ক্ষমতাকেন্দ্রিক অসুস্থ প্রতিযোগিতা

এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা হ্রাস পেল
এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা হ্রাস পেল

আমাদের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে অনেক দৃশ্যমান আশাজাগানিয়া অগ্রগতি হয়েছিল। নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতা, ব্যাপক কারচুপি—এগুলো আমরা পার হয়ে এসেছি বলে সাধারণ মানুষ ভেবেছিল। কিন্তু এবার চার দফায় উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠান, বিশেষত চতুর্থ দফার ভোট গ্রহণকালে সহিংসতা, কারচুপি ইত্যাদি দেখে মনে হচ্ছে আমরা সেই অবস্থা থেকে সরে আসা নয়, আরও পেছনের দিকে যাচ্ছি। গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার জন্য এটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে। যদিও শুধু নির্বাচনই গণতন্ত্র নয়, কিন্তু নির্বাচন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার একটা মূল অংশ।
আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি বিষয় আমি লক্ষ করি; সেটা যেন এ রকম যে—আগের তুলনায় খারাপ করতে হবে, প্রতিপক্ষের তুলনায় খারাপ করতে হবে। এ রকম একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতার দৃষ্টান্ত এই উপজেলা নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হলো। জাতীয় রাজনীতির একটি কেন্দ্রীয় বিষয় হচ্ছে ক্ষমতায় যেতে হবে এবং ক্ষমতায় থাকতে হবে। উপজেলা নির্বাচন যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে দলীয় ভিত্তিতে হয় না, তা সত্ত্বেও এই নির্বাচনে ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির বিষয়টি স্থানীয় পর্যায়ে একদম পরিষ্কারভাবে নিয়ে যাওয়া হলো। এর ফলে শুধু প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেই নয়, যাঁরা স্থানীয়ভাবে নিজেদের যোগ্য মনে করেছেন, তাঁদের মধ্যেও ক্ষমতার একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতার প্রতিফলন আমরা দেখলাম। ব্যাপক সহিংসতা ও বহুমুখী অনিয়মের মধ্য দিয়ে সেটাই ফুটে উঠল।
এ ধরনের সহিংসতা, কারচুপি ও অনিয়ম প্রতিহত করার দায়িত্ব যাঁদের রয়েছে, তাঁরা পরিষ্কারভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁরা যথাযথ ভূমিকা পালন করেননি। তাঁরা যথাযথ ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছেন শুধু তাই নয়, তাঁরা যে তা করতে ব্যর্থ হয়েছেন, সেটাও অস্বীকার করেছেন। এবং এই অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে তাঁরা এগুলোকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। উপজেলা নির্বাচনের ভোট গ্রহণের চারটি পর্যায়ে সেটা ক্রমান্বয়ে আরও বেশি করে স্পষ্ট হয়েছে; চতুর্থ দফায় পরিষ্কার হয়েছে সবচেয়ে বেশি। যাদের ওপর দায়িত্ব রয়েছে, তাদের মধ্যে প্রথমেই রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার; বস্তুত নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় তারাই প্রধান কুশীলব।
উপজেলা নির্বাচন রাজনৈতিক দলভিত্তিক না হলেও অনানুষ্ঠানিকভাবে তাদের সমর্থনপুষ্ট প্রার্থীরা এবং তাদের কর্মী-সমর্থকেরাই পুরো প্রক্রিয়াটির প্রধান কুশীলব। সে কারণে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকাকে আমি নির্বাচন কমিশনের ভূমিকারও আগে স্থান দিতে চাই। সেখানে সব রাজনৈতিক দল এবং দলের বাইরে থেকে যাঁরা অংশগ্রহণ করেছেন, তাঁদের সবারই কম-বেশি ভূমিকা ছিল। তবে গণমাধ্যম ও অন্যান্য সূত্রে যে চিত্র পাওয়া যাচ্ছে, তাতে ক্ষমতাসীন দলের ভূমিকা ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সেটার কারণে অনেক সময় প্রতিপক্ষ বা অন্য পক্ষগুলো বেপরোয়া হয়েছে, সহিংসতায় জড়িয়ে পড়েছে; যারা যেখানে পেরেছে নিজেরাও কারচুপি ও বলপ্রয়োগের চেষ্টা করেছে এবং দোষটা ক্ষমতাসীন দলের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। এখানে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে ক্ষমতাসীন দল এবং সেটার সুযোগ নিয়ে আবার অন্য পক্ষগুলো একই ধরনের সহিংসতা ও কারচুপিতে জড়িয়ে পড়েছে।
দ্বিতীয়ত আসে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা। বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশন কিন্তু একটা সুপ্রতিষ্ঠিত প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি হিসেবে আগের তুলনায় অনেক সবল হয়েছিল বলে আমাদের ধারণা ছিল। এর নেতৃত্বের মধ্যেও একধরনের দৃঢ়তা, প্রভাবমুক্ত হয়ে বস্তুনিষ্ঠভাবে কাজ করার যোগ্যতা দেখা গিয়েছিল। দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এর আগের নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে যে ধারাটি সৃষ্টি হয়েছিল, বর্তমান নির্বাচন কমিশন কিন্তু সেই ধারাটি বজায় রাখতে পারেনি। উপজেলা নির্বাচনের ক্ষেত্রে শুরু থেকেই তারা ব্যর্থতা দেখিয়েছে। এমনকি নিজেদের শক্তি-সামর্থ্যও তারা কর্তন করার চেষ্টা করেছে। সেগুলো ব্যাপক আলোচনার বিষয়, এখন সেদিকে যাব না। কিন্তু তা সত্ত্বেও সাধারণ নাগরিক হিসেবে এমন প্রত্যাশা ছিল যে প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে তাদের কিছুটা ব্যর্থতা হয়তো থাকবে, কিন্তু সেই ব্যর্থতা যে এত ব্যাপক মাত্রায় হবে, এটা কিন্তু যেকোনো সাধারণ নাগরিকের কাছে হতবাক হওয়ার মতো একটা ব্যাপার। নির্বাচন কমিশনের কাছে কিন্তু যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থাকে, যা কাজে লাগিয়ে এ ধরনের সহিংসতা ও অনিয়ম প্রতিরোধ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। অন্তত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার পরিকল্পনা করা যায়। কিন্তু সেটার ওপর ভিত্তি করে তারা কোনো চিন্তাভাবনা ও পরিকল্পনা করেছে কি না বা স্থানীয় পর্যায়ে কোনো ধরনের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিয়েছিল কি না, সেটার কোনো সুনির্দিষ্ট দৃষ্টান্ত এই চারটি দফায় আমরা দেখতে পাইনি।
এ ছাড়া নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, এমনকি সেনাবাহিনীও নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের কৌশলগতভাবে ব্যবহার করা হয়েছে বলে আমরা দেখতে পাইনি। তা যদি করা হতো, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হতো, তাহলে যে সহিংসতা, কারচুপি ও অন্যান্য অনিয়ম হয়েছে, তা হতে পারত না। অন্তত এত ব্যাপক মাত্রায় হতে পারত না। এই যে নির্বাচন কমিশন সহিংসতা ও কারচুপি প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়েছে, সেটাকে তারা কোনো পর্যায়েই আমলে নেয়নি। বরং প্রতিটি পর্যায়ের নির্বাচন শেষে বলে এসেছে যে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে; তারা একধরনের সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। এমনকি এমন ধরনের বক্তব্য তারা দিয়েছে, যেটাকে এই সব সহিংসতা, কারচুপি ও অনিয়মকে প্রশ্রয় দেওয়ার নামান্তর বলা যায়। যারা এসব করেছে, নির্বাচন কমিশন তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে আগেরবারের দৃষ্টান্ত দেখে পরেরবার আরও বেশি মাত্রায় সহিংসতা ও কারচুপি করতে লোকজন উৎসাহিত হয়েছে। সে কারণেই আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রতিটি পর্যায়ে সহিংসতা ও কারচুপির মাত্রা বেড়েই চলেছে।
স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবারই প্রথম একাধারে কয়েকটি পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আমি মনে করি, এ সিদ্ধান্ত বেশ ভালো। সারা দেশে এতগুলো নির্বাচন একসঙ্গে করার চেয়ে পর্যায়ক্রমে করাই উত্তম, যেমনটি ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হয়ে থাকে। প্রথম দফার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর ভুলভ্রান্তিগুলো বিশ্লেষণ করে পরবর্তী ধাপে সেগুলো শোধরানোর চেষ্টা করা যেত। কিন্তু এই পদ্ধতির ইতিবাচক ব্যবহার করা হলো না। বরং এমন একটা ধারণা বা জিজ্ঞাসার সৃষ্টি হলো যে প্রথম পর্যায়ের ফল দেখে দ্বিতীয় পর্যায়ে নিজেরা কী ধরনের ভূমিকা নির্ধারণ করবেন, সেই চিন্তা কাজ করেছে কি না। অর্থাৎ, এটা ক্ষমতাসীনদের নিজেদের পক্ষে ফল অর্জনের একটা কৌশল কি না—এমন প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠতে পারে। নির্বাচন কমিশন কিন্তু আরেকটি কাজ করতে পারত, প্রতিটি পর্যায়ের ভোট গ্রহণের পর ফল প্রকাশ না করে সব দফার নির্বাচন শেষে একসঙ্গে ফল প্রকাশ করতে পারত। তাহলে হয়তো এতটা সহিংসতা হতো না।
এই উপজেলা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচনী ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠানের ওপর জনগণের আস্থা হ্রাস পেল। এটি গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার পথে পিছিয়ে যাওয়ার লক্ষণ। এর দায় নিতে হবে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলকে, কারণ তারা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রধান শক্তি। নির্বাচনী ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠানের ওপর জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে, সে দায়িত্ব মূলত প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের। কীভাবে তা ফিরে আসতে পারে, এই চিন্তাটাও তাদের নিজেদেরই করতে হবে। কারণ, রাজনৈতিক অঙ্গনে এ ধরনের ব্যর্থতার কারণেই গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে; সুস্থ রাজনীতির বিপরীত শক্তি, অগণতান্ত্রিক শক্তির বিকাশ ঘটছে। কিন্তু গণতন্ত্রের বিকল্প তো কিছু নেই; গণতন্ত্রের একমাত্র বিকল্প হলো উন্নত স্তরের গণতন্ত্র। সেই উন্নত স্তরের গণতন্ত্রের দিকে যেতে হলে এই আচরণগত দিকগুলো পরিবর্তন করতে হবে। সে জন্য আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকেই অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে; তারপর নির্বাচন কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর সামর্থ্য বাড়াতে হবে, তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে পুরো ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা ফিরে আসে।

ইফতেখারুজ্জামান: নির্বাহী পরিচালক, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।