বালামসিবত মানবজীবনের পরীক্ষা

মানবজীবন অনন্ত, এটি একটি মহাসফর। রুহের জগৎ থেকে তার সূচনা, দুনিয়ার জীবন তার ভ্রমণ পরিক্রমা, বারজাখ জীবন অন্তর্বর্তীকালীন সময়, আখিরাত তার চূড়ান্ত গন্তব্য। এই জীবনের কোনো শেষ নেই। জন্মগ্রহণের মাধ্যমে আমাদের দুনিয়ার জীবন শুরু হয়, মৃত্যুবরণের মাধ্যমে বারজাখ জীবনের সূচনা হয়, কিয়ামতের মাধ্যমে পরকালের প্রারম্ভ ঘটবে। একেকটি ধাপের সমাপ্তি অন্য ধাপের আরম্ভ মাত্র। পরকাল হলো চিরস্থায়ী। তাই মুমিন বা বিশ্বাসীদের জীবনে হারানোর কিছু নেই, হারানোর ভয়ও নেই, হতাশাও নেই। প্রয়োজন শুধু প্রতিটি ধাপে, প্রতিটি পর্যায়ে সব অবস্থায় যথাযথ কর্মটি সম্পাদন করা। যা সব মানুষের কল্যাণে নিবেদিত হবে।

আল্লাহ তাআলা জিন–ইনসান সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদতের জন্য। ইবাদত মানে আল্লাহর আনুগত্য তথা তাঁর চিরন্তন চিরায়ত বিধানের প্রতি আত্মসমর্পণ করা। আল্লাহর দেওয়া জীবন, আল্লাহর দেওয়া সম্পদ, আল্লাহর দেওয়া সময় আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশে্য আল্লাহর পথে, রাসুল (সা.)–এর সুন্নাহ মোতাবেক মানুষের কল্যাণে ব্যয় করাই হলো ইবাদত।

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কোরআন কারিমে বলেন, ‘মহামহিমান্বিত তিনি সর্বময় কর্তৃত্ব যাঁর করায়ত্ত; তিনি সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান। যিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন, তোমাদিগকে পরীক্ষা করার জন্য, কে তোমাদের মধ্যে কর্মে উত্তম? তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল।’ (সুরা-৬৭ মুলক, আয়াত: ১-২)। আল্লাহ তাআলা কোরআন মাজিদে আরও বলেন, ‘আমি তোমাদিগকে কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং ধনসম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা অবশ্যই পরীক্ষা করব। তুমি শুভ সংবাদ দাও ধৈর্যশীলগণকে, যারা তাদের ওপর বিপদ আপতিত হলে বলে (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন) আমরা তো আল্লাহরই এবং নিশ্চিতভাবে তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী।’ (সুরা:-২ বাকারা, আয়াত: ১৫৫-১৫৭)।

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআন মাজিদে বলেছেন, ‘মহাকালের শপথ, মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত; কিন্তু তারা নয়, যারা ইমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয় ও ধৈর্যের উপদেশ দেয়।’ (সুরা-১০৩ আসর, আয়াত: ১-৩)। এই সুরার শেষে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ধৈর্যকে সাফল্যের নিয়ামকরূপে বর্ণনা করেছেন।

মহামারি ও দুর্যোগে ভীতসন্ত্রস্ত না হয়ে, মনোবল দৃঢ় রেখে, শান্তভাবে পরিস্থিতি উত্তরণ মুমিনের কাজ। বিপদগ্রস্তদের সাহায্য–সহযোগিতা করা, সেবা করা, দান–খয়রাত করা বিপদ-আপদ ও বালামসিবত মুক্তির অন্যতম উপায়।

জীবনযুদ্ধের পরীক্ষায় সফলতার পথ হলো ধৈর্য ও মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা ধৈর্য ধারণ করো, ধৈর্যের প্রতিযোগিতা করো এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকো, সুসম্পর্ক বজায় রাখো, আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।’ (সুরা-৩ আলে ইমরান, আয়াত: ২০০)। আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, ‘হে মুমিনগণ! ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে তোমরা সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সহিত আছেন।’ (সুরা:-২ বাকারা, আয়াত: ১৫৩)।

নবী হজরত ইউনুস আলাইহিস সালামকে সামান্য অধৈর্য হওয়ার কারণে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ রাতের আঁধারে উত্তাল সমুদ্রবক্ষে হিংস্র মৎস্য উদরে যেতে হয়েছিল। এ প্রসঙ্গ উল্লেখ করে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–কে উদ্দেশ করে কোরআন কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অতএব তুমি ধৈর্য ধারণ করো তোমার প্রতিপালকের নির্দেশের অপেক্ষায়, তুমি মৎস্য-সহচর (ইউনুস আ.)–এর ন্যায় অধৈর্য হয়ো না, সে বিষাদ আচ্ছন্ন অবস্থায় কাতর প্রার্থনা করেছিল।’ (সুরা-৬৮ কলম, আয়াত: ৪৮)।

যাঁরা উপর্যুক্ত অর্থে ধৈর্য ধারণ করবেন, তাঁদের জীবনে পূর্ণতা ও সফলতা অনস্বীকার্য। কারণ প্রথমত, অন্যায়, অপরাধ তথা পাপকার্য হতে বিরত থাকা সব ধরনের অকল্যাণ ও গ্লানি থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায়। দ্বিতীয়ত, ইবাদত ও সৎকর্ম সম্পাদন করা সফলতার একমাত্র সোপান। তৃতীয়ত, প্রতিকূলতায় দৃঢ়পদ থাকা লক্ষ্যে পৌঁছার একমাত্র মাধ্যম। ‘সবর কামিল’ বা পরিপূর্ণ ধৈর্যই মানবজীবনকে পূর্ণতা দিতে পারে। আমাদের উচিত সব অনভিপ্রেত অবস্থায় যেকোনো অযাচিত পরিবেশ ও অনাহূত পরিস্থিতিতে নিজেকে সংযত রেখে দৃঢ়তার সঙ্গে লক্ষ্যপানে এগিয়ে যাওয়া। তবেই আল্লাহর সাহায্য আমাদের সাথি হবে, আল্লাহ আমাদের সঙ্গী হবেন।

ধর্মচর্চা, আত্মমূল্যায়ন, জীবনবোধ এবং বিশ্বাস, আশা ও ভালোবাসা সব প্রতিকূলতায় সফলতা এনে দেবে ইনশা আল্লাহ!

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক
smusmangonee@gmail,com