ভারতে মোদি-উন্মাদনা, বাইরে অস্বস্তি

নরেন্দ্র মোদি
নরেন্দ্র মোদি

জনমত জরিপে যে সব সময় সঠিক ইঙ্গিত বা পূর্বাভাস মেলে না, তার বড় প্রমাণ ভারত নিজেই। ২০০৯ এবং তারও আগে ২০০৪ সালে অধিকাংশ জরিপে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নির্বাচনী সাফল্যের পূর্বাভাস সঠিক হয়নি। এবারের নির্বাচনেও সব জরিপেই এগিয়ে আছেন বিজেপির নতুন নেতা নরেন্দ্র মোদি। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান, পিউ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের জরিপেও দেখা যাচ্ছে মি. মোদি প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রতিযোগিতায় ভালো ব্যবধানে এগিয়ে আছেন। তবে, তাঁর এই উত্থানের আশায় তাঁর সমর্থকেরা যতটা উন্মুখ, বিদেশিরা যে ঠিক ততটাই উৎসাহী, তা নয়। লন্ডন থেকে প্রকাশিত বৈশ্বিক সাময়িকী দি ইকোনমিস্ট তার চলতি সংখ্যায় ‘নরেন্দ্র মোদিকে কি কেউ ঠেকাতে পারবে?’ (ক্যান অ্যানিওয়ান স্টপ নরেন্দ্র মোদি?) প্রচ্ছদকাহিনিতে বলেছে যে ‘মি. মোদিই সম্ভবত ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। তবে, তার অর্থ এই নয় যে তাঁর তা হওয়া উচিত।’

সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদিকে বিজেপি বাছাই করার সিদ্ধান্তটি নিয়েছিল গত বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর। তার ঠিক সপ্তাহ দুয়েক পর, ৩০ সেপ্টেম্বর, বৈশ্বিক নীতিগবেষণাকেন্দ্র, ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্ট্রাটেজিক স্টাডিজ (আইআইএসএস) লন্ডনে এক সেমিনারের আয়োজন করে, যার বিষয়বস্তু ছিল ভারতে ভবিষ্যৎ বিজেপি সরকারের নীতি ও কর্মসূচি। বিজেপির ভবিষ্যৎ ভারতনীতি ব্যাখ্যা করতে সেদিন দিল্লি থেকে এসেছিলেন বিজেপির জাতীয় কোষাধ্যক্ষ এবং দলের প্রচার ও যোগাযোগ কমিটির প্রধান। লোকসভার সদস্য গোয়েল এর আগে বাজপেয়ি সরকারে জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ে উপ-উপদেষ্টাও ছিলেন। মোদির বাণিজ্যবান্ধব নীতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বিভিন্ন দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন।

প্রশ্ন ওঠে পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে, বিশেষ করে বৃহৎ প্রতিবেশী চীনের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে। কেননা, ভারতের অরুণাচল রাজ্যের সীমানা নিয়ে ইতিমধ্যেই চীনের সঙ্গে উত্তেজনা সৃষ্টির ঘটনা ঘটেছে। আর, কট্টর জাতীয়তাবাদী হিসেবে বিজেপির যে পরিচিতি, তাতে ভারতের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান ছাড়াও অন্য প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে দেশটির ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতি নিয়ে উদ্বেগ থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। গোয়েল জানান যে ভারতের ভৌগোলিক অখণ্ডতার বিষয়টিতে তাঁর দল যেমন আপসহীন, তেমনি অর্থনৈতিক সহযোগিতার নীতিতেও তাঁরা অঙ্গীকারবদ্ধ। চীনের সঙ্গে ভারতের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যে উভয় দেশেরই যে লাভ, সে বিষয়ে তাঁরা খুবই সচেতন এবং চীনও মোদির নেতৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।

এর পর যুক্তরাজ্য ও ব্রিটেনসহ পাশ্চাত্যের দেশগুলোও আলামত বুঝতে পেরে সুর পাল্টেছে। ফোর্ড এবং জেনারেল মোটর্সের কারখানা প্রতিষ্ঠার পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করেছে। সেখানকার জনপ্রতিনিধিদের কয়েকজন মোদির ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পক্ষে প্রকাশ্যেই বক্তব্য দিয়েছেন। ব্রিটিশ রাজনীতিকেরাও এদিক দিয়ে পিছিয়ে নেই। ভারতের গুজরাটি বংশোদ্ভূতদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ব্রিটেনে ব্যবসা-বাণিজ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত। গুজরাটের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কোন্নয়নের অংশ হিসেবে সম্প্রতি আহমেদাবাদের সঙ্গে হিথ্রোর সরাসরি বিমান যোগাযোগ চালু হয়েছে।

ভারতের ভৌগোলিক প্রতিবেশীদের কথা এ ক্ষেত্রে একেবারেই আলাদা। ব্যক্তি বা দলের কারণে প্রতিবেশীদের সম্পর্কে সময়ে সময়ে হূদ্যতা যেমন বাড়তে পারে, তেমনি টানাপোড়েনও হতে পারে। নরেন্দ্র মোদির সম্ভাব্য উত্থান সেই আশঙ্কাকেই জোরদার করছে, অন্তত বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিজেপির বহুদিনের পুরোনো অভিযোগ হচ্ছে যে বাংলাদেশিরা অর্থনৈতিক কারণে ভারতে গিয়ে আশ্রয় গাড়ছে এবং এর ফলে ভারতের অর্থনীতিতে যেমন চাপ তৈরি হচ্ছে, তেমনি দেশটির সামাজিক-সাংস্কৃতিক চেহারাটাও পাল্টে যাচ্ছে। এবারের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিজেপির পক্ষ থেকে বিস্ময়কর অভিযোগটি করেছেন দলের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী, নরেন্দ্র মোদি। গত ৩১ মার্চ তিনি আসামের এক জনসভায় বলেছেন যে ‘বাংলাদেশি সেটেলারদের জায়গা করে দিতে ওই রাজ্যে গন্ডার ধ্বংস করার চক্রান্ত হচ্ছে।’ তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ১৬ মের পর ‘চুন চুন কি হিসাব লিয়া যায়েগা’ (এক এক করে হিসাব বুঝে নেওয়া হবে)। (সূত্র: ইন্ডিয়া টুডে, মার্চ ৩১, ২০১৪।) মোদি ওইটুকুতেই থামেননি। তিনি বলেছেন, ‘গন্ডার কি আসামের গর্ব নয়? বর্তমানে ওগুলোকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র চলছে। আমি খুব গুরুত্বের সঙ্গে এই অভিযোগ করছি। সরকারে (কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকার) যাঁরা আছেন, তাঁরা বাংলাদেশিদের রক্ষায় এই ষড়যন্ত্র করছেন।’

এবারের নির্বাচনী প্রচারণায় বিজেপির পক্ষ থেকে বাংলাদেশিদের কথিত অনুপ্রবেশ বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে অনেক আগে থেকেই। তবে, বাংলাদেশ থেকে দেশান্তরিত হওয়া মানুষজনের মধ্যে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের ফেরত না পাঠিয়ে তাদের পুনর্বাসনের নীতি বিজেপি অনুসরণ করবে বলে ঘোষণা করেছেন মোদি। ২২ ফেব্রুয়ারি আসামের শিলচরে এক জনসভায় তিনি বলেন, হিন্দু অভিবাসীদের আশ্রয়শিবির বন্ধ করে তাদের তাঁর সরকার পুনর্বাসন করবে (টাইমস অব ইন্ডিয়া, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪)। ভারতে এ ধরনের নীতি অনুসৃত হলে তা বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বিপদ কমাবে নাকি বাড়িয়ে দেবে, সে প্রশ্ন ওঠাটা অযৌক্তিক নয়।

ভারতে অবৈধ বাংলাদেশিদের অর্থনৈতিক অভিবাসনের অভিযোগ নতুন নয়। তবে, বিজেপি ক্ষমতায় থাকলে বিষয়টি নিয়ে রাজনীতি একটু বেশিই হয়ে থাকে। এর আগে, অটল বিহারি বাজপেয়ির নেতৃত্বে বিজেপি যখন ক্ষমতায় ছিল, সে সময় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একাধিক বক্তৃতা-বিবৃতিতে দাবি করেন যে ভারতে দুই কোটি (২০ মিলিয়ন) অবৈধ বাংলাদেশি বসবাস করছে। একাধিকবার দিল্লি ও মুম্বাইয়ে এই অবৈধদের ধরার জন্য অভিযানও পরিচালিত হয়। তারপর উভয় দেশের মধ্যে মাসের পর মাস চলতে থাকে পুশইন আর পুশব্যাকের পাল্টাপাল্টি ঠেলা। ২০০৩ সালের জুনে আদভানি এক সরকারি সফরে লন্ডনে আসেন এবং ভারতীয় হাইকমিশনে একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। বিবিসির হয়ে ওই সংবাদ সম্মেলনে আমি গিয়েছিলাম। তখন তাঁর কাছে দুই কোটি বাংলাদেশি অবৈধ অভিবাসীর হিসাবের ভিত্তি জানতে চাইলে তিনি শেষ পর্যন্ত স্বীকার করে নেন যে ওই অনুমান সম্ভবত সঠিক নয় এবং ২০ লাখ ভুলক্রমে ২০ মিলিয়ন বা দুই কোটি হয়ে থাকতে পারে।

অবৈধ বাংলাদেশিদের আশ্রয় দিতে গন্ডার উচ্ছেদের কথিত ষড়যন্ত্র সে রকম কোনো অঙ্ক কি না, বিজেপির নেতাদের কাছে বাংলাদেশ সেই ব্যাখ্যা হয়তো চাইতে পারত। কিন্তু, ছোট প্রতিবেশীর রাজনীতিতে বৃহৎ শক্তির জন্য নাক গলানো যত সহজ, তার উল্টোটা তা ততটাই কঠিন। বাংলাদেশের সঙ্গে অন্যান্য অনিষ্পন্ন বিষয়ে বিজেপি কতটা আগ্রহী হবে, তা-ও নিশ্চিত করে বলা কারও পক্ষে সম্ভব নয়।

বিজেপির নেতাদের বিভিন্ন বক্তৃতা-বিবৃতিতে তার যে আভাস মেলে, তা বাজপেয়ি আমলের নীতির মতোই হবে বলে অনেকের ধারণা। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে নাটকীয় কোনো পরিবর্তন আশা করার কোনো কারণ নেই। কাশ্মীর নিয়ে বিরোধ, সন্ত্রাসবাদে মদদ দেওয়ার অভিযোগ এবং আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় শিগগিরই কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই।

নরেন্দ্র মোদির উত্থানে দক্ষিণ এশিয়ায় যে বিষয়টির ঝুঁকি সবচেয়ে বাড়বে, তা হলো সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিস্তৃতি। এমনিতেই কয়েক দশক ধরে দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে সাম্প্রদায়িকতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো পাকিস্তান ও বাংলাদেশে এখন কিছুটা চাপের মুখে থাকলেও ভারতে হিন্দুত্ববাদী উগ্র গোষ্ঠীগুলোর উত্থান তাদের নতুন করে উজ্জীবিত করতে পারে। মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কায় কতিপয় উগ্র বৌদ্ধ গোষ্ঠীর কার্যক্রম ইতিমধ্যেই বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। ধর্মভিত্তিক ডানপন্থী রাজনীতির এই উত্থানের সম্ভাবনায় তাই অনেকেই উদ্বিগ্ন। ভারতের সাড়ে ৮১ কোটি ভোটারের মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ হচ্ছে তরুণ। আর, পিউ রিসার্চের জরিপে দেখা যাচ্ছে, ত্রিশের নিচে বয়স এমন তরুণদেরও সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ নরেন্দ্র মোদিকেই ভারতের আধুনিকায়নের রূপকার হিসেবে ভাবছে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতেও যে উন্নয়ন সম্ভব, মোল্লাতান্ত্রিক ইরান তার প্রমাণ। কিন্তু, সেই উন্নয়নকে কোনোভাবেই আধুনিকতার সমার্থক বলা যায় না। গুজরাটে ২০০২ সালের দাঙ্গায় সহস্রাধিক মুসলমানের প্রাণহানির ঘটনায় প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা, মুসলমানদের আতঙ্ক দূর করতে কোনো ধরনের অঙ্গীকার প্রদানে অস্বীকৃতি এবং মুসলিমবিরোধী ভোট দলে টানার কৌশলের জন্য মোদির সমালোচনা করে ইকোনমিস্ট লিখেছে, যাঁরা এখন তাঁর প্রশংসা করছেন, তাঁরাও জানেন না তিনি শেষ পর্যন্ত কী করবেন এবং মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়া কী হবে। ইকোনমিস্ট আরও বলছে, এ কারণেই তারা ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদে মোদিকে সমর্থন করতে পারছে না। তবে, জনমত জরিপগুলো ভুল না হলে ভারত যে পথে এগোচ্ছে, তাতে পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্প্রদায়িক অস্থিরতার অজানা আশঙ্কা বাড়বে বৈ কমবে না।

কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি, লন্ডন।