দুষ্টচক্রে আবদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা

নানা অপসংস্কৃতি জেঁকে বসেছে আমাদের সমাজে, জীবনে। উন্নয়ন প্রতিকূল এসব দুষ্টচক্রের জন্য আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারছি না, যথেষ্ট সক্ষমতা অর্জনে ব্যর্থতার দায় বহন করছি। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনেক সূচকেই আমরা এখনো পাকিস্তানের নিচে। বিশেষ করে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যে পাকিস্তানের চেয়ে উন্নত, তা বলা যাবে না।
হরতাল-অবরোধে যে দেশের অর্থনীতির চাকা বন্ধ হয়ে যায়, তার প্রমাণ আমরা বহু বছর ধরে পেয়ে আসছি। বলতে গেলে ২০১৩ সালজুড়েই চলে হরতাল-অবরোধ ও রাজনৈতিক সহিংসতা। বর্তমানে হরতাল-অবরোধ না থাকলেও ছাত্রদের পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠানে বিড়ম্বনা ও প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো ঘটনা ঘটে চলেছে। একটি জাতিকে অনুন্নয়নের দুষ্টচক্রের মধ্যে ধরে রাখতে হলে শিক্ষাব্যবস্থার অবনতিই যথেষ্ট।
আজ থেকে ৫০ বছর আগে পৃথিবীর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে যদি র‌্যাংকিং করা হতো, নিশ্চয়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানজনক তালিকায় থাকত। কিন্তু এখন বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকায় বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই। তাতে আমাদের চৈতন্যোদয় হয়েছে বলে মনে হয় না। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ সফলভাবে মোকাবিলা করার জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোকে যে বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করতে হবে, সে কথা কিন্তু শিক্ষাবিদেরা সাংহাইয়ে অনুষ্ঠিত প্রতিটি ওয়ার্ল্ড ক্লাস ইউনিভার্সিটি কনফারেন্সে মনে করিয়ে দিচ্ছেন।
পঞ্চাশ বছরের কম বয়সী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে কোরিয়ার পোস্টেক হলো দুনিয়াসেরা আর একই দেশের কাইস্ট হলো তৃতীয়। এই পরিসংখ্যান থেকে কোরিয়ার উন্নয়নের কারণ পরিষ্কার। শিক্ষা নিয়ে আমাদের দেশে পরীক্ষা-নিরীক্ষা কম হয়নি। বিশেষ করে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে। পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসির সঙ্গে মিলে এবং বিদেশের অনুরূপ গ্রেডিং প্রবর্তনও শিক্ষার উন্নয়নে অবদান রাখতে পারছে—এ কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না। যেমনটি পারেনি বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পগুলো।
প্রতিটি বাজেটেই আমরা শিক্ষাকে সর্বোচ্চ বরাদ্দপ্রাপ্ত খাত হিসেবে উচ্চ কণ্ঠে ঘোষণা করি কিন্তু সত্য হচ্ছে, শিক্ষায় আমাদের বরাদ্দ কমতে কমতে জিডিপির ২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যেখানে করা উচিত ৬ শতাংশের বেশি। আমাদের শিক্ষার ভৌত অবকাঠামো উন্নত দেশের সঙ্গে তুলনীয় নয়, যেমনটি নয় উন্নত দেশের শিক্ষকদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মানের সঙ্গে আমাদের। আমাদের একমাত্র সম্বল প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরিবেশে সীমিত সম্পদ দিয়ে অফুরন্ত চাহিদা মেটাতে তরুণ প্রজন্মের দক্ষতা ও প্রাণশক্তি।
একসময় মেধাতালিকায় স্থান পাওয়ার জন্য হাজার হাজার ছেলেমেয়ে চোখের

ঘুম মাটি করে পড়ালেখা করেছে, যদিও নাম উঠেছে ২০ জনের। অন্যদের অর্জনও ফেলনা নয়। হাজার হাজার ছেলেমেয়েকে বাদ দিয়ে ওই ২০ জনকে হিরো বানানো আমাদের পছন্দ হয়নি। তাই জিপিএ সিস্টেমের প্রবর্তন। এখন অবশ্য জিপিএ-৫ পাওয়ার জন্য এত চেষ্টা করতে হয় না। সামান্য পড়া আর উদার মূল্যায়নে ৭০ হাজার পরীক্ষার্থী সর্বোচ্চ গ্রেড পায়। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় তাদের ৫৫ শতাংশ ফেল। সরকারের এ বিষয়ে উদ্বেগ না থাকলেও অভিভাবকদের উৎকণ্ঠায় কমতি নেই। তাই কোচিং সেন্টারই তাদের শেষ আশ্রয়স্থল।
পরীক্ষা পেছানোর হাওয়া এত দিন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সীমিত ছিল। এখন তা স্কুল-কলেজেও বিস্তৃত হলো। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই রোগে ভুগছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্ররাও। আমার ব্যাচের ছাত্ররা বুয়েট থেকে পাস করেছে তিন বছর নয় মাসে। আমাদের একজন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র সুমন কুমার নাথের ব্যাচে সম্ভবত লেগেছিল প্রায় সাত বছর। পারফেক্ট জিপিএ পাওয়া ছাত্রটি এমআইটিতে ভর্তির জন্য আবেদন করল। ট্রান্সক্রিপ্ট পেয়ে তাদের চক্ষু চড়কগাছ! এত ভালো ছাত্র আর চার বছরের কোর্স নাকি শেষ করতে তার সাত বছর লেগেছে।
কারণে-অকারণে পরীক্ষা পেছানোর ফলে মেধাবী ছাত্ররা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ভারতীয় একজন ছাত্র যখন ২১ বছর বয়সে উচ্চশিক্ষা শেষ করে, তখন আমাদের ছাত্রদের শুরু হয়। ২৫ কি ২৬ বছর বয়সী একজন ভারতীয় তরুণ অধ্যাপক তাঁদের তত্ত্বাবধায়ক হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আবার চার বছরের কোর্স সাত বছরে শেষ করলে ব্যয় বাড়ছে প্রায় দ্বিগুণ। দেশ বঞ্চিত হচ্ছে একজন প্রকৌশলীর তিন বছরের কাজ ও অভিজ্ঞতা থেকে। যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যাপনারত বন্ধু জানালেন, দুই ছেলেমেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে রীতিমতো ঋণ করতে হচ্ছে। আর আমাদের দরিদ্র দেশে তা প্রায় বিনা পয়সায়।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক ফি দিয়ে পড়তে হয়। এটাও হয়তো তাদের যথাসময়ে পাস করার কারণ। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের তো তাহলে চার বছরের কোর্স তিন বছরে পাস করা উচিত। চার বছরের কোর্স শেষ করতে যদি বেশি সময় লাগে, সেই সময়ের জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুরূপ ফিসহ বাসস্থানের জন্য টাকা আদায় করলে নিশ্চয়ই পরীক্ষা পেছানোর আন্দোলন নিরুৎসাহিত হবে। বুয়েটে পরীক্ষা পেছানো এখন রোগে পরিণত হয়েছে।
বুয়েটের বিরাটসংখ্যক স্নাতক উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশে যায়। পরীক্ষা পেছানোর ফলে তাদের বিদেশযাত্রা বিলম্বিত হয়, তাদের চাকরিপ্রাপ্তি বিলম্বিত হয়, অনিশ্চয়তা বাড়ে, তাদের স্বপ্ন সীমিত হয়, জীবনের লক্ষ্য সংকুচিত হয়; সঙ্গে সঙ্গে দেশের ভবিষ্যৎও।
এই মেধাবী প্রকৌশলীরা যদি উন্নত দেশকে তাদের কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেয়, তাহলে তাদের চাকরির শেষ তিন-চার বছরের প্রাপ্তি থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে। সেই সংখ্যাটি রক্ষণশীল হিসেবে পাঁচ লাখ ডলার হতে পারে আর দেশের হিসাবে তা হতে পারে প্রায় চার কোটি এবং অন্যান্য সুবিধা।
কীভাবে একটি সীমিত সুবিধা-সম্পদের দেশে আমাদের মেধাবী ছাত্ররা নিজেদের বঞ্চিত করছে এবং দেশকে বঞ্চিত করছে, তা আমাদের মোটেই বোধগম্য নয়। সবার শুভবুদ্ধির উদয় হোক—এটাই আমার প্রার্থনা।

মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।