বাংলা হরফকে বাঁচাও

বাংলাদেশ সেই রাষ্ট্র, যে রাষ্ট্রের ভিত্তি বাংলা ভাষা। এই দেশ সেই দেশ, যার নাগরিকেরা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এই দেশের মানুষ সেই ভাষাশহীদদের সর্বোচ্চ মর্যাদা প্রদান করে। এটি এমন একটি দেশ, যেটি সারা দুনিয়াকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপহার দিয়েছে। এটি এমন এক দেশ, যার শতকরা ৯৬ জন মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, শরৎ-বঙ্কিম-শামসুর রাহমান-হুমায়ূন আহমেদের বাংলা ভাষার এই দেশ। দুনিয়ার চতুর্থ মাতৃভাষার এই দেশ। ভাষার সঙ্গে বাংলাদেশের আত্মার সম্পর্কের এমন আরও অনেক অভিধা তুলে ধরা যাবে।
যদি তেমন একটি দেশে বাংলা হরফকে বাঁচানোর আবেদন করতে হয়, তবে লজ্জায় কার মাথা হেঁট হয়! আমি জানি না, এই লজ্জার দায় কার? কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, দিনে দিনে বাংলা হরফকে বাঁচানোর আবেদনটা জোরালো করতে হচ্ছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলা হরফ বিপন্ন হচ্ছে ডিজিটাল প্রযুক্তির বদৌলতে। আমি অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে এই চরম আশঙ্কার কথাটি বলতে পারি।
অবস্থাটি কেমন, তার তিনটি দৃষ্টান্ত এখানে তুলে ধরতে পারি। সরকারের পক্ষ থেকে আমার মোবাইলে তিনটি এসএমএস পাঠানো হয়েছে। ৫ মার্চ সকাল আটটা ছয় মিনিট ২৭ সেকেন্ডের এসএমএসটি হলো: Apnar vote apnar odhikar, upazila parishad nirbachone dekheshune bujhe apnar vote din. ৭ মার্চ সকাল ১২টা তিন মিনিট আট সেকেন্ডের এসএমএসটি হলো: Apni akjon daeittosil voter, upazila parishad nirbachone dekheshune bujhe apnar vote din. ১২ মার্চ সকাল চারটা ৪৫ মিনিট ৩৩ সেকেন্ডের এসএমএসটি হলো: Apnar vote apnar pochondo, upazila porishod nirbachone apnar pochonder prarthike vote din.
যে দেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা এবং যে দেশের নাগরিকদের শতকরা ৯৬ জনই ইংরেজি জানে না, সেই দেশের সরকার কি এ রকম এসএমএস পাঠাতে পারে? রোমান হরফে বাংলা লেখার এমন কুৎসিত চেষ্টা কি কোনো সরকার গ্রহণ করতে পারে? এটি একদিক থেকে বাংলা ভাষার অবমাননা, অন্যদিকে অসাংবিধানিক। পক্ষান্তরে যদি সাধারণ মানুষের এসএমএস, মেইল, ফেসবুক-টুইটারের স্ট্যাটাস ইত্যাদি দেখা যায়, তবে তার চিত্রও অনুরূপ। আমি নিজেও মোবাইলের এসএমএসে রোমান হরফ ব্যবহার করি। বেশির ভাগ সময়েই রোমান হরফ দিয়ে ইংরেজি লিখি। কখনো কখনো বাংলাও লিখি। কিন্তু এটা খুবই অপছন্দের একটি কাজ। অথচ সেই কাজটি আমাকে করতে হয় এ জন্য যে আমার নিজের মোবাইল সেটটি বাংলা সমর্থন করে না এবং আমি যার কাছে এসএমএসটি পাঠাই, তার মোবাইল সেট বাংলা সমর্থন করে না।
ফেসবুক, টুইটার বা মেইলে অবশ্য আমার কোনো সমস্যা নেই। আমি বাংলাতেই লিখি। দু-একটি যুক্তাক্ষর নিয়ে সমস্যা আছে বলে সেসব অক্ষরসম্পন্ন হরফগুলো আমি লিখি না। বিকল্প শব্দ ব্যবহার করি। কথা ছিল, বাংলাদেশে আমদানি করা সব ফোনসেট বাংলা সমর্থন করবে। এ জন্য আইন আছে। মোবাইলের জন্য একটা বাংলা কি-বোর্ডও অনুমোদিত হয়েছে। কিন্তু বাজারে যেসব ফোনসেট আছে, তার সিংহভাগই বাংলা সমর্থন করে না। বাংলাদেশ টেলিকম রেগুলেটরি কমিশন নামক যে প্রতিষ্ঠানটি মোবাইল ফোন সেট আমদানির অনুমতি প্রদান করে, তাদের দায়িত্ব হচ্ছে ফোনসেটগুলো বাংলা সমর্থন করে কি না সেটি নিশ্চিত করা। তারা সেই কাজটি করে না বলেই সংকটটা বিরাজ করছে। তাদের আরও দায়িত্ব ছিল বাংলা সমর্থন করে না এমন মোবাইল সেট বাজার থেকে তুলে নেওয়ার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। তারা সেই বিষয়ে কোনো উদ্যোগই নেয়নি।
এটি না-হয় প্রযুক্তিগত সমস্যা। এটি না-হয় দায়িত্বজ্ঞানহীনতার আরও একটি দৃষ্টান্ত। কিন্তু বাংলা হরফের বা ভাষার প্রতি চরম বৈরী আচরণ আরও আছে। আমরা লক্ষ করেছি যে ডিজিটাল প্রযুক্তি প্রচলনের নামে ব্যবসা-বাণিজ্য, সরকারি কাজকর্ম ইত্যাদিতে বাংলাকে বিদায় করে ইংরেজি ভাষা বা নিদেনপক্ষে রোমান হরফ প্রচলন করা হচ্ছে। বেসরকারি ব্যাংকের কথা বাদ দিলেও একসময়ে সরকারি ব্যাংকের সব কাজকর্ম বাংলায় হতো। এখন তার সবই রোমান হরফে হয়। এমনকি পরীক্ষার ফলাফল, যা বাংলায় প্রকাশ করতে কোনো অসুবিধা নেই, সেটিও রোমান হরফে প্রকাশিত হয়। মোবাইল ফোনের ফর্ম, যাতে একটি রোমান হরফ না থাকলেও কোনো ক্ষতি নেই, সেটিও রোমান হরফেই প্রদত্ত হয়।
বর্তমানের বাংলাদেশে বাংলা হরফের এমন সব চরম দুর্দিনের কথা ভাবলে কেবল যেন মনটা খারাপ হয়। শুধু তা-ই নয়, নস্টালজিয়ার মতো আমাদের যৌবনকালের ফেব্রুয়ারি মাসের কথা মনে পড়ে। তখন বহু দোকানদার ফেব্রুয়ারি মাসে রোমান হরফের সাইনবোর্ড কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখত। রেডিও-টেলিভিশনের অনুষ্ঠানের নাম কেউ রোমান হরফে দেওয়ার কথা ভাবতেই পারত না। অথচ এখন কেবল এসব চ্যানেলের নাম নয়, বাংলা অনুষ্ঠানের ইংরেজি বা বাংলা নামগুলো রোমান হরফ দিয়ে প্রকাশ করে চরমভাবে বাংলা ভাষা-বর্ণমালা ও সাহিত্যকে অপমান করা হচ্ছে।
সাম্প্রতিক কালে রোমান হরফ দিয়ে বাংলা লিখে বাংলা হরফে রূপান্তর করার প্রবণতাও চরম আকার ধারণ করছে। অন্য সবকিছুর চেয়ে এই প্রচেষ্টাটির চরিত্র অপেক্ষাকৃত নিরীহ গোত্রের হলেও এর ফলে বাংলা বানানের বারোটা বাজছে এবং অশুদ্ধভাবে বাংলা লেখা একটি রেওয়াজে পরিণত হচ্ছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, বাংলা হরফ বা বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে যে অপকর্মগুলো হচ্ছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে সরকারের কোনো প্রতিরোধ তো নেই-ই, কোনো কোনোটির পৃষ্ঠপোষক হচ্ছে বাংলা ভাষার নামে প্রতিষ্ঠিত সরকার।

মোস্তাফা জব্বার: সভাপতি, বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি।