দুর্নীতি না-টেকানোর উপায়

মনোবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান দুর্নীতিকে নৈতিক অবক্ষয় ও সামাজিক ব্যাধি হিসেবে দেখেছে। অর্থনীতি বিষয়টিকে দেখেছে আমলাতান্ত্রিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে। জে এস নাই একটা গবেষণাকর্মের উদ্ধৃতি দিয়ে যখন বলেন, ‘বিশেষ করে একটা নতুন রাষ্ট্রে জনজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ঘুষ ও দুর্নীতি, যা আগাছার মতো সব ভালো গাছকে মেরে ফেলতে চায়। অথবা অন্য ভাষায় বলতে গেলে, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি মানুষের সদিচ্ছাকে নষ্ট করে এবং সমাজের জন্য কল্যাণকর সমস্ত নীতিকেও নস্যাৎ করে দেয়।’ তখন তিনি কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র ও নিকোলো ম্যাকিয়াভালির দি প্রিন্স এরই প্রতিধ্বনি করেন। তবে দুর্নীতি প্রতিরোধ সম্ভব। উন্নয়নের গোড়ার দিকে একটা নতুন রাষ্ট্রে দুর্নীতি থাকলেও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সুশাসনের অভাবজনিত সমস্যা আস্তে আস্তে দূর হয়। উন্নয়নের ইতিহাস সে কথাই বলে। তা ছাড়া বার্নার্ড ম্যান্ডভিল যেমন বলেছেন, ‘একজন দক্ষ ও সৎ রাজনীতিকের হাতে রাষ্ট্রের দায়িত্ব পড়লে ব্যক্তির অসততাকে তিনি কখনো কখনো সমষ্টির জন্য হিতকর করেও তুলতে পারেন।’

১৯৯৫ সালে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধে মাওরো বাংলাদেশের উদাহরণ টানেন এবং উল্লেখ করেন যে দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি হারাচ্ছে। আর ওয়ার্ল্ড ব্যাংক তাদের ২০০২ সালের রিপোর্টে মন্তব্য করেছে, বাংলাদেশে দুর্নীতি না থাকলে প্রবৃদ্ধি দ্বিগুণ হতে পারত। অতএব বোঝাই যাচ্ছে, দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশ কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বাংলাদেশে ১৯৯১-২০০০ মেয়াদে ৪.৬৮%, ২০০১-২০১০ মেয়াদে ৫.৫৮% এবং ২০১২-২০১৯ মেয়াদে ৬.৯৫% হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। একে খুব বেশি বলা যাবে না, যেখানে ইথিওপিয়ার প্রবৃদ্ধির হার ২০১২-২০১৯ পিরিয়ডে ছিল ৯.২৫%।

আসাদুল্লাহ, সাভোয়া ও মাহমুদ দেখিয়েছেন কীভাবে এনজিও মানব উন্নয়নের সূচকে অবদান রেখেছে। তার মানে হলো, এনজিও কার্যক্রম ব্যতীত শুধু সরকারি উদ্যোগে উন্নয়ন কতটা হতো, তা বলা মুশকিল। দুর্নীতি যেহেতু ১ নম্বর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, দুর্নীতির কারণগুলো সরকার, সরকারপ্রধান ও সিভিল সোসাইটির জানা দরকার, বোঝা দরকার। দুর্নীতির কারণ জানা গেলে তার প্রতিকারও বের করা সম্ভব। দুর্নীতির নানা কারণের মধ্যে যেসব কারণ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটের জন্য প্রযোজ্য, শুধু সেগুলোই এখানে সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক।

মাত্রাতিরিক্ত রেগুলেশন বা আইন ও নিয়মকানুন দুর্নীতির একটা প্রধান কারণ। নিয়ন্ত্রণ যত বেশি হবে, আমলাদের ঘুষ নেওয়ার তত বেশি সুযোগ সৃষ্টি হবে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ‘একটা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দাঁড় করানো কতটা সহজ’—এই রকম একটা সূচক প্রতিবছর প্রকাশ করে, যা একটা দেশের সরকারি অফিসের আইনগত বাধ্যবাধকতা নির্দেশ করে। এখানে দেখা যাচ্ছে, যেসব দেশে দুর্নীতি বেশি, সেসব দেশে এ সূচকের মান অনেক বেশি, যেমন আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান ও ভারতের সূচক যথাক্রমে ১৭৩, ১৬৮, ১৩১, ১০৮ ও ৬৩। অন্যদিকে যেসব দেশে দুর্নীতি কম, সেসব দেশে এই সূচকের মান অনেক কম। নিউজিল্যান্ডে ১, ডেনমার্কে ৪, নরওয়েতে ৯ এবং সুইডেনে ১০। মালয়েশিয়া গত চার দশকে ব্যবসা-বাণিজ্যে অভূতপূর্ব উন্নতি করেছে, সে দেশে এই সূচকের মান মাত্র ১২।

আমলাদের হাতে, এমনকি রাজনীতিবিদদের হাতেও বিবেচনা করতে পারার ক্ষমতা অর্থাৎ ডিসক্রিয়েশনারি পাওয়ার দেওয়া মানে তাঁদের দুর্নীতি করার সুযোগ করে দেওয়া। এই ক্ষমতাটা থাকতে হবে আইনপ্রণেতাদের হাতে। সংসদে ব্যাপক আলোচনা এবং এই আলোচনার আগে ও পরে সংসদীয় কমিটিকে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের কথা শুনতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, আইনটি যদি গার্মেন্টসসংক্রান্ত হয়, তাহলে গার্মেন্টস শ্রমিকদেরও মতামত নিতে হবে। গুনার মিরডাল তাঁর বিখ্যাত এশিয়ান ড্রামা বইয়েও আমলাদের হাতে বিবেচনা করতে পারার ক্ষমতা দেওয়াকে দুর্নীতির একটা কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন।

সরকারের আকার যত বড় হবে, দুর্নীতির সুযোগ তত বেশি হবে। সরকারের ক্ষমতা যত বিকেন্দ্রীকৃত হবে, দুর্নীতির সুযোগ তত কমে যাবে। বিশেষ করে সরকারি ব্যয় বিভিন্ন স্তরে ভাগ হয়ে গেলে দুর্নীতি অনেকটাই কমে যাওয়ার কথা। তবে সরকারের আকার ছোট হলে দুর্নীতি কমবে ঠিকই, তবে দেশে যদি গণতন্ত্র থাকে। দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিক ও আমলা রাষ্ট্রীয় সম্পদ এমন সব অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে নিয়ে যান, যেখানে তাঁদের অর্থ আত্মসাৎ করার সুযোগ থাকে। দুর্নীতিগ্রস্ত আমলা ও তাঁদের অদক্ষতার কারণে রাষ্ট্রকে প্রতিবছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার গচ্চা দিতে হচ্ছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকও প্রায় একই মতপ্রকাশ করেছে। তারা বলছে, দুর্নীতির কারণে অনুৎপাদনশীল খাতে রাষ্ট্রের সীমিত সম্পদ চলে যাওয়ায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটা বিশাল অংশজুড়ে আছে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও স্বাধীন বিচারব্যবস্থার ওপর গবেষণা। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও একটি স্বাধীন বিচারব্যবস্থা ছাড়া দুর্নীতি প্রতিরোধ অসম্ভব—এটাই ওই সব গবেষণাগুলোর মূল সুর। শ্রমের বাজারে, সংসদে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্যান্য বিভাগে নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণ দুর্নীতি কমাতে সহায়তা করতে পারে।

দুর্নীতির সঙ্গে রাষ্ট্রব্যবস্থার তথা রাজনৈতিক ব্যবস্থার সম্পর্ক নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে অর্থনীতিতে ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। গণতন্ত্র মানব উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে, এটা অনেকটা প্রতিষ্ঠিত সত্যের মতো। সুশাসন একটা দেশের মাথাপিছু আয় বাড়াতে সাহায্য করে।

ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের সম্পর্ক ও দুর্নীতি এ বিষয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় পারমিট, কন্ট্রাক্ট, লাইসেন্স ও সরকারি দপ্তরের কাজকর্ম হলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হতে বাধ্য। কারণ যে ফার্মগুলো ইতিমধ্যেই বাজারে আছে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে দক্ষ ফার্মগুলো রাজনৈতিক সংযোগ না থাকার কারণে বঞ্চিত হতে পারে, আর যারা বাজারে নতুন ঢুকতে চাচ্ছে, তারা সিন্ডিকেটের কারণে ঢুকতেই পারবে না। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে করপোরেশনগুলো যে যুক্ত হতে চায়, তার বিরাট প্রণোদনা আছে। তার মধ্যে আছে সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সুবিধা। যেমন সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান পানির দরে তিনি কিনে ফেলবেন, সহজেই ব্যাংকঋণ পেয়ে যাবেন ইত্যাদি। অপেক্ষাকৃত কম করের বোঝা অথবা কোনো করই দিতে হবে না তাঁকে, সরকার তাঁর বেলায় আইনগত বাধ্যবাধকতা উপেক্ষা করবে। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসাগুলো যে ফায়দা লোটে, তার একটা অংশ রাজনীতিকেরা নিজেরাই নিয়ে নেন।

আগেই বলা হয়েছে যে অর্থনীতি দুর্নীতিকে ব্যাখ্যা করে একটা আমলাতান্ত্রিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে। এর সমাধান হিসেবে তাই অর্থনীতিবিদেরা কিছু ব্যবস্থা বা ‘যন্ত্রপাতি’ স্থাপনের পরামর্শ দেন। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে রাষ্ট্রের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা। গণতন্ত্র ও জবাবদিহি, সংসদে কার্যকর বিরোধী দলের উপস্থিতি, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, ব্যক্তির বাক্‌স্বাধীনতা, সব মতবাদ প্রচার করার সমান সুযোগ, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, স্বাধীন মানবাধিকার কমিশন হচ্ছে সেই সব হাতিয়ার বা ব্যবস্থা। শুধু তা–ই নয়, পুলিশ বিভাগ ও তদন্ত সংস্থাগুলোকেও হতে হবে পুরোপুরি স্বাধীন। সংস্থাগুলোর নিয়োগ–প্রক্রিয়াও হতে হবে স্বচ্ছ ও পক্ষপাতহীন। না হলে দুর্নীতি দূর হবে না।

ড. এন এন তরুণ: রাশিয়ার সাইবেরিয়ান ফেডারেল ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতির ভিজিটিং প্রফেসর।