গণতন্ত্রায়ণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা

আঁকাঃ তুলি
আঁকাঃ তুলি

বাংলাদেশের রাজনীতি, গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক দল নিয়ে সাধারণ আলোচনা হরহামেশাই হচ্ছে। বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের আলোচনা তেমন শোনা যায় না। সম্প্রতি এশিয়াটিক সোসাইটিতে বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল: গণতন্ত্রায়ণের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক একটি বক্তৃতা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বে পরিবারতন্ত্র ক্রমাগত সুদৃঢ় হচ্ছে। এতে দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক আচরণ কমে আসছে।’
আমাদের ধারণা, পরিবারতন্ত্র থেকে বড় দলগুলো আর সহজে বেরোতে পারবে না। কারণ, দলের একটি প্রভাবশালী অংশ ইতিমধ্যে বুঝে ফেলেছে, এতে ঝুঁকি কম, লাভ বেশি। এদের কারণেই দলে পরিবারতন্ত্র প্রশ্রয় পাচ্ছে। বড় দুটি দলের প্রধান নেত্রী পরিবারের উত্তরাধিকার হিসেবে দলের শীর্ষ পদ অর্জন করেছেন। দলের ভেতরে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে, যাতে দল ও নেত্রী একাকার। নেত্রীর ইচ্ছাতেই এখন দল পরিচালিত হয়। কাজেই দলে গুরুত্ব সহকারে থাকতে হলে দলের সব প্রবীণ বা ত্যাগী নেতাদের নেত্রীর বশংবদ হয়েই থাকতে হবে। এভাবেই বড় দুটি দল পরিচালিত হচ্ছে।
বড় দল দুটিতে যেহেতু নেতৃত্ব তৈরির বা ওপরের ধাপে ওঠার কোনো গঠনতান্ত্রিক পদ্ধতি নেই, তাই নেত্রীর করুণার ওপরই তাঁদের থাকতে হবে। দলের প্রথম কাতারের সব নেতাই নিজেদের একই মাপের মনে করেন। তাহলে শীর্ষে যাবেন কে? নেত্রীর পরিবারের একজন হলে আর কোনো বিতর্ক থাকবে না। পরিবারের কেউ প্রার্থী না হলে দলের শীর্ষ নেতা বাছাই করা প্রায় অসম্ভব। দল দু-তিন ভাগ হয়ে যাবে। এই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বড় দুই দলে আরও বহু বছর পরিবারতন্ত্র বজায় থাকবে আশা করা যায়।
ভারতের কংগ্রেসেরও একই দুরবস্থা। কংগ্রেস কত প্রাচীন দল। ত্যাগী ও জ্ঞানী নেতাদের দল। কিন্তু দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন একজন বিদেশিনী, প্রয়াত নেতার স্ত্রী হিসেবে। দলের দ্বিতীয় ক্ষমতাবান ব্যক্তি কে? তাঁরই ছেলে। রাজনীতিতে নবীন। এবার কংগ্রেসের ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ হলে সেই ছেলেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী হবেন।
বড় দলগুলোতে বিন্দুমাত্র গণতন্ত্র নেই। কারণ, পরিবারতন্ত্র। পরিবারতন্ত্র ও গণতন্ত্র একসঙ্গে চলতে পারে না। গণতন্ত্রে তো আলাপ-আলোচনার

শর্ত থাকে। এখন বড় দলগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা হয় না। দলীয় কমিটিতে এমন সব বিষয়ে আলোচনা হয়, যেখানে পরিবারের বা ঘনিষ্ঠদের কোনো ক্ষতি হবে না। দলের নেতারা জানেন, তাঁদের মতামতের মূল্য নেই। নেত্রী যে সিদ্ধান্ত দেবেন, সেটাই তাঁদের বাস্তবায়ন করতে হবে। অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের রাজনৈতিক দলের মধ্যে যে আলোচনা ও বিতর্কের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তা আমাদের দেশে হয় না।
বড় দলগুলো এভাবে চলতেই অভ্যস্ত। আমাদের ধারণা, এর পরিবর্তন সম্ভব নয়। কারণ, দলের বেশির ভাগ নেতাই খয়ের খাঁ মনোবৃত্তির। একটি সংসদ সদস্য পদ, মন্ত্রিত্ব পদ বা দলের কমিটিতে থাকার জন্য তাঁরা দলনেত্রীর একনায়কত্ব মেনে নেন। দলে অনেক সৎ রাজনীতিকও আছেন। কিন্তু তাঁরাও ব্যক্তিত্বহীন। নেত্রীর সুদৃষ্টির বাইরে যেতে চান না।
আমাদের ধারণা, সহজে এই পরিস্থিতিরও পরিবর্তন সম্ভব হবে না। কারণ, কোনো ত্যাগ স্বীকার না করে, কষ্ট না করে, শুধু মোসাহেবি করে সংসদ সদস্য, মন্ত্রী বা নেতা হওয়া যেখানে সম্ভব, সেখানে কারা এই বৃত্ত ভাঙতে চাইবেন? ব্যক্তিত্ব বা আত্মসম্মান তাঁদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। লোভনীয় হলো ক্ষমতা, প্রতিপত্তি, বিপুল অর্থ, সরকারি পদ ও পদক।
রওনক জাহান একটি চমৎকার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়মিত হলে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি হতো। তাঁর মতে, ‘এখন অনেকেই কিছুদিন দলীয় কার্যালয়ে ঘোরাঘুরি করে নিজেদের নেতা দাবি করেন। তাঁরা কেন নেতা, কে তাঁদের নেতা বানিয়েছেন তা বোঝা যায় না।’ আসলে বড় দলগুলোতে কে কীভাবে নেতা হন তা বোঝার উপায় নেই। একটি কারণ বোঝা যায়। দলের নেতা বা নেত্রী তাঁদের ‘নেতা’ হিসেবে দেখতে চান। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির অনেক কেন্দ্রীয় নেতার পটভূমি খুঁজে দেখুন, কোনো অভিজ্ঞতা নেই। হঠাৎ তাঁরা দলের নেতা, সংসদ সদস্য বা মন্ত্রী হয়েছেন। কোনো গণতান্ত্রিক দলে এভাবে নেতা হওয়া সম্ভব নয়। আমাদের দেশে সম্ভব। শুধু নেতা নন। সংসদ সদস্য বা মন্ত্রীও হচ্ছেন। আবার অনেকে টাকার জোরেও সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী হন। এ জন্য ব্যবসায়ীরা এখন রাজনীতিতে উৎসাহী।
রওনক জাহান আরও বলেছেন, ‘দলগুলো অনেক ক্ষেত্রেই আদর্শিক অবস্থান থেকে সরে এসেছে। ব্যবসায়ী ও ক্ষমতাবানদের হাতে

রাজনীতি চলে গেছে।’ বড় দলগুলোর আদর্শিক অবস্থাটা কী? পাকিস্তান আমলে তবু একটা আদর্শিক অবস্থান ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে আদর্শিক অবস্থান কোথায়? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িকতা, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এগুলো আদর্শ হতে পারত। কিন্তু কোনো বড় দলই এসব আদর্শ পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। খণ্ডিতভাবে গ্রহণ করেছে। গণতন্ত্রের আদর্শও এসব দলে নেই। একটাই আদর্শ দেখা যায়। তা হলো দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার। এসব দলেও অনেক ত্যাগী ও আদর্শবান রাজনীতিক রয়েছেন। তবে দলের ভেতরে তাঁরা কোণঠাসা। স্তাবকদের আধিপত্যে তাঁরা অসহায়।
ব্যবসায়ী ও ক্ষমতাবানদের হাতে রাজনীতি তো চলে যাবেই। কারণ, আমাদের রাজনীতির প্রধান স্রোতটি টিকে রয়েছে টাকার ওপরে।
আর ব্যবসায়ীরাই পারেন সেই টাকার জোগান দিতে। আর ক্ষমতাবানেরা জানেন কীভাবে টাকা সংগ্রহ করতে হয়। কাজেই এটা খুব স্বাভাবিক যে ব্যবসায়ী ও ক্ষমতাবানেরাই রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবেন।
রওনক জাহানের একটি বক্তব্যের সঙ্গে আমরা একমত হতে পারছি না। তিনি বলেছেন, ‘দলগুলো যেভাবে চলছে তার পরিবর্তন হওয়া দরকার। যাঁরা এই পরিবর্তন চান, তাঁদের রাজনীতিতে আসা উচিত। রাজনীতির মধ্যে থেকেই পরিবর্তনে তাঁদের ভূমিকা রাখতে হবে।’
বড় দলগুলোতে ঢুকে দলগুলোর মধ্যে পরিবর্তন আনা সহজ কাজ হবে না। কারণ, নেতৃত্বের একটা বড় অংশ পরিবারতন্ত্রের সুবিধা পাচ্ছে। তারা এই কাঠামো কাউকে ভাঙতে দেবে না। দলপ্রধান তো দেবেনই না। এ রকম চিন্তা নিয়ে কেউ দলে ঢুকলে তাঁকে নেতৃত্বের বাইরে রাখা হবে। এখনো দলের মধ্যে অনেকে আছেন, যাঁরা এই বৃত্ত ভাঙতে চান, তাঁরা নেত্রীর সুনজরে নেই। সুনজরে না থাকা মানে সংসদ সদস্য, মন্ত্রিত্ব বা কমিটির কোথাও স্থান না পাওয়া। এ রকম অনেককে এখন আমরা বাইরে দেখি।
তবে রওনক ঠিকই বলেছেন, ‘রাজনীতির মধ্যে থেকে পরিবর্তন আনতে হবে।’ সেটা কীভাবে সম্ভব? আমরা আগেও বলেছি, তরুণদের উদ্যোগে একটি পরিচ্ছন্ন ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল গড়ে তুলতে হবে। সমাজের জন্য তারা নেবে নানা স্বেচ্ছাসেবী কর্মসূচি। নানা ধরনের কাজ করে জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে। এখনকার দলগুলোর কোনো গঠনমূলক কাজ নেই। মিছিল, মিটিং ও প্রতিবাদ করাই তাদের একমাত্র কাজ। এর বাইরেও জনগণের কল্যাণে রাজনৈতিক কর্মীরা নানা কাজ করতে পারেন। তরুণদের দল সে রকম কাজ করে জনগণের আস্থা ও শ্রদ্ধা অর্জন করতে পারে। এভাবে দু-তিনটি সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তারা একদিন পরিবারতন্ত্র ও দূষিত রাজনীতিকে হটিয়ে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিতে পারবে। এভাবেই গণতন্ত্রায়ণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এর কোনো শর্টকাট পথ আছে বলে আমাদের জানা নেই।
তাই আমাদের ধারণা, পরিবারতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলকে গণতান্ত্রিক পথে আনার চেষ্টা করা বৃথা। শুধু সময়ের অপচয়। সুস্থ ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির জোয়ার সৃষ্টি করে দূষিত রাজনীতিকে বিদায় করা সম্ভব। আর সেই কাজে নেতৃত্ব দিতে পারে তরুণসমাজ। কিন্তু তরুণসমাজ কি দেশের দূষিত রাজনীতি, গণতন্ত্র, পরিবারতন্ত্রের অভিশাপ ইত্যাদি নিয়ে উদ্বিগ্ন? আগে তাদের উদ্বিগ্ন হতে হবে। উদ্বেগ থেকেই তাগিদের সৃষ্টি হবে। এ ব্যাপারে তরুণসমাজকে আলোচনায় অংশ নেওয়ার জন্য আমরা আহ্বান জানাই।

মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: উন্নয়ন ও মিডিয়াকর্মী।