নগর ব্যবস্থাপনা ও 'ল্যান্ডস্কেপ' শিক্ষা

২০ সেপ্টেম্বর ২০১৩। সান ফ্রানসিস্কোর একটি রাস্তা, যেখানে সাধারণত দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত গাড়ি পার্ক করা হয়ে থাকে। পার্কিং সময় অতিবাহিত হওয়ার পর সেখানে একদল শিক্ষার্থী বিশেষভাবে তৈরি প্রাকৃতিক সবুজ ঘাসের কার্পেট বিছাতে শুরু করলেন এবং অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই সেই জায়গাটি পরিণত হলো ব্যস্ত রাস্তার পাশে গড়ে ওঠা ‘সবুজ আরবান পার্ক’ রাস্তায় কাজে ব্যস্ত কোনো নাগরিক এক চিলতে শান্তির জন্য একটু বসে জিরিয়ে নিচ্ছে এখানে এসে। পার্কিংয়ের সময় ছাড়া দিনের বাকি সময় জায়গাটিকে এভাবেই অস্থায়ী আরবান পার্ক হিসেবে গড়ে তুললেন ল্যান্ডস্কেপ স্থাপত্যের ওপর শিক্ষারত একদল শিক্ষার্থী।
অন্যদিকে ম্যানহাটন হাইলাইন পার্কের কথা আমরা অনেকেই জানি যেখানে ফুট ওভারব্রিজের ওপর সুপরিসর একটি সবুজ পার্ক একদিকে যেমন শহরের সৌন্দর্য অনেকাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে, অন্যদিকে শহরে কোলাহল থেকে একটু শান্তি খুঁজে পাওয়ার আশায় সাধারণ নাগরিকের পছন্দের জায়গায়ও পরিণত হয়েছে এই বিশেষ স্থান। তা ছাড়া শিকাগোতে ইয়ুথ সেন্টারের ছাদে তৈরি করা বাগান, যেখানে সবজিখেত তৈরি করা হয়েছে এবং প্রাকৃতিক ইকোসিস্টেম বলয় প্রস্তুত করা হয়েছে, যা বর্তমান সময়ের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য বিশেষ ভূমিকা পালন করছে।
সময়ের প্রয়োজনে দিন দিন বেড়ে চলেছে আমাদের আবাসনসমস্যা। আর এ সমস্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নগরের খালি জায়গাগুলোতে তৈরি করা হচ্ছে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, ব্রিজসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় স্থাপনা। এর দরুন কমে যাচ্ছে খোলা জায়গার পরিমাণ, ধ্বংস হচ্ছে সবুজ বন, শিশুদের খেলার মাঠ আর বেড়ে উঠছে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা। কারণ, বায়ুমণ্ডলের অতিরিক্ত তাপমাত্রা শোষণ করার মতো প্রয়োজনীয় সফট সারফেজ (মাটি) আমরা হারাচ্ছি দিন দিন। আমাদের দেশের শহরগুলোতে এর প্রকোপ আরও অনেক বেশি।
রাজধানী ঢাকাকে অনেক আগেই বসবাসের অনুপযোগী হিসেবে তৈরি করেছি, চট্টগ্রামের অবস্থাও এখন খুব বেশি সুখকর নয়। যেখানকার বাতাসে মিশ্রিত সিসার পরিমাণ ভয়াবহ মাত্রাতিরিক্ত। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) রিপোর্ট অনুযায়ী কেবল ধুলার কারণেই শহরে বসবাসরত নাগরিকদের মাসিক খরচ প্রায় চার হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা বেড়ে যায়। তা ছাড়া পর্যাপ্ত পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থার বেহাল দশা, একটু বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা, বিভিন্ন দুরারোগ্য ব্যাধির প্রাদুর্ভাব, পয়োনিষ্কাশনের অব্যবস্থাপনা যেন শহুরে জীবনের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। পরিকল্পিত নগরায়ণের অভাব এখানে মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনা থাকলেও সেগুলো শুধু নকশায়; তার বাস্তবায়ন খুব বেশি দেখা যায়নি এখন পর্যন্ত।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৭ অনুযায়ী, মৎস্য ও জলজ প্রাণীর জন্য পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন ৫ মিলিগ্রাম/লিটার বা তার ঊর্ধ্বে থাকার প্রয়োজন হলেও বিভিন্ন পরীক্ষায় দেখা গেছে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ অন্য শহরগুলোতে তা অপর্যাপ্ত। বিভিন্ন সময় দেশে দ্রুত সমস্যা সমাধানকল্পে বিবিধ প্রকল্প প্রণীত হলেও হয়তো তার সমাধান কিছু অংশে হচ্ছে কিন্তু ভবিষ্যতে তার বিরূপ প্রভাব পরিলক্ষিত হওয়া শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র। কয়েক দিন আগেই দেখা গেল ঢাকা শহরের আইল্যান্ডগুলোতে রান্নাঘর কিংবা টয়লেটের টাইলস লাগানো হচ্ছে জনসমক্ষেই কিংবা প্রয়োজনের
কথা বলে বুয়েট কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শতবর্ষের পুরোনো গাছগুলো কেটে ফেলা হচ্ছে। এ যেন মাথাব্যথা, তাই মাথাই কেটে ফেলার নামান্তর।
নগর পরিকল্পনার সঙ্গে নাগরিক জীবন পুনরুদ্ধারের জন্য পরিকল্পিত ল্যান্ডস্কেপ প্ল্যানিংয়ের অভাব নগরবাসী দীর্ঘদিন ধরে অনুভব করে এলেও আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত এই বিষয়ের ওপর কারিগরি শিক্ষার প্রসার কিংবা প্রয়োজনীয় প্রফেশনালস বডি তৈরি করার তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি, যার দরুন শহর দিন দিন তার সৌন্দর্য হারাচ্ছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। যখন কোনো প্রকল্প কিংবা স্থাপনা তৈরি হয়, তখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ শুধু জায়গাজমির ব্যবহার, স্থাপনার ফ্লোর এরিয়া রেসিওর পরিমাপ, এগুলোর ওপর বিশেষভাবে দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকলেও ল্যান্ডস্কেপ বিষয়টির ওপর কোনো বিশেষ ধরনের আলোকপাত করা হয় না। এখন পর্যন্ত এই দেশে বিষয়টি অনেকের কাছে অপরিচিতও বটে। অথচ নগর পরিকল্পনার সঙ্গে সুষ্ঠু ও পরিকল্পিত ল্যান্ডস্কেপিং নকশা প্রণয়নের মাধ্যমেই সম্ভব জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে নাগরিক জীবনকে মুক্ত রাখা, জলাবদ্ধতার সমাধান করা, পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থার পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনাসহ অন্যান্য সমস্যার সমাধান।
আমাদের দেশের অনেকেরই ধারণা, ল্যান্ডস্কেপ স্থাপত্য মানে শুধু গাছ লাগানো। বিষয়টি মোটেও সঠিক নয়। এ বিষয়টির সঙ্গে জড়িত রয়েছে অর্থনৈতিক-সামাজিক প্রেক্ষাপট। আমাদের দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে পার্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে না বুঝে, না জেনে শুধু দেখার সৌন্দর্যের জন্য যত্রতত্র বিভিন্ন প্রজাতির বিদেশি গাছ রোপণ করতে, যা অত্র এলাকার ইকো সিস্টেমের সঙ্গে একেবারেই বেমানান কিংবা স্থাপনায়, রাস্তায় সবুজায়ন করা হয়েছে ঠিকই, তথাপি তার সঙ্গে ‘আরবান হিট ইফেক্ট’-এর কোনো সম্পর্ক নেই।
শুধু সুন্দর নকশা প্রণয়নই সবকিছু নয়; এর সঙ্গে দেখতে হবে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, পরিবেশ, পারিপার্শ্বিকগত সম্পর্কের দৃঢ় অবস্থান। আর এই সমন্বয় সম্ভব যেকোনো ধরনের স্থাপনা কিংবা প্রকল্পে সুপরিকল্পিত ল্যান্ডস্কেপ ডিজাইনকে বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করা হলেই। প্রায় সব উন্নত দেশে চার বছর মেয়াদি ল্যান্ডস্কেপ স্থাপত্যের ওপর অনার্স ডিগ্রিসহ উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়া সম্ভব হলেও আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক দিক থেকে এই বিষয়টি এখন পর্যন্ত খুব বেশি প্রাধান্য পায়নি। বর্তমানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) স্থাপত্য বিভাগ অনার্স-মাস্টার্স পর্যায়ে এবং চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) অনার্স পর্যায়ে ল্যান্ডস্কেপ স্থাপত্যবিষয়ক পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা কার্যক্রম চালুর ব্যাপারে আশাবাদী হলেও কবে নাগাদ সেটি সম্ভব হবে, সেটা বলা মুশকিল।
তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে বিষয়টির সঙ্গে একদিকে যেমন জলবায়ুর সংশ্লিষ্টতা বিদ্যমান, অন্যদিকে সঠিক ল্যান্ডস্কেপের মাধ্যমে স্থাপনার মধ্যে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচল, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, ইকো কমিউনিটি তৈরির মাধ্যমে আমরা পারি আমাদের বিদ্যুতের ঘাটতি কমাতে, বসবাসের উপযোগী একটি নগর তৈরি করতে। তবে আশার কথা এই যে আমাদের দেশের অনেক মেধাবী স্থপতি-পরিকল্পনাবিদ বিশ্বের বিভিন্ন নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ল্যান্ডস্কেপ বিষয়ের ওপর উচ্চতর ডিগ্রি শেষে দেশে ফিরে এসেছেন কাজ করার উদ্দেশ্যে। তাঁদের অর্জিত অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান কাজে লাগাতে হবে দেশের কল্যাণে এবং তাঁদের কাজ করার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া এখন সময়ের দাবি। কারণ, দেশের জলবায়ুর পরিবর্তন, পরিবর্ধন এবং ভবিষ্যৎ শহরকেন্দ্রিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অনেকাংশে এই বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল, যা সবাইকে উপলব্ধি করতে হবে।

সজল চৌধুরী: সহকারী অধ্যাপক ও পরিবেশবিষয়ক গবেষক, স্থাপত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।