দৈবচয়নে প্রশ্নপত্র তৈরি হোক

আমাদের মতো সীমিত সম্পদের মাত্রাতিরিক্ত চাহিদার দেশে ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণাটি খুবই সময়োপযোগী। সম্পদের সর্বোত্তম সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে তথ্যপ্রযুক্তির বিকল্প নেই। তবে আমরা এই ধারণার প্রতি যে নিবেদিত, অঙ্গীকারবদ্ধ, তার প্রশ্নাতীত প্রমাণ নেই। সম্ভবত এ জন্যই কোনো কিছু ঠিকমতো না চললেই নিন্দুকেরা ডিজিটাল বলে টিপ্পনী কাটতে পছন্দ করে, যা নিশ্চয়ই ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অনুকূলে নয়।
তথ্যপ্রযুক্তির ধারাকে বেগবান করতে আমরা এই নামে মন্ত্রণালয় করেছি। তারপর ভাবলাম, যে বেগে অগ্রসর হওয়া উচিত তা নিশ্চয়ই মন্ত্রণালয় করতে পারবে না। এর জন্য প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন টাস্কফোর্স তৈরি হলো, যা কদাচিৎ সভা করতে বসে। আবার সেই টাস্কফোর্সের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য আইসিটি মন্ত্রণালয়কে যোগ্য মনে করা হলো না, তাই পরিকল্পনা কমিশনে সাপোর্ট টু আইসিটি টাস্কফোর্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান করা হলো। তারও আবার সাপোর্ট টু এস আইসিটি নামের সাহায্যকারী সংস্থা আছে।
শক্তিশালী একটি খুঁটিই যথেষ্ট আর হেলানো খুঁটি, যার নিজেরই অনেক সাপোর্ট দরকার তা অনেক হলেও হয় না, যার প্রমাণ হলো আমাদের তথ্যপ্রযুক্তিসংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ড। এ ছাড়া রয়েছে এ টু আই নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে এবং সরকারের কর্মকাণ্ডে জনগণের আস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। তবে এ টু আইয়ের বিশেষজ্ঞদের সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। সুতরাং আমরাও তাদের কর্মকাণ্ডে আস্থা স্থাপন করতে পারছি না। উপরন্তু নানা আন্তর্জাতিক রেটিংয়ে আমরা ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছি। শত শত কোটি টাকা ব্যয় করেও কোনো মানদণ্ডেই বিশ্ব তালিকায় সম্মানজনক স্থান পাওয়া যাচ্ছে না। তথ্যপ্রযুক্তির জুতসই ব্যবহারে মানুষের একটু স্বস্তি হোক, তার জন্য সবাই উন্মুখ হয়ে আছে।
যা হোক আজকের বিষয়, প্রশ্নপত্র ফাঁসের গোলক ধাঁধায় পড়েছে আমাদের দেশ, তা নিচু শ্রেণী থেকে উচ্চ শ্রেণী, এমনকি বিসিএস পরীক্ষা পর্যন্ত বিস্তৃত। ভর্তি পরীক্ষা তো ডাল-ভাত। এর ঋণাত্মক প্রভাব সর্বব্যাপী, তাই দ্রুত নিরসনের প্রয়োজন। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র যাতে ফাঁস না হয়, তার জন্য কর্তৃপক্ষ

নিঃসন্দেহে যথেষ্ট নিরাপত্তা দেয়ালের ব্যবস্থা করে। তবে দেয়াল যখন নিজেই ফাঁসের কাজটি করে, তখন আর পদ্ধতি কীভাবে তাকে বাধা দেবে? এ ছাড়া, আমরা যখন পরীক্ষায় প্রাপ্ত গ্রেডকে বিশ্বাস করতে পারি না তখন কোচিং সেন্টারগুলোকে বলির পাঁঠা বানাই। সুতরাং প্রশ্ন প্রণয়নে আমাদের আরও অনেক সম্পদের বিনিয়োগ ঘটাতে হবে। স্যাট এবং জিআরই পরীক্ষার মাধ্যমে সারা পৃথিবীর নানা বর্ণের, দেশের, সমাজের শ্রেষ্ঠ মেধাগুলোকে বাছাই করে আনা হচ্ছে আর আমরা আমাদের দেশের তরুণদের মেধা যাচাই করতে পারি না, বোর্ডের সর্বোচ্চ গ্রেড পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ৫৫ শতাংশ ফেল করে!
এখন ইন্টারনেট যোগাযোগ উপজেলাসহ অন্যান্য মফস্বল শহর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। সীমিত সম্পদের দেশে এই যে মূল্যবান ভৌত অবকাঠামো, তার বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করা উচিত। যেকোনো প্রশ্নপত্রের বিষয়ে নিচে একটি সহজ সমাধানের প্রস্তাব করছি।
প্রতিটি বিষয়ের পর্যাপ্তসংখ্যক প্রশ্ন অধ্যায়ভিত্তিক ইনডেক্স করে ডেটাবেইসে রাখতে হবে। প্রতিটি সেন্টারকে তাদের ইন্টারনেট সংযোগ, ছাপানো ও ফটোকপি করার সরঞ্জামাদির সক্ষমতা পরীক্ষার আগের রাতেই পরীক্ষা করা যেতে পারে। এবার পরীক্ষার দিন পরীক্ষার ৩০ মিনিট আগে একটি প্রোগ্রাম ব্যবহার করে দৈবচয়নে প্রশ্নপত্র তৈরি করে প্রতি সেন্টারের যোগ্য ব্যক্তিকে ই-মেইল করে পাঠানো হবে। ৩০ মিনিটের পরিবর্তে, অন্য কোনো গ্রহণযোগ্য সংখ্যাও হতে পারে। প্রতিটি সেন্টারে সেই প্রশ্নপত্র যথাযথ কর্তৃপক্ষের সামনে ছাপিয়ে ফটোকপি করা হবে। এর ফলে প্রশ্নপত্র ফাঁসের জন্য পর্যাপ্ত সময়ও থাকবে না। আর তা ছাড়া, দৈবচয়নের মাধ্যমে প্রশ্ন বাছাই করলে ছাত্ররা প্যাটার্ন আবিষ্কার করতে পারবে না এবং বাছাই করে পড়লে তার জরিমানা গুনতে হবে। এর ফলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যে ইন্টারনেট-সুবিধা ও অন্যান্য ভৌত অবকাঠামো প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, তার একটি ব্যবহার হবে।
এ ছাড়া, পরীক্ষাসংক্রান্ত নানা কাজে কম্পিউটারের জুতসই ব্যবহারের মাধ্যমে প্রচলিত ব্যবস্থার নানা ত্রুটি মোচন করা সম্ভব। আমার মনে হয়, সব রকম পরীক্ষার কাজে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিভ্রাট থেকে আমরা দেশকে মুক্ত করতে পারি, সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আমাদের প্রতি, সমাজের প্রতি আস্থা, বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে পারি।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।