খুন দেখছি, খুনিকে দেখছি না

স্বজন হারানোর বেদনা কত ভারী ও বিষাদময়!
স্বজন হারানোর বেদনা কত ভারী ও বিষাদময়!

গত মাসের প্রথম সপ্তাহে বরিশালে গিয়েছিলাম। সেখানে দেখেছি নারায়ণগঞ্জের ঠিক বিপরীত দৃশ্য। সেখানেও রাজনৈতিক বিরোধ আছে, ছিল। কিন্তু সেই বিরোধ কখনো সংঘাতে রূপ নেয়নি। প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। দুই দলের মধ্যে সহাবস্থানের নীতি পরিলক্ষিত হয়। কেউ কারও কর্মসূচিতে বাধা দেয় না। কেউ কারও অফিসে গিয়ে হামলা চালায় না।
সেই বিবেচনায় নারায়ণগঞ্জের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও ভালো থাকার কথা। এখানে বিএনপির রাজনীতি প্রায় নিষ্ক্রিয়। জামায়াতে ইসলামীর তেমন তৎপরতা নেই। গত বছরের ৬ মে সিদ্ধিরগঞ্জে ভয়াবহ রক্তাক্ত সংঘর্ষের পর হেফাজতে ইসলাম প্রকাশ্যে কোনো কর্মসূচি নিতে সাহস পায়নি। এখানে এখন আওয়ামী লীগ ও অনুগত বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ছাড়া কোথাও কিছু নেই। সাংসদ ও উপজেলা চেয়ারম্যানের পদগুলোও তারা আপসে ভাগাভাগি করে নিয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের পাঁচটি সংসদীয় আসনের তিনটি আওয়ামী লীগের, দুটি পোষ্য বিরোধী দলের দখলে। সবাই বিনা ভোটে নির্বাচিত। তবে নারায়ণগঞ্জের এক সাংবাদিক সহকর্মী জানালেন, নির্বাচনে বিরোধী দল এলে তিনটি আসনেই আওয়ামী লীগের জামানত বাজেয়াপ্ত হতো। জিজ্ঞেস করি, কীভাবে এতটা নিশ্চিত হলেন? তিনি বললেন, শহরের মানুষের সঙ্গে আলাপ করে দেখুন। আমি সতি সত্যি একজন রিকশাচালককে জিজ্ঞেস করি, বিরোধী দল নির্বাচনে এলে কে পাস করত। তিনি বেশ জোরের সঙ্গে বললেন, ‘স্যার, কিছু মনে করবেন না। যাঁরা নির্বাচিত হয়েছেন, আমি ভোটে দাঁড়ালেও তাঁরা হেরে যেতেন।’ এই হলো নারায়ণগঞ্জে প্রভাবশালী পরিবারের প্রভাব। ভয় দেখিয়ে মানুষের মুখ বন্ধ করা যায়, মন জয় করা যায় না। ভোট পাওয়া যায় না।
স্থানীয় একটি পত্রিকা শিরোনাম করেছে ‘নাসিম ওসমান আজীবন মুজিব সেনা।’ এ ব্যাপারে একজন সাংস্কৃতিক কর্মীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, ‘আমরা বুঝতে পারি না, স্বৈরাচারের খাস খেদমতগার একজন রাজনীতিক কীভাবে আজীবন মুজিব সেনা হলেন। আশির দশকে আওয়ামী লীগ যখন স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে, তখন এই নেতা সেই আন্দোলন দমনেই ভূমিকা রাখেন।’ তিনি আরও বললেন, ‘এখন তাঁকে আজীবন মুজিব সেনা বলে বঙ্গবন্ধুকেই খাটো করা হয়েছে।’
বাংলাদেশে বেশ কিছু রাজনৈতিক পরিবার আছে, যারা আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি ভাগাভাগির মাধ্যমে করে। তাতে সুবিধা হলো, যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন পারিবারিকভাবে ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া যায়। নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি একাকার হয়ে গেছে এবং তা একটি পরিবারের কারণে।
বরিশালের উন্নয়ন ও সৌহার্দ্যপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশ দেখে লিখেছিলাম, বাংলাদেশটা যদি বরিশাল হতো, তাহলে অনেক সমস্যারই শান্তিপূর্ণ সমাধান করা যেত। তাতে রাজনৈতিক নেতৃত্বের গোঁয়ার্তুমি বজায় না থাকলেও দেশের সাধারণ মানুষের জন্য সেটি মঙ্গলজনক হতো।
আজ ২ মে এখানে বসে মনে হচ্ছে, যদি কায়েমি স্বার্থবাদী ও সন্ত্রাসের হোতারা নারায়ণগঞ্জের বাইরে থাকতেন, যদি তাঁদের হাতে নারায়ণগঞ্জের মানুষ ও রাজনীতি জিম্মি না থাকত, তাহলে সাত-সাতটি জীবন এভাবে হারাতে হতো না, ত্বকীর মতো সম্ভাবনাময় কিশোরকে নারকীয় নৃশংসতায় অকালে প্রাণ হারাতে হতো না।
২.
নারায়ণগঞ্জে সাত খুন ও গুমের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল দেশবাসীকে, বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জবাসীকে এই বলে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছেন যে দু-এক দিনের মধ্যে বড় খবর পাবেন। তিনি নিশ্চয়ই কোনো দুর্বৃত্তকে পাকড়াও করার ইঙ্গিত দিয়ে থাকতে পারেন। শুক্রবার পর্যন্ত সে রকম খবর পাওয়া যায়নি; বরং সন্ত্রাসের জনপদ নারায়ণগঞ্জে আরও একজন ব্যবসায়ী অপহরণের খবর পাওয়া গেল। বৃহস্পতিবার রাতে তাঁকে সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে দুর্বৃত্তরা ধরে নিয়ে যায়। তার আগে টেলিফোনে তাঁর কাছে ২০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছিল তারা।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দু-এক দিনের কথায়

আরও একটি ঘটনার কথা মনে পড়ল। সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যার পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন, ‘৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারীদের ধরা হবে।’ আজ সোয়া দুই বছর পার হলেও সাগর-রুনির ঘাতকেরা ধরা পড়েনি। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দু-এক দিনের সঙ্গে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ৪৮ ঘণ্টার কোনো ফারাক নেই। ৪৮ ঘণ্টায়ই দুই দিন হয়।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর কথা উদ্ধৃত করে বলেছেন, তিনি (প্রধানমন্ত্রী) সাত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ধরতে কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এ কঠোর নির্দেশ পালনে তাঁর প্রশাসন, তাঁর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কতটা কঠোর হবে, সে ব্যাপারে সন্দেহ থেকেই যায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অপরাধীদের ধরবে, সেটাই তাদের পেশাগত দায়িত্ব, জনগণের অর্থে তাদের বেতন-ভাতা দেওয়া হয়। সে জন্য প্রধানমন্ত্রীকে কঠোর নির্দেশ দিতে হবে কেন?
প্রধানমন্ত্রীর পরের দিনের বক্তব্যে আরও খটকা লাগল। গাজীপুরে মে দিবসের সমাবেশে তিনি বলেছেন, দেশে যত হত্যা-গুমের ঘটনা ঘটছে, সেসবের সঙ্গে বিএনপি জড়িত। প্রধানমন্ত্রী যদি জানেন যে সব হত্যা ও গুমের সঙ্গে বিএনপি জড়িত, তাহলে তাঁর প্রথম ও প্রধান কর্তব্য তাদের গ্রেপ্তার করা। সমাবেশে বক্তৃতা করা নয়।
প্রধানমন্ত্রীর কঠোর, অতিকঠোর নির্দেশ সত্ত্বেও নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায়, তার আগে আবু বকর সিদ্দিক অপহরণের ঘটনায় কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। হত্যাকারী ও গুমকারীরা কি অদৃশ্য শক্তি? প্রধানমন্ত্রী চাইলেও তাদের ধরতে পারেন না?
৩.
নারায়ণগঞ্জে দীর্ঘদিন ধরেই সন্ত্রাস, গুম, চাঁদাবাজি ও অপহরণের ঘটনা চলে আসছিল। কিন্তু ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে এটি শত গুণে বেড়ে গেছে। এর কারণ স্থানীয় লোকজন বলেছেন, আগে প্রভাবশালী পরিবারে একজন সাংসদ ছিলেন। এখন দুজন হয়েছেন। একই পরিবার থেকে ব্যবসায়ী নেতাও হয়েছেন। ফলে তাঁরা যা ইচ্ছা তা-ই করছেন। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও ক্ষমতা নেই তাঁদের ইচ্ছার বাইরে যাওয়ার। অনেকে ঠাট্টা করে বলেন, ‘প্রশাসন তো দূরের কথা, গাছের পাতাটিও পড়ে না প্রভাবশালী পরিবারের হুকুম ছাড়া।’
স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, যেখানে সবকিছু প্রভাবশালী পরিবারের নিয়ন্ত্রণে সেখানে সাত-সাতটি হত্যার ঘটনা কীভাবে ঘটল? কারা ঘটাল—সে প্রশ্ন নারায়ণগঞ্জবাসীর মনে। এসব গুম ও হত্যার বিচার চেয়ে চেয়ে তাঁরা ক্লান্ত, বিপন্নপ্রায়। তাঁদের এ মুহূর্তের দাবি হলো নতুন করে যাতে কেউ গুম না হয়। নতুন করে কোনো বাবার কোল যাতে খালি না হয়, কারও স্ত্রী যাতে বিধবা না হন। তোলপাড় করা সাত হত্যার পর নারায়ণগঞ্জে আরেকটি অপহরণের ঘটনা ঘটে গেল। শুক্রবারও নারায়ণগঞ্জ ছিল বিক্ষোভে উত্তাল। দফায় দফায় সড়ক অবরোধ হয়েছে। এর শেষ কোথায়?
এই যে নারায়ণগঞ্জে একের পর এক শিশু-কিশোরসহ বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষকে গুম করে ফেলা হচ্ছে, কারা এসব ঘটনার শিকার হচ্ছে, নদীতে লাশ ভেসে ওঠায় আমরা তাদের পরিচয় পাচ্ছি। কিন্তু এসব গুম-খুন কারা ঘটাচ্ছে, তাদের পেছনে কারা আছে, সেসব জানতে পারছি না।
এই খুনিরা নিশ্চয়ই ভিন গ্রহ থেকে আসেনি। এই বাংলাদেশেই তাদের বসবাস। তাহলে কেন সরকার তাদের ধরতে পারছে না? কেন একটি খুন হওয়ার পরই সন্দেহভাজন ব্যক্তিরা রাতের আঁধারে পালিয়ে যেতে পারে? কারা সেই সুযোগ করে দিচ্ছে, সে প্রশ্নের জবাব সরকারকে দিতেই হবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জে যে সাতজন মানুষ খুন হয়েছেন তাঁদের স্বজনদের কান্না, নিহত কিশোর ত্বকীর মা-বাবার দীর্ঘশ্বাস শুনতে পাচ্ছেন কি? আর কেউ না জানলেও আপনি জানেন স্বজন হারানোর বেদনা কত দুঃসহ।

সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
[email protected]