প্রশাসনের গায়ে রাজনীতির জামা

রাজনৈতিক দল গঠন ও পরিচালনা রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদেরই কাজ। দলগুলোর কর্মসূচি থাকে। তারা সরকার গঠন করলে এসব কর্মসূচি বিধিসম্মতভাবে বাস্তবায়নের দায়িত্ব মূলত প্রশাসনের। সরকারে সাধারণ তত্ত্বাবধানে প্রশাসনব্যবস্থা পরিচালনাও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদেরই কাজ। কিন্তু হাল আমলে দেখা গেছে, ক্ষেত্রবিশেষে একজনের কাজ করছেন আরেকজন। কখনো সমঝোতায়। আর কখনো বা তাঁদের সীমা অতিক্রম করে। যেমন, দিন কয়েক আগে সংবাদপত্রের প্রধান শিরোনাম হলো, ‘প্রশাসননির্ভর আওয়ামী লীগ’। কিছু তথ্য ও মতামতসংবলিত সে সংবাদটি
মূলত দেশের শাসক দলটির প্রশাসননির্ভরতা নিয়ে। উল্লেখ রয়েছে, মাঠপর্যায়ে দলটির ভিত দুর্বল। তাই দলীয় কাজে আবশ্যক হচ্ছে প্রশাসনের সহায়তা। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে এ ধরনের ‘সহায়তা’ গ্রহণের পরিসর আরও ব্যাপক হয়।
সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন, বিদ্রোহী প্রার্থীকে বসিয়ে দেওয়া, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মোকাবিলায় গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করা হয়েছে। গত ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালেও প্রতিপক্ষকে মোকাবিলায় দলটি অসহায় ছিল। তাদের নিরাপত্তার বিধান করতে হয়েছে প্রশাসনকে। জাতীয় পার্টির (জাপা) ভিন্নমুখী ভূমিকার মুখে এ ধরনের সংস্থাকেই করা হয়েছিল ব্যবহার। সংবাদটিতে উল্লেখ রয়েছে যে ক্ষমতায় যাওয়ার পর দলের মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের একটি অংশ সাংগঠনিক কাজ উপেক্ষা করে যেকোনো উপায়ে টাকাপয়সা উপার্জনে ব্যস্ত রয়েছে। ফলে দলের কাঠামো হয়ে পড়েছে দুর্বল। অবশ্য একই সংবাদে দলের মতামত হিসেবে উল্লেখ রয়েছে যে এ ধরনের মূল্যায়ন যথার্থ নয়। তদুপরি তারা প্রশাসননির্ভরও নয়। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। গেল সংসদ নির্বাচন আর উপজেলা পরিষদের নির্বাচন আমরা দেখলাম। এগুলো দেখার পর উপলব্ধি জোরদার হয় যে বিশ্লেষণটি যৌক্তিক।
৬৫ বছরে রাজনৈতিক ঐতিহ্য নিয়ে চলমান রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত দলটির প্রশাসননির্ভরতা দুঃখজনক। দলটির প্রতিষ্ঠা ক্ষমতার বাইরে থেকে। শুরু থেকে জেল-জুলুমের ভয় উপেক্ষা করে একদল ত্যাগী নেতা-কর্মী ছিলেন এর পেছনে। দল গঠিত হওয়ার পর তাঁরা অতীতেও সরকার চালিয়েছেন। তবে দল চালানোর জন্য তেমন আবশ্যক হয়নি প্রশাসনের। অথচ ২০০৯ সালে ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে দলটি ক্ষমতায় এসে হঠাৎ প্রশাসননির্ভর হয়ে পড়ে। লক্ষণীয় যে স্থানীয় পর্যায়ে নেতা-কর্মীরা সাংগঠনিক কাজে না থাকলেও বসে নেই। বরং প্রশাসনের কিছু কাজ করতে অতি তৎপর হয়ে পড়েছেন। সরকারি হাইস্কুলে ভর্তি কে হবে, থানায় মামলা নেওয়া হবে কি না আর আসামিই বা কারা হবে, টেন্ডারে কাজ পাবে কে কিংবা স্থানীয় পর্যায়ে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ কাদের দেওয়া হবে—এসব সিদ্ধান্ত-প্রক্রিয়ায় অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা মূল ভূমিকায়।
একটি রাজনৈতিক দল প্রশাসননির্ভর হতে পারে শুধু ক্ষমতায় থাকলে। অবশ্যই তা ক্ষমতার অপব্যবহার করে। রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিজেদের দলীয় কাজে অনৈতিকভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে। এটা করতে গিয়ে দলটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়ায় কমে যায় নেতা-কর্মীদের সম্পৃক্ততা। রাজনৈতিকভাবে প্রতিপক্ষকে মোকাবিলার মনোবল হারিয়ে ফেলে। সৃষ্টি হয় সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা ও অব্যবস্থাপনা। ফলে যাঁরা ক্ষমতার ভাগ পান কিংবা যাঁদের থাকে টাকা কামানোর সুযোগ, তাঁরা ছাড়া অন্য নেতা-কর্মীরা ক্রমান্বয়ে দলের প্রতি নিরুৎসাহী হয়ে পড়েন। ভালো ভালো নেতা-কর্মী বনে যান নেহাত সমর্থক।
ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলের প্রশাসননির্ভরতা তাদের দলের মধ্যে এ ধরনের অব্যবস্থাপনার পাশাপাশি রাষ্ট্রযন্ত্রে বহুমাত্রিক সমস্যা ডেকে আনে। আমরা ইতিমধ্যে এ ধরনের সমস্যাদির মুখোমুখি হতে শুরু করেছি। যারা সুবোধ বালকের ন্যায় একটি রাজনৈতিক দলের এ ধরনের চাহিদা পূরণ করে, তাদের একটি অংশ যুদ্ধ শেষের প্রাপ্য কড়ায়-গন্ডায় আদায় করে। আর প্রায় ক্ষেত্রে চক্রবৃদ্ধি সুদসমেত। এ ধরনের কর্মকর্তারা পদোন্নতি, পদায়নে নিতে থাকেন অন্যায্য সুযোগ। সে সুযোগ নিতে গিয়ে ক্ষেত্রবিশেষে বঞ্চিত করেন তাঁদের জ্যেষ্ঠ, দক্ষ ও মেধাবী সহকর্মীদের। যোগ্যতার ঘাটতির মাশুল দেয় জাতি। আর দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে পরিস্থিতি ক্রমাবনতিশীল। উল্লেখ করতে হয়, এ প্রবণতা আর কার্যক্রম শুধু বর্তমান সরকারের সময়েই নয়, গত দুই যুগের অধিক চলছে। মাঝে ছিল সামান্য বিরতি। মাত্রার হেরফের থাকতে পারে। কিন্তু গতি-প্রকৃতি এক। তবে সাম্প্রতিক কালে রাজনীতির প্রশাসননির্ভরতা সমস্যাটিকে প্রকটতর করেছে।
সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে দুর্নীতির একটি প্রবণতা থাকে। আমাদের মতো দেশে তা থাকে একটি বেশি মাত্রাতেই। তবে শাসনব্যবস্থা কার্যকর থাকলে দুর্নীতিবাজদের কেউ কেউ শনাক্ত হন। হয় বিচার। তাই তাঁদের থাকতে হয় সাবধানে। রাখঢাক থাকে কিছু ক্ষেত্রে। কিন্তু প্রশাসন আর রাজনীতি একাকার হয়ে যাওয়ার পর এসব রাখঢাক ভাবটি মনে হয় চলেই গেছে। ফৌজদারি অপরাধে দায়ের করা কয়েক হাজার মামলা থেকে দলীয় বিবেচনায় নেতা-কর্মীদের মুক্তির ন্যায় একশ্রেণীর কর্মকর্তাও অপরাধ করে দায়মুক্তি পেয়ে চলছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে খবর হয় প্রায়ই। ব্যবস্থা নেওয়ার ভাবও দেখানো হয়। তবে আইন চলে অতি ধীরগতিতে। আবার একসময়ে সবার অজান্তে তা থেমেও যায়। আর দিনের পর দিন চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটার দেশটিতে মানুষও একটি ভুলে নতুন চমক সৃষ্টিকারী খবরের দিকে ঝুঁকে পড়ে।
এ ধরনের দু-তিনটি ঘটনার সম্পর্কে সামান্য আলোকপাতের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। একটি খবরের শিরোনাম, ‘ক্রেস্টের স্বর্ণের ১২ আনাই মিছে!’। কারও নজর এড়ানোর কথা নয় খবরটির। মহান মুক্তিযুদ্ধে যেসব বিদেশি ব্যক্তি বা সংগঠন আমাদের পক্ষে অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন, তাঁদের সম্মাননা পদকে সোনার ঘাটতি সম্পর্কে উপরিউক্ত শিরোনাম। খবরে আরও উল্লেখ রয়েছে, ৬০টি পদকে স্বর্ণের স্থান দখল করেছে পিতল, তামা ও দস্তা। তৃতীয় পর্বের ৬০টি পদক বিএসটিআই নমুনা যাচাই করে ২০১২ সালে প্রতিবেদন দিয়েছিল। অন্য পদকগুলোর মান জানা যায়নি। তবে ভিন্নতর কিছু হওয়ার কথা নয়। আর এ মান জেনেও বিষয়টিকে গোপন রেখে পদক দিয়ে দেওয়া হয়। দেড় বছরেও নেওয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থা। খবরটি প্রকাশের পর একটি তদন্ত কমিটি হয়েছে। প্রশাসননির্ভর দলটির সরকারকে প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা এভাবে ঝরঝরে করে ফেলছেন, বললে কি বেশি বলা হবে? প্রশাসননির্ভর না হলে তাঁরা হয়তো বা এতটা দুঃসাহসী হতেন না।
আরেকটি খবরের শিরোনাম, ‘সোনা চোরাচালানে পুলিশ জড়িত’। এ তথ্য জানা গেছে সোনা চোরাচালানকারী দলের একজন সদস্য গ্রেপ্তারের পর তাঁর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি থেকে। এ ধরনের জবানবন্দি কারও অপরাধ চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করে না, এটা সত্য। তবে পুলিশের কিছু সদস্য চোরাচালান কাজে আগে থেকেই জড়িত থাকার বিভিন্ন খবর আসছিল। আর ইদানীং তা আসছে অনেক বড় হয়ে। চোরাচালানিদের কাছ থেকে আটক করা সোনার বড় একটি অংশ আত্মসাৎ-প্রচেষ্টায় পুলিশের তিন সদস্য আপাতত কারাগারে। তদন্ত আর বিচারে কী হয়, এটা দেখার অপেক্ষায় রয়েছেন অনেকে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতাদের দলীয় কাজে অতিরিক্ত পুলিশনির্ভরতা তাদের ক্রমান্বয়ে অপরাধমূলক কাজ করতে দুঃসাহসী করে তুলছে। তাদের ভূমিকায় সরকারের ভাবমূর্তি একইভাবে মলিন হচ্ছে।
ইউরোপের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ দেশে আমাদের দূতাবাসে নিয়োগ, গাড়ি মেরামতসহ বিভিন্ন কাজে মোটা অঙ্কের ব্যয়ে অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ এসেছে সরকারি অডিটে। সে কর্মকর্তা বর্তমানে অন্যত্র বদলির আজ্ঞাধীন। এর আগে তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে থাকতেও একই ধরনের আর্থিক অনিয়ম করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে অনেকটা দলীয় আনুগত্যের জোরেই গুরুত্বপূর্ণ পদে দ্রুত আরোহণ আর অবস্থান করতে পেরেছেন। তবে শেষরক্ষা হয়নি ভিন্ন রাজনৈতিক ব্যর্থতার জন্য। সেটা উতরাতে পারলে এসব অনিয়ম নিয়ে কেউ হয়তো বা উচ্চারণও করত না।
এ ধরনের ঘটনাগুলো কিন্তু হিমশৈলীর চূড়াবিশেষ। বিশালকায় হিমশৈলী রয়েছে পানির একটু নিচেই। আর এক শতাব্দী আগে এ ধরনের একটি হিমশৈলীর আঘাতেই টাইটানিকের মতো যাত্রীবাহী বড় জাহাজ ডুবে গিয়ে মানব ইতিহাসে এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল। ইতিহাস হলেও আজ এটা থেকে শিক্ষা নেয় অনেকেই। আমরা কিন্তু পারছি না তা করতে। প্রশাসন কর্মকর্তাদের আশকারা দিয়ে দলীয় কাজ করালে তাঁরাও বিনিময়ে আখের গোছাতে নেমে পড়বেন ভয়ভীতি ছাড়া। পরিণামে জনগণের কাছে দায়ী হবে শুধু সরকার। আরও বিপর্যস্ত হবে প্রশাসনব্যবস্থা।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
[email protected]