সরকার ও মালিকপক্ষ কেউ কথা রাখেনি

স্বজনের ফিরে আসার অপেক্ষায়
স্বজনের ফিরে আসার অপেক্ষায়

এক বছর আগে রানা প্লাজার ভয়াবহ ধস ও হত্যাকাণ্ডের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত আমাদের মধ্যে ছিল তাজরীনের ক্ষত। পুড়ে মৃত-অর্ধমৃত মানুষেরা অমানবিক জগতের চিহ্ন হিসেবে তখন তাড়া করছিল সবাইকে। দায়ী মালিকসহ কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেই, ক্ষতিপূরণ সবার হাতে পৌঁছায়নি, অনেকের আর্তচিৎকার তখনো শুনতে হয়।
এ অবস্থার মধ্যেই রানা প্লাজা ধসে আমাদের সবাইকে ধসিয়ে দিল। বিশ্বরেকর্ড করল বাংলাদেশ! কারণ, শিল্প-কারখানার কয়েক শ বছরের ইতিহাসে কোনো কারখানাধসে এত মানুষের জীবনহানি কোথাও ঘটেনি। এখন পর্যন্ত জানামতে এই জীবন্ত কবরস্থ মানুষের সংখ্যা এক হাজার ১৩৫। এটা তো শুধু সংখ্যা নয়, শুধু এই মানুষেরাও নন; তাঁরা এতগুলো পরিবারের মানুষ। যে পরিবারগুলোর হাহাকার এখনো চলছেই। আরও আছেন নিখোঁজ ও জখম মানুষ। কারখানাগুলোয় যে হাজার পাঁচেক শ্রমিক কাজ করতেন, তাঁদের মধ্যে বেঁচে থাকা সবাই কাজ হারিয়েছেন। তাঁদের অনেকেই এখনো বেকার। বিজিএমইএ সবার কাজের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা তারা যথারীতি এখনো বাস্তবায়ন করেনি। এ বিষয়ে তাদের আর কোনো কথাও এখন শোনা যায় না।
তাজরীনের পর তো নয়ই, রানা প্লাজার যে বিপর্যয় সারা বিশ্বকেও কাঁপিয়ে দিয়েছে, তা কি আমাদের দেশের সরকার ও মালিকপক্ষের বোধোদয় ঘটাতে পেরেছে? তারা কি তাদের চিন্তা ও কাজের ধরনে কোনো পরিবর্তন এনেছে? গত এক বছরের ঘটনাবলি তা বলে না।
সরকার ও বিজিএমইএর বাইরে তাজরীন ও রানা প্লাজার ঘটনা এবং আহত-নিহত শ্রমিকদের নিয়ে একাধিক গবেষণা হয়েছে। নিহত, নিখোঁজ, জীবিত ব্যক্তিদের তালিকা করতে, তাঁদের অবস্থা তদারক করতে অনেক ব্যক্তি, শ্রমিক সংগঠন ও গবেষণা সংগঠন নিজ উদ্যোগে কাজ করেছে। সরকারের বা বিজিএমইএর কোনো সংগঠিত উদ্যোগ দেখা যায়নি।
অ্যাকটিভিস্ট অ্যানথ্রোফলজিস্ট নামের নৃবিজ্ঞানীদের ছোট একটি দল দুটি ছোট গার্মেন্টস শ্রমিক সংগঠনের সহায়তা নিয়ে তাজরীন ও রানা প্লাজার জীবিত শ্রমিক ও স্বজনদের পাশে থেকে তালিকা প্রস্তুত করেছে। আহতদের পাশে থেকেছে। আদালতের মাধ্যমে তাজরীনের মালিককে গ্রেপ্তার করতে সরকারকে বাধ্য করেছে তারা। ঘটনার এক বছর পর্যন্ত সরকার নিজে থেকে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ‘২৪ এপ্রিল’ নামে একটি গ্রুপ রানা প্লাজার সব তথ্য জনগণের অবগতির জন্য প্রস্তুত করেছে। ‘গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতি’ নিখোঁজ শ্রমিকদের অসম্পূর্ণ তালিকা প্রকাশ করেছে কিছুদিন আগে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি দল রানা প্লাজায় উদ্ধারকাজের পাশাপাশি নিহত ও আহতদের তালিকা প্রস্তুত করেছে, যা এখনো অনেক হিসাব-নিকাশে গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। এই ছোট ছোট গোষ্ঠীর আন্তরিক ও পরিশ্রমী কাজ দেখে এটা স্পষ্ট বোঝা যায় যে এসব গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য অর্থবল বা জনবল জরুরি নয়। অর্থবল আর জনবল যাদের আছে, সেই সরকার বা বিজিএমইএ এই কাজগুলো করেনি।
এখনো রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে হাড়গোড়-খুলি পাওয়া যাচ্ছে প্রায়ই। ঘেরাও করা ধ্বংসস্তূপের সামনে এখনো নীরবে অনেক স্বজন দাঁড়িয়ে থাকে। এটাই তাদের কাছে প্রিয়জনের শেষ ঠিকানা। অদৃশ্য হয়ে এখন সেই প্রিয়জন সর্বত্র ঘুরে বেড়ায়। নিখোঁজ শ্রমিকদের শনাক্তকরণ এক বছরেও পুরোপুরি শেষ হয়নি।
ডিএনএ টেস্ট করেও অনেকের স্বজনের মীমাংসা হয়নি। ডিএনএ টেস্ট নিয়ে একটা প্রশ্নের উত্তর আমি এখনো পাইনি। সাগর-রুনিকে হত্যার পর তদন্তের অংশ হিসেবে ডিএনএ টেস্ট করতে নমুনা পাঠানো হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে। তখন যুক্তি দেওয়া হয়েছিল যে বাংলাদেশে ডিএনএ টেস্ট নির্ভরযোগ্য নয়। এখন হাজার হাজার শ্রমিকের খোঁজে এখানেই টেস্ট করা হচ্ছে। তাহলে কোনটা সত্যি?
২০১৩ সালের মে মাসে প্রধানত ইউরোপীয় ব্র্যান্ড কোম্পানিগুলো, শ্রমিক সংগঠন ও সংস্থা মিলে অ্যাকর্ড নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে। এর কিছুদিন পর উত্তর আমেরিকাকেন্দ্রিক অ্যালায়েন্স নামে আরেকটি সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তারা তাদের পদ্ধতিতে ক্ষতিপূরণের কথা বলছে। বিভিন্ন কারখানার নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে তদন্ত করছে, সিদ্ধান্ত জানাচ্ছে। তাদের দেওয়া শর্ত পূরণ করতে গিয়ে সরকার কারখানা পরিদর্শক নিয়োগ করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। মালিকেরা ভবনের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। এসব কাজ তো তাঁদের অনেক আগেই করার কথা।
প্রশ্ন হলো, আন্তর্জাতিক চাপ ছাড়া কেন সরকার বা মালিকদের ঘুম ভাঙে না? কেন রানা প্লাজার ঘটনার দুই মাস পর ঘোষিত বাজেটে কারখানা পরিদর্শকদের নিয়োগ এবং উদ্ধার তৎপরতার সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বাজেট দেওয়া হয়নি? ক্ষতিপূরণের নীতিমালা কেন এখনো ঘোষিত হয়নি? কেন রানা প্লাজার নিহত শ্রমিকদের পরিবার এখনো ক্ষতিপূরণের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছে? কেন আহত শ্রমিকসহ বেকার শ্রমিকদের কাজ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি এখনো পূরণ হয়নি?
শ্রমিকদের নামে দেশ-বিদেশ থেকে বিপুল অর্থ জমা হয়েছে সরকার ও বিজিএমইএর কাছে, তারও কোনো স্বচ্ছ হিসাব নেই। প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে দেশ ও বিদেশ থেকে যে অর্থ জমেছে, সংসদে প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, তার পরিমাণ প্রায় ১২৮ কোটি টাকা। নিহত শ্রমিকদের পরিবারগুলোকে শুধু এই অর্থ ভাগ করে দিলেও মাথাপিছু ১০ লাখ টাকা করে দেওয়া সম্ভব। এর সঙ্গে ব্র্যান্ড, মালিক ও বিজিএমইএর অর্থ যোগ হলে সম্মানজনক ক্ষতিপূরণ দেওয়া সম্ভব। অথচ এখনো ক্ষতিপূরণের নীতিমালা বা এ-সংক্রান্ত কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি। এই প্রশ্ন তো তাই খুব সংগত যে সীমাহীন লোভ আর অবহেলার শিকার হয়ে যে শ্রমিকদের জীবন নাশ হলো অকালে, তাঁদের নামে তোলা টাকা কাদের পকেটে যাচ্ছে?
তদারকি ও অন্য যেসব গাফিলতির জন্য এই ভবনধস ঘটেছে, তারও সুরাহা করা হয়নি। কারখানা যদি ভুল স্থান ও ভুল ভবনে স্থাপিত হয়, যদি সেখানে মুনাফার সীমাহীন লোভে ব্যক্তি মালিক শ্রমিক নিরাপত্তার ন্যূনতম ব্যবস্থা না রাখে, তাহলে সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব সরকারেরই। এই কাজ না করলে শিল্প মন্ত্রণালয়, শ্রম মন্ত্রণালয় আছে কেন? দুর্যোগ মোকাবিলায় দমকল বাহিনীকে শক্তিশালী করার বড় পরিকল্পনা খুবই স্বাভাবিক ছিল, চলতি বাজেটে তারও প্রতিফলন নেই। সেখানেও অর্থের অভাবের যুক্তিই দেওয়া হয়। অথচ পোশাক মালিকদের জন্য বাড়তি সুবিধা দিতে কোনো বিলম্ব কিংবা কার্পণ্য করেনি সরকার। বাণিজ্যমন্ত্রী কয়েক দিন আগে মালিকদের জন্য অনেকগুলো ‘ইনসেনটিভ প্যাকেজ’ ঘোষণা করেছেন। শুধু উৎসে কর বাবদ যে সুবিধা দেওয়া হয়েছে, তাতেই জাতীয় রাজস্ব আয়

প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা কম হবে।
সবার কাজ নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি বিজিএমইএ ভঙ্গ করার কারণে যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের জীবন এখনো সুস্থির হতে পারেনি। জীবিত শ্রমিকদের মধ্যে অ্যাকশন এইড পরিচালিত এক জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, শ্রমিকদের শতকরা প্রায় ৭৪ জন এখনো কাজ পায়নি। শতকরা ৭৬ জনকে এখনো চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়। শতকরা ৬৬ জনের এখনো দিন চলার অবস্থা নেই। (ডেইলি স্টার, ২১ এপ্রিল, ২০১৪) এত শোরগোল ও অর্থের ছড়াছড়ির মধ্যে রানা প্লাজা ধসে আহত শ্রমিকের ক্ষুধা দারিদ্র্যের শিকার হয়ে মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
এরই মধ্যে গত বছরের নভেম্বরে মজুরির দাবি আর ছাঁটাই নির্যাতনের প্রতিবাদ করায় শিল্প-পুলিশের গুলিতে নিহত হলেন দুজন শ্রমিক। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, জখম হয়েছেন আরও অনেকে। রাতের গভীরে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমরা কি কখনো শুনেছি নির্যাতন, অবৈধ ছাঁটাই আর মজুরি বকেয়া রাখায় কোনো মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে এই শিল্প-পুলিশ? আর এখানেও মোতায়েন করা হয়েছে বিজিবি। নাম দেওয়া হয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, আর তাদের ব্যবহার করা হয়েছে শ্রমিক দমনে।
টিআইবির রিপোর্টে অনেকগুলো উদ্যোগ বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। তালিকা দেখলে দেখা যাবে, বাস্তবায়িত বিষয়গুলোর প্রায় সবই নীতি ও পরিকল্পনা (প্রথম আলো, ২২ এপ্রিল, ২০১৪)। শ্রম আইন সংশোধনকে শ্রম অধিকারের অগ্রগতি বলা হয়েছে। শ্রমিকদের স্বার্থের দিক থেকে দেখলে বরং এর উল্টোটাই সত্য। ক্ষতিপূরণ, কর্মসংস্থান, সরকারি প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা বৃদ্ধির মতো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
আমরা তো একই বিশ্বের মানুষ! কয়েক মাস আগে লাটভিয়ায় শপিং মল ধসে ৫০ জন মানুষ নিহত হয়েছে, সেই দেশের প্রেসিডেন্ট এ ঘটনাকে বলেছেন হত্যাকাণ্ড আর প্রধানমন্ত্রী এর দায় নিয়ে পদত্যাগ করেছেন! আর আমাদের দেশে রানা প্লাজায় ভবন ধসে এক হাজার ১৩৫ জন মানুষ নিহত হলেন, এখনো তাঁরা ‘ক্ষতিপূরণ’ কী পাবেন, তারই নিষ্পত্তি হলো না। এ দেশে এত তুচ্ছ মানুষের জীবন! এত উচ্চ লাটসাহেবদের খাই!

আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।