তালা ও চাবি

দিল্লি হাইকোর্টের এক পর্যবেক্ষণে ভারতের তালা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কপাল খুলে যাচ্ছে। বাংলার মাটিতে দাবি আদায়ের অব্যর্থ অস্ত্র হিসেবে কিছুকাল যাবৎ ব্যবহূত হচ্ছে তালা। ভারতের মাটিকে পুরুষের মূত্রমুক্ত রাখতে এখন দরকার হচ্ছে তালার। বস্তু হিসেবে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় আজ তালার গুরুত্ব খুব বেড়ে গেছে।
ভারতে মনোজ শর্মা নামে এক ব্যক্তির অভিযোগ, মূত্রত্যাগ করে অনেক পুরুষ রাস্তার দেয়াল নোংরা করছে। রাস্তায় ও দেয়ালের গায়ে মূত্রত্যাগ করা থেকে বিরত রাখার নির্দেশনা চেয়ে তিনি দিল্লি হাইকোর্টে রিট করেন। এ বিষয়ে বিচারপতি প্রদীপ নন্দরাজ ও বিচারপতি দীপা শর্মার ডিভিশন বেঞ্চ বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন, এ বদ-অভ্যাস থামানো যাচ্ছে না। প্রত্যেক পুরুষের প্যান্টের জিপারে তালা লাগিয়ে দেওয়া উচিত (যাতে মূত্রযন্ত্র বের করতে না পারে) এবং তার চাবি বাড়িতে রেখে যেন বের হয়। যদিও আদালত নির্দেশ দিতে পারেন না যে জিপারে তালা লাগিয়ে চাবি বাড়িতে রেখে বের হও (তাতে মানবাধিকার বা যখন-তখন যেখানে-সেখানে মূত্রত্যাগাধিকার ক্ষুণ্ন হতে পারে)। তাঁরা বলেছেন, এই সমস্যা সমাধানে অন্য কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে হবে।
তবে আমরা মনে করি, মূত্রত্যাগাধিকার থেকে এই পর্যবেক্ষণে উপমহাদেশের সব পুরুষকে বিরত রাখা যাবে না। এই অঞ্চলে প্যান্ট পরা পুরুষের চেয়ে ধুতি, লুঙ্গি ও পাজামা পরা মানুষ কিছু কম নেই। রাস্তায় কাপড় তুলে দাঁড়িয়ে যেতে তাদের বাধা দেবে কে? তালা তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তালা তারা লাগাবে কোথায়?
যা হোক, আদালতের পরামর্শ যদি পালিত হয়, তাহলে পুরুষদের কিছু সমস্যা হবে কিন্তু জাতীয় সমস্যাটির সমাধান হবে না। তালার সাধারণত ডুপ্লিকেট চাবি থাকে, এ সম্পর্কে কোনো নির্দেশনা আসেনি। ডুপ্লিকেট চাবির একটি থাকবে ঘরে বউয়ের কাছে, অন্যটি নিজের পকেটে। আর তালা কোম্পানিকে যদি নির্দেশ দেওয়া হয়, একটি চাবির বেশি বানাতে পারবে না, তখন পথ চলতে চলতে যদি কেউ মনে করে একটু মুতে নিই, তাকে মরমি কবির মতো গাইতে হবে, ‘আমার (ঘরের) প্যান্টের চাবি পরের হাতে’। তালা ও চাবির মধ্যে বাংলা সাহিত্যে চাবির মূল্যই বেশি। ভারতবর্ষের প্রধান কবিও গেয়েছেন, ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে!’
বাঙালি বীরের জাতি, কবিরও। প্রকাশ্যে মূত্রত্যাগের ঐতিহ্য বাঙালির হাজার বছরের। অনেক দিন আগে এক লোক রাস্তায় দাঁড়িয়ে মূত্রত্যাগ করছিল। সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন কাঁধ পর্যন্ত চুলঅলা এক কবি। তিনি কেমন কবি তা পরখ করতে পথচারীরা তাঁকে বলে, ‘কত কিছু নিয়া কবিতা লিখলেন, প্রস্রাব করা নিয়া লেখেন তো একটা।’
কবি পরাজিত হওয়ার লোক নন। তিনি দাঁড়ালেন। ভাব এসে গেল সঙ্গে সঙ্গে। দেখলেন, একটি নলের মতো কিছু একটা থেকে ছুটছে পানির ধারা। কবি রচনা করলেন একটি চরণ: ‘কেমনে পশিল সলিল নলের শরীরে?’ একটি নলের মধ্যে কীভাবে এত পানি থাকে, তা আগে কবির মাথায় আসেনি।
বর্তমানে বাংলার মাটিতে তালা লাগানো ও তালা ভাঙা চলছে সমান তালে। ছোট তালা নয়, মস্ত বড় তালার সদ্ব্যবহার সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বেড়েছে। কী নিয়ে গোলমাল হয়েছে স্কুলে। লাগাও হেডমাস্টারের ঘরে তালা। প্রিন্সিপালকে আটকে রাখা হচ্ছে তাঁর কক্ষে তালা ঝুলিয়ে। উপাচার্যের ঘরে তালা দিয়ে আটকে জানালা দিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাঁকে খাবারের প্যাকেট। অপ্রিয় কর্মকর্তার ঘরে ঝুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে তালা। সে তালা প্যান্টের জিপারে লাগানোর মতো ক্ষুদ্র তালা নয়। বিরাট তালা। আন্দোলনকারীরা চাবি নিয়ে চলে যাচ্ছে বাড়ি।
তালা যেমন লাগানো হচ্ছে, তালা ভাঙাও চলছে প্রায়ই। সুড়ঙ্গ কেটে ব্যাংকের ভল্টের তালা ভেঙে লুট হচ্ছে বস্তা বস্তা টাকা। এমন চৌকস ডাকাতকে বাংলার মাটিতে ধরে কে? তালা ভাঙার সহায়তাকারী ব্যাংক কর্মকর্তাও বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ান।
বঙ্গীয় পুরুষের অতি পুরোনো অভ্যাসের কারণে দরজার তালা প্যান্টের জিপারে লাগানোর প্রস্তুতি চলছে। এই উপমহাদেশ প্রাচীন সভ্যতার জন্য খ্যাত। বাঙালি একটি সভ্য জাতি। পরিচ্ছন্নতা সভ্যতার অংশ। স্বভাব-চরিত্রে সভ্য হওয়াই সভ্যতা। হতদরিদ্রদের থাকার ঘরই নেই, সে প্রস্রাব করবে কোথায়? রাস্তাই তার ঠিকানা। কিন্তু উচ্চশিক্ষিত স্যুট-প্যান্ট পরা ভদ্রলোকেরাও যখন এক হাতে কানে মোবাইল ফোন, অন্য হাত প্যান্টের জিপারে ঢুকিয়ে দেয়াল ফুটপাত প্লাবিত করেন—তখন আমরা সভ্য এমন দাবি ধোপে টেকে না। কোরিয়ার মানুষ রাস্তায় প্রস্রাব করে না, জাপানিরা করে না, তুর্কিরা করে না—পানি কি শুধু উপমহাদেশের পুরুষেরাই খায়? আজই আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি—আর নয় রাস্তায় মূত্রত্যাগ।
তবে প্যান্টে তালা লাগিয়ে রাস্তায় মূত্রত্যাগ বন্ধ করা যাবে না। নিজেদের কুপ্রবৃত্তি ও বদ-অভ্যাসকে তালাবদ্ধ করতে হবে।

সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।