাটা ঔপনিবেশিক। সিন্দাবাদের কাঁধে ভূত চেপে বসেছিল, আমাদের কাঁধে চেপে বসে আছে রবার্ট ক্লাইভের প্রেতাত্মা। দুবার দেশের পরিচয় বদলের পরও লুটপাটের কল অক্ষতই রয়ে গেছে।

ধর্মের কল নাকি বাতাসে নড়ে, লুটপাটের কল নড়ে রাজনীতির হাওয়ায়। এ এমন এক রাজনীতি, যাদের কাছে অপরাধী-দুর্নীতিবাজদেরই কদর বেশি। দেশপ্রেমিক, নীতিমান, যোগ্য ও সৎ মানুষেরা এখানে হাঁসফাঁস করেন। পুকুরের পানি বেশি ঘোলা করে ফেললে অন্য মাছেরা তলায় চলে যায়, ভেসে ওঠে কেবল ভেদা জাতীয় মাছ। তেমনি রাজনীতি অতিমাত্রায় ঘোলা হয়ে গেলে ভালো মানুষেরা তলিয়ে যান, ভেসে থাকেন শুধু সম্রাট-সাহেদ-সাবরিনা-জিকে শামীম-মিঠুর মতো লোকেরা। এঁরা একা নন, এঁদের সঙ্গে থাকেন ওসি প্রদীপের মতো নির্দয় খুনিরা। বাংলাদেশে রাজনীতি আর অপরাধের যে মিলন ঘটেছে, তারই সন্তান দুর্নীতির বরপুত্র-কন্যারা। মুখোশ খসে পড়ায় এঁদের নাম নেওয়া গেল বটে, কিন্তু যাঁদের মুখোশ অটুট, তাঁদের নাম জানলেও কেউ উচ্চারণ করেন না। করলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আছে, সাংবাদিক কাজল, অধিকারকর্মী দিদারের মতো অনেকে নাম নেওয়ার অপরাধে নির্যাতিত ও জেলবন্দী।

সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র নায়ক শশী কুসুমকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘শরীর শরীর শরীর, তোমার মন নাই কুসুম?’। সেরূপ আমাদেরও মনে প্রশ্ন জাগে, ‘ক্রাইম ক্রাইম ক্রাইম, পলিটিকস কোথায় তোমার?’ জাতীয়তাবাদের রাজনীতি, ধর্মবাদী রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতি—সব যেন ভোজবাজির মতো লাপাত্তা। রাজনীতিই আর্থিক ও ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্তদের সেফ হোম। 

ক্লাইভদের কোনো দেশ থাকে না, থাকে কচ্ছপের মতো শক্ত খোলের নিরাপত্তা। দখল ও লুটপাটের জন্য লাগে এক দেশ, লুটের মাল উপভোগের জন্য লাগে আরেক দেশ। ভাইকিং জলদস্যুদের মতো, মগ ও মারাঠা লুটেরাদের মতো এঁরা প্রকৃতই বোহিমিয়ান। কচ্ছপের মতো এঁরা ঘরের ছাউনি পিঠে করে বয়ে বেড়ান। খুবই হালকা ও চিকন সেই ঘর—ব্যাংকের কার্ড, বিদেশি পাসপোর্ট, বিনিয়োগকারীর সনদ। এগুলো পকেটে পুরে যে দেশেই যান, তাঁদের সমস্যা হওয়ার নয়। কোথাও সমস্যা দেখলে লোভের লম্বা গলাটা খোলের মধ্যে ঢুকিয়ে তাঁরা চম্পট দেন। ছুড়ে দেওয়া তির যেমন ফেরত আনা যায় না, তেমনি ফিরে আসে না লুণ্ঠিত টাকা, ফেরত আনা যায় না বেগমপাড়ার বাসিন্দাদের।

কিন্তু ১৭ কোটি মানুষের দেশ একটাই, জীবন একটাই। একবারের জন্য পাওয়া দেশ ও জীবনকে আখের মতো শুষে ছিবড়া করে ফেলা হলে মানুষ কী আশায় বাঁচবে? কী হবে আগামী প্রজন্মের? এই প্রশ্নের উত্তর রাজনীতি দিচ্ছে না, সরকার দিচ্ছে না। যদি প্রচলিত রাজনীতি থেকে উত্তরের বদলে সুসজ্জিত মিথ্যা আর চৌকস প্রতারণা আসে, তখন নতুন রাজনীতির কথা ভাবা ছাড়া উপায় নেই। ক্রাইম যদি পলিটিকসের দখল নিয়ে থাকে, তাহলে পলিটিকসকে দস্যুমুক্ত করা ছাড়া এই আজাব থেকে মুক্তির কোনো উপায় আছে বলে জানা নাই। সাবালক হওয়া প্রতিটি নাগরিকেরই দায়িত্ব রয়েছে ভেবে দেখার, কী করে আমরা এই দশায় পতিত হলাম।

নাকি আমরা ইতিমধ্যে ফুটন্ত পানিতে ছেড়ে দেওয়া সেই ব্যাঙের মতো হয়ে গেছি। ব্যাঙ নিজের শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ফুটন্ত পানিতে রাখা ব্যাঙটা পানির তাপমাত্রার সঙ্গে মানিয়ে নিতে নিজের দেহের তাপমাত্রা বাড়িয়ে ফেলে। এভাবে তাপ যত বাড়ে, ততই সে নিজের রক্তকে গরম করে। করতে করতে যখন তাপ অসহ্য হয়ে ওঠে, তখন সে শেষ চেষ্টাটা করে। সে লাফিয়ে কড়াই থেকে বেরোতে চায়। কিন্তু হায়, দেহের তাপ বাড়ানোর কসরত করতে করতে সে ততক্ষণে সব শক্তি খরচ করে ফেলেছে; তখন তার আর লাফ দেওয়ারও শক্তি নেই। ব্যাঙের সহ্য করার ক্ষমতাই তার মরণের কারণ হয়। মানিয়ে নিতে নিতে আমাদের অবস্থাও হয়তো ব্যাঙের মতো হয়ে যাচ্ছে।

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]