সিনেমা ও মঞ্চের শিল্পীরাই মমতার ভরসা?

এবারের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক চরিত্রের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন সিনেমা ও মঞ্চের শিল্পীরা। টালিউডের শিল্পীরা আগেও দু-একবার নির্বাচনে লড়ে দিল্লি গেছেন। যেমন, তৃণমূল কংগ্রেসের হয়ে টালিউডের দুই শিল্পী তাপস পাল ও শতাব্দী রায় ২০০৯ সালে লোকসভা ভোটে দাঁড়িয়ে জিতেছিলেন। এবারও তাঁরা লড়ছেন। তবে শুধু তাঁদেরই নয়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আরেক ধাপ এগিয়ে একঝাঁক শিল্পী-অভিনেতাকে ভোটে প্রার্থী করেছেন। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত মুখ টালিউডের জনপ্রিয় নায়ক দেব, যাঁর অভিনীত চাঁদের পাহাড় থেকে শুরু করে অনেক সিনেমাই বক্স অফিসে সাড়া জাগিয়েছে। এ ছাড়া রয়েছেন বিগত দিনের অভিনেত্রী সন্ধ্যা রায়, মুনমুন সেন, ভূমি ব্যান্ডের মূল গায়ক সৌমিত্র, জনপ্রিয় গায়ক ইন্দ্রনীল সেন এবং নাট্যজগতের পরিচিত মুখ অর্পিতা ঘোষ। এই নবাগতদের মধ্যে একমাত্র অর্পিতা ঘোষকেই কয়েক বছর ধরেই তৃণমূল কংগ্রেসের হয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকায় দেখা গেছে। আর বাকিদের কাউকে কাউকে মাঝেমধ্যে কলকাতার বিভিন্ন সরকারি অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে দেখা গেলেও রাজনীতিতে তাঁদের আগে দেখা যায়নি।
বিজেপির তরফেও এবার অন্তত এমন দুজনকে ভোটে দাঁড় করানো হয়েছে, যাঁরা বিনোদন জগতের পরিচিত মুখ। একজন জাদুকর পি সি সরকার (জুনিয়র), অন্যজন মুম্বাই চলচ্চিত্র জগতের পরিচিত প্লেব্যাক সিঙ্গার বাবুল সুপ্রিয়। এ ছাড়া তৃণমূল কংগ্রেসের হয়ে সদ্য রাজ্যসভার সদস্য হওয়া মিঠুন চক্রবর্তীও নির্বাচনী প্রচারে এসে জোরকদমে মমতার প্রার্থীদের হয়ে কাজ করছেন। তৃণমূল কংগ্রেসের সেলিব্রিটি প্রার্থীদের হয়ে এবারই প্রথম প্রচারে নামছেন টালিউডের শিল্পী-কলাকুশলীরা, যেটা আগে কখনো দেখা যায়নি। এ ছাড়া দার্জিলিং আসনে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী করেছে ভারতীয় ফুটবলের সাবেক আইকন বাইচুং ভুটিয়াকে, হাওড়ায় আরেক সাবেক ফুটবলার প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সব মিলিয়ে এবারের লোকসভা নির্বাচনে রাজনৈতিক প্রার্থীদের ছাপিয়ে সিনেমা, বিনোদন ও ক্রীড়াজগতের প্রার্থীরাই প্রচারের আলো কেড়ে নিয়েছেন।
তামিলনাড়ুতে এম ডি রামচন্দ্রন ও করুণানিধির হাত ধরে চলচ্চিত্রজগতের মানুষেরা অনেক আগেই, সেই সত্তরের দশকে রাজনীতিতে এসেছেন। আশির দশকের গোড়ায় অন্ধ্র প্রদেশে তেলেগু সিনেমার প্রবাদপ্রতিম নায়ক এন টি রামরাও রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। কিন্তু সেসবই ছিল আঞ্চলিক দলগুলোর ব্যাপার। সর্বভারতীয় দলগুলো তখনো এ নিয়ে মাথা ঘামাত না। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধী হত্যার পরে যে নির্বাচন হয়, সেবারই প্রথম কংগ্রেস লোকসভায় প্রার্থী হিসেবে চিত্রতারকাদের আনে। অমিতাভ বচ্চন, সুনীল দত্ত, বৈজয়ন্তীমালারা সেবারই প্রথম লোকসভায় নির্বাচিত হন। বিজেপিও আর পিছিয়ে থাকেনি। কংগ্রেসের দেখাদেখি তারাও শত্রুঘ্ন সিনহা, হেমা মালিনী, ধর্মেন্দ্র, বিনোদ খান্নাদের প্রার্থী করতে শুরু করে। গোড়ায় তেলেগু দেশমের টিকিটে সংসদে ঢুকলেও আরেক নায়িকা জয়া প্রদা পরে দল পাল্টে উত্তর প্রদেশে সমাজবাদী পার্টিতে যোগ দিয়ে সেখান থেকে নির্বাচিত হন। এবারও তিনি লড়ছেন।
পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলো এত দিন চিত্রতারকাদের ছোঁয়া বাঁচিয়েই নির্বাচন লড়ত। সিপিএম বড়জোর ভোটের আগে তাদের অনুগামী শিল্পীদের দিয়ে দলীয় প্রার্থীদের ভোট দেওয়ার আবেদন প্রচার করত। বিধানসভায় আগে যে দু-তিনজন শিল্পীকে সিপিএম প্রার্থী করেছিল, তাঁরা শিল্পী হিসেবে যতটা, তার চেয়ে বেশি সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। যেমন, অনিল চ্যাটার্জি, বিপ্লব চ্যাটার্জি, অনুপ কুমার প্রমুখ। মুখমন্ত্রী থাকাকালীন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য শিল্পী-সাহিত্যিকদের সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠভাবে মিশতেন। তাঁর আমলেই বাংলা কবিতা ও গানকে কেন্দ্র করে সম্পূর্ণ সরকারি আর্থিক আনুকূল্যে আলাদা করে কবিতা উৎসব ও বাংলা গানের উৎসব শুরু হয়। ক্রমে বাংলার শিল্পী ও বুদ্ধিজীবী সমাজের একটা বড় অংশই বামপন্থীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়। এমনকি ২০১১ সালে চরম বিপর্যয়ের সময়েও ভোটের আগে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে শিল্পীদের বৈঠকে দেখেছিলাম প্রায় সব নামীদামি শিল্পীকেই। এখন তাঁরা অনেকেই শিবির পাল্টেছেন। দুই দিন আগে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে সে রকমই একটি বৈঠকে অনেকেই গরহাজির। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো হাতে গোনা কয়েকজন সঙ্গে থাকলেও বেশির ভাগই মমতার শিবিরে। আর মমতা তাঁদের সন্তুষ্ট রাখতে বঙ্গশ্রী, বঙ্গভূষণ ইত্যাদি পুরস্কার চালু করেছেন।
তৃণমূল কংগ্রেসের মতো এত বেশি করে অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের, বিশেষ করে বিনোদন জগতের লোকজনকে কখনোই পশ্চিমবঙ্গ থেকে লোকসভায় প্রার্থী দাঁড় করাতে দেখা যায়নি। ফলে, প্রশ্ন উঠছে, দলে অনেক রাজনৈতিক কর্মী থাকতেও কেন মমতা বেছে বেছে বিনোদন জগতের লোকদেরই প্রার্থী করছেন। তাঁরা জেতার পরে এলাকার মানুষের জন্য কাজ করবেন তো? এ নিয়ে মমতা একাধিকবার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর যুক্তি, রাজ্যের মানুষের জন্য কাজ যা করার, সে জন্য তো তিনি নিজেই রয়েছেন। অতএব তাঁরা কাজ করবেন কি না, তা নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলে। কিন্তু সমস্যা হলো, মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে রাজ্যের বিস্তীর্ণ এলাকার লোকজন তাঁদের সমস্যার কথা বলার জন্য হাতের কাছে পাবেন কী করে? তাই মমতার এই ব্যাখ্যায় তাঁরা সন্তুষ্ট নন। মমতার দলে তাঁর ঘনিষ্ঠজনের ব্যাখ্যা, মমতা সচেতনভাবেই রাজনীতিতে অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়ে আসছেন। ভোটের লড়াইয়ে দেব বা অন্য তারকারা তাঁদের রুপালি পর্দার জনপ্রিয়তাকে টেনে এনে সহজেই জিতে যেতে পারেন। বরং এবার যে নতুন প্রজন্মের ভোটার প্রথমবার ভোট দেবেন (মোট ভোটদাতার অন্তত ১০ শতাংশ নবাগত), তাঁদের কাছে টানা এটা একটা সহজ রাস্তা। সেটা যে হচ্ছে, তা দেবের প্রচারে উপচে পড়া ভিড় দেখেই আন্দাজ পাওয়া যাচ্ছে। আবার মুনমুন সেন বাঁকুড়ায় নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে পুরোটাই
দুই নারীর বন্দনায় কাটিয়ে দিচ্ছেন। প্রথমজন অবশ্যই তাঁর মা, সদ্যপ্রয়াত কিংবদন্তি নায়িকা সুচিত্রা সেন, দ্বিতীয়জন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দর্শকেরাও সেটা ভালোভাবেই নিচ্ছেন। ফলে, টানা আটবার বাঁকুড়া কেন্দ্রে জয়ী প্রবীণ রাজনীতিক সিপিএমের বাসুদেব আচার্যকে এবার কঠিন লড়াই লড়তে হচ্ছে মুনমুন সেন ছাড়াও সুচিত্রা সেনের ভাবমূর্তির বিরুদ্ধে। অন্যদিকে, ভূমির সৌমিত্র ও ইন্দ্রনীল সেনও প্রচারে নেমে গান গেয়ে ভোটদাতাদের মনোরঞ্জন করে চলেছেন। এককথায়, ভোটযুদ্ধের আঙিনায় রাজনীতিকে ছাপিয়ে চলে আসছে অরাজনৈতিক প্রসঙ্গ।
আপাতদৃষ্টিতে রাজনীতির আঙিনায় এই বিনোদন জগতের অনুপ্রবেশকে হালকাভাবে দেখলেও এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অত্যন্ত সচেতনভাবেই এটা করছেন। কারণ, পশ্চিমবঙ্গে ২০০৯ সালের লোকসভায় ও ২০১১ সালের বিধানসভায় বামপন্থীদের শোচনীয় পরাজয়ের পর থেকে এ পর্যন্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার এমন কিছু কাজকর্ম করে দেখাতে পারেনি, যাতে তাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয় এবং নিজস্ব ভোটব্যাংক তৈরি হয়। মমতার এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক পুঁজি একটাই—সাধারণ ভোটদাতাদের মধ্যে বামপন্থীদের সম্পর্কে তীব্র বিতৃষ্ণা। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এটা প্রবল। এখনো মমতার যা কিছু জয়, তার মূলে রয়েছে এই সত্য। আর তা মমতা জানেন বলেই রাজনৈতিক লড়াইয়ে না নেমে সিনেমা, মঞ্চ ও ক্রীড়াজগতের একগুচ্ছ প্রার্থী দাঁড় করিয়ে গোটা নির্বাচনী লড়াইকেই একটা বৃহৎ বিনোদনের উৎসবে পরিণত করে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তাতে তাঁর সুবিধা এটাই, দলের নীতি, তা রূপায়ণে সাফল্য বা ব্যর্থতা, রাজ্যে বেড়ে চলা নারী নিগ্রহের ঘটনা, বা বিজেপি সম্পর্কে তাঁর মনোভাব, সব প্রশ্নই ঊহ্য রেখে বা পাশ কাটিয়ে যেতে পারছেন। এমনিতেই ২০০৯ সাল থেকে দলের নির্বাচনী ইশতেহারে মমতা পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের ভোটদাতাদের একটা স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছেন। সেই স্বপ্ন শুরু হয়েছিল কলকাতাকে লন্ডন, দিঘাকে গোয়া এবং দার্জিলিংকে সুইজারল্যান্ডে পরিণত করার আশ্বাস দিয়ে। পরে সেই স্বপ্নের তালিকায় আরও নতুন নতুন সংযোজন ঘটেছে। কিন্তু বাস্তবে পরিবর্তন কিছুই হয়নি; বরং সিপিএম শাসনের সময় যা কিছু খারাপ ছিল, সেই দলতন্ত্র ও দুর্নীতি আরও বেশি করে দেখা দিচ্ছে। সেই সঙ্গে রয়েছে সারদার মতো চিট ফান্ড কেলেঙ্কারিকে চাপা দেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা, যা করতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্টের ধমক খেতে হচ্ছে রাজ্য সরকারকে। এই অবস্থায় ভোটদাতাদের নজর অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য সিনেমা ও বিনোদন জগতের শিল্পীদের দলীয় প্রার্থী করাটা সুবিধাজনক। মমতা সেটাই করেছেন।

রজত রায়: ভারতীয় সাংবাদিক।