এই ব্যর্থতার দায়িত্ব কে নেবে?

আজকাল ঘর থেকে বের হলেই যাদের সঙ্গে দেখা হয়, পরিচিত-অপরিচিত, সবার মুখে একই প্রশ্ন, কোন পথে যাচ্ছে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি? এর সোজাসাপ্টা উত্তর দেওয়া আমার মতো সামান্য জ্ঞানবুদ্ধির মানুষের পক্ষে সহজ নয়। এসব প্রশ্নকর্তা আমার অতীত অভিজ্ঞতার কারণে মনে করেন, আমি নিরাপত্তা বিষয়ে পারঙ্গম। তেমনটি নয়। যৎসামান্য লেখাপড়া থাকলেও বর্তমান বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর সোজাসাপ্টা উত্তর দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। প্রতিদিনকার হত্যা, গুম আর অপহরণের ঘটনা দেশবাসীকে যেমন উদ্বিগ্ন করেছে, তেমনি আমরা যারা কিঞ্চিৎ সমাজসচেতন মানুষ, নিরাপত্তা নিয়ে সামান্য নাড়াচাড়া করা মানুষেরা উদ্বিগ্ন। কোন পর্যায়ে রয়েছে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা, যার অন্যতম উপাদান জননিরাপত্তা (হিউম্যান সিকিউরিটি)।
বর্তমান বিশ্বের উন্নত আর উন্নয়নকামী রাষ্ট্রগুলোর জাতীয় নিরাপত্তার, বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার, সবচেয়ে বড় উপাদান জননিরাপত্তা। জাতীয় নিরাপত্তা বলতে আমরা রাষ্ট্রের প্রচলিত নিরাপত্তার কথা মাথায় রাখি। তার দায়দায়িত্ব যেমন রাষ্ট্রের, তেমনি অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দায়িত্বও রাষ্ট্রের। বস্তুত, একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রাথমিক দায়িত্বই অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, যার প্রধান জননিরাপত্তা।
জননিরাপত্তা আন্তর্জাতিক স্বীকৃত উপাদান, যা জাতিসংঘেরও স্বীকৃত, দুটি। এক. জনচাহিদার নিরাপত্তা (সিকিউরিটি ফ্রম ওয়ান্ট) দুই. আতঙ্ক থেকে নিরাপত্তা (সিকিউরিটি ফ্রম ফিয়ার)। জননিরাপত্তার এই দুই উপাদান নিশ্চিত করার প্রাথমিক দায়িত্বই রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রের সংজ্ঞার মধ্যে জনগোষ্ঠীর কথা বলা হয়েছে, সেই জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা দিতে যখন রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়, তখন রাষ্ট্র অরাজক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। ক্রমেই অব্যবস্থা চরমে উঠে রাষ্ট্র ব্যর্থতার দিকে পতিত হতে থাকে। রাষ্ট্র পরিচালিত হয় একটি সরকার দ্বারা। রাষ্ট্রের ব্যর্থতার দায়দায়িত্ব সরকারের ওপরেই যে বর্তায়, এ কথা নতুন করে বলার বিষয় নয়।
বাংলাদেশ একটি বিরল রাষ্ট্র, যেটি একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হয়েছিল, যার চেতনার মধ্যে জননিরাপত্তার বিষয়টি ছিল প্রধান। ছিল মানবাধিকার সংরক্ষণের চেতনা। বর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশ বিশ্বদরবারের অন্যতম রাষ্ট্র বলে বিবেচিত হলেও আমরা ক্রমেই সেই অবস্থান থেকে ছিটকে পড়ছি বলে অনেকের মনে হতে পারে। ইদানীং হত্যা, গুম আর অপহরণ শুধু দেশবাসীই নয়, আন্তর্জাতিক মহলও বাংলাদেশের হালের আইনশৃঙ্খলার অবনতি নিয়ে চিন্তিত।
অপহরণ, গুম আর হত্যা এখন বাংলাদেশের প্রতিদিনকার খবরে পরিণত হয়েছে। মাত্র কয়েক দিন আগে দেশে-বিদেশে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরিবেশবাদী নেতা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামীর অপহরণ ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। যদিও আবু বকর সিদ্দিককে অক্ষত অবস্থায় অপহরণকারীরা ফেরত দিয়েছিল কিন্তু বহু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং গুম হয়ে যাওয়া অন্যদের মধ্যে অনেকের হদিস এখনো মেলেনি। গুম হয়ে যাওয়া রাজনৈতিক নেতা ইলিয়াস আলীকে আজও পাওয়া যায়নি। তেমনি পাওয়া যায়নি বহু মানুষকে। অনেকের লাশ বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া গেছে আর অনেকেই জীবিত অবস্থায় মৃত হয়ে রয়েছেন।
অপহরণের ঘটনা বাড়া ছাড়া কমছে না। প্রথম দিকে এক-দুজনের গুমের তথ্য প্রকাশিত হলেও হালে একই সঙ্গে একাধিক ব্যক্তির অপহরণের চিত্র সমাজকে অস্থিরতায় ঠেলে দিয়েছে। মাত্র কয়েক দিন আগে রাজধানীর অদূরে জনবহুল জনপদ নারায়ণগঞ্জের আদালত থেকে বের হওয়ার পর একই সঙ্গে সাত ব্যক্তি, যাঁদের মধ্যে একজন আইনজীবীও রয়েছেন, দিনদুপুরে ব্যস্ততম মহাসড়ক থেকে অপহরণ সরকার এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে যে নড়বড়ে করেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শুধু অপহরণ নয়, নির্মমভাবে তাঁদের সবাইকে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠেছে সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে। প্রশ্ন উঠছে রাষ্ট্রব্যবস্থার অবনতি নিয়ে। প্রশ্ন উঠেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দক্ষতা নিয়ে। বাংলাদেশে অপহরণ এখন যে পর্যায়ে পড়েছে, তা বিগত শতাব্দীর লাতিন আমেরিকায় ঘটে যাওয়া একই ধরনের ঘটনাগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়। মনে করিয়ে দেয় মেক্সিকো নামক রাষ্ট্রের অরাজক পরিস্থিতির কথা।
বাংলাদেশ বর্তমানে কোনো স্বৈরশাসক দ্বারা শাসিত হচ্ছে না। রয়েছে গণতান্ত্রিক সরকার। ২০১৪ সালের আগের সরকার ছিল ব্যাপক জনসমর্থনের ভিত্তিতে, কিন্তু সেই সরকারের শেষ সময়ে শুরু হয় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিম্নমুখী প্রবণতা, যা ২০১৪ সালে একটি বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারের সময় দ্রুত অবনতির পথে। বর্তমান সরকার যেভাবে গঠিত হয়েছে, তাকে যেমন অবৈধ বলা যায় না, তেমনি বিপুল জনসমর্থনের সরকার তেমনটাও বলা যায় না। তবু এ সরকারেরই দায়িত্ব

দেশে একটি সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা, এর মধ্যে জননিরাপত্তা ও আইনের শাসন প্রধান। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকার এই দুই বিষয় নিশ্চিত করতে হিমশিম খাচ্ছে। এ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলার উন্নতির কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
একটি রাষ্ট্র শুধু অর্থনৈতিক কারণেই ব্যর্থ হয় না। অব্যবস্থার কারণেও ব্যর্থতার পর্যায়ে চলে যেতে পারে। আন্তর্জাতিকভাবে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হওয়ার মোটা দাগের যে ১২টি কারণ নির্ণীত হয়েছে, তার মধ্যে রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনার বিষয়টি উল্লেখযোগ্য। সে কারণেই সরকারকে আরও কঠোর হস্তে ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে রাষ্ট্র ও সরকার অব্যবস্থাপনার মধ্যে পতিত না হয়।
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আপাতদৃষ্টে শান্ত মনে হলেও আইনশৃঙ্খলার বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে জনমনে আতঙ্ক আর নিরাপত্তাহীনতার কারণে চাপা ক্ষোভ প্রতীয়মান। নারায়ণগঞ্জের বর্তমান পরিস্থিতি হিমশৈলের একাংশ হলেও অত্যন্ত হূদয়বিদারক ও আতঙ্কজনক ঘটনা। সরকারের জন্য অশুভ সংকেত। কাজেই সরকারের প্রধান বিষয় বর্তমান পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলার উন্নতি সাধন এবং জনমনে যে আতঙ্ক বিরাজমান, তা যত দ্রুত সম্ভব প্রশমন করা।
বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানে গুম, খুন আর অপহরণের ক্রমবর্ধমান ঘটনার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাম যেভাবে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠছে, তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এসব সংস্থাকে দ্ব্যর্থহীনভাবে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করা উচিত। একই সঙ্গে প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে বিচারের মুখোমুখি করার সব প্রয়াস না নিলে এবং এসব অভিযোগ জোরালোভাবে খণ্ডন না করলে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে, যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। আইনশৃঙ্খলার উন্নতি এবং জনমনে সৃষ্ট আতঙ্কের নিরসন করতে হলে দলমত-নির্বিশেষে রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজকে একত্র হয়ে জাতীয় মতৈক্য গড়ে তোলা উচিত। অন্যথায় রাষ্ট্রের যে ক্ষতি হবে, তার দায়দায়িত্ব সবাইকেই বহন করতে হবে।
আমাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে কোনো ধরনের আঘাত আসুক, তেমনটা মোটেও কাম্য নয়। আমরা সরকারের কাছ থেকে যেমন সুশাসন কামনা করি, তেমনি জননিরাপত্তার পরিবেশ সৃষ্টির কামনা করি। আমরা কোনোভাবেই রাষ্ট্র ব্যর্থ বা সরকারের ব্যর্থতা যেমন কামনা করি না, তেমনি রাষ্ট্রের এহেন পরিস্থিতিতে সমাজের প্রতিটি স্তর এবং রাজনীতিবিদদের জাতীয় মতৈক্য গঠনের প্রয়াস কামনা করি। অন্যথায় রাষ্ট্রের যে ক্ষতি হবে, তার দায়দায়িত্ব সরকার এবং দেশের রাজনীতিবিদদের নিতে হবে।
পত্রপত্রিকায় প্রকাশ, ইতিমধ্যেই সরকার কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পরিকল্পনা করছে। এ ব্যবস্থা যেন শুধু বাগাড়ম্বরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকে, কাজেও যেন দৃশ্যমান হয়, তেমন আশা করি। নারায়ণগঞ্জে যে ধরনের ঘটনা ঘটেছে, অপহরণের পর হত্যার যে চিত্র জনমনে ফুটে উঠেছে, তাতে আতঙ্ক আরও এক ধাপ বেড়েছে। এ মুহূর্তে সময়ক্ষেপণ নয়, সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সর্বাত্মক দৃশ্যমান প্রচেষ্টা কাম্য। এ দেশ ১৬ কোটি মানুষের দেশ, বহু কষ্টে অর্জিত স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতাকে কোনোভাবেই ক্ষুণ্ন হতে দেওয়া যায় না।

এম সাখাওয়াত হোসেন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক।
[email protected]