বিশ্ব বৌদ্ধদের জাতীয় উৎসব

গৌতম বুদ্ধ
গৌতম বুদ্ধ

বৈশাখী পূর্ণিমাকে বৌদ্ধ পরিভাষায় বুদ্ধপূর্ণিমা বলা হয়। রাজপুত্র সিদ্ধার্থ গৌতমের জন্ম, বুদ্ধত্ব লাভ এবং বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণপ্রাপ্তি—এই তিনটি অনন্য ঘটনা শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে ঘটেছিল বলেই বৈশাখী পূর্ণিমার অপর নাম বুদ্ধপূর্ণিমা। যেসব সম্যক সম্বুদ্ধ জগতে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং ভবিষ্যতে আবির্ভূত হবেন, সবাই বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে জন্ম, বুদ্ধত্ব লাভ এবং মহাপরিনির্বাণপ্রাপ্ত হবেন। সেদিক থেকেও বৈশাখী পূর্ণিমা যুগে যুগে বুদ্ধপূর্ণিমা হিসেবে বিবেচিত হবে। মূলত বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ লাভের পর থেকে বুদ্ধবর্ষ গণনা শুরু হয়। গৌতম বুদ্ধ মহাপরিনির্বাণ লাভ করেছেন আজ থেকে দুই হাজার ৫৫৭ বছর আগে। আজ থেকে নতুন বুদ্ধবর্ষ দুই হাজার ৫৫৮ বর্ষ শুরু হলো। গৌতম বুদ্ধ ৮০ বছর বয়সে মহাপরিনির্বাণ লাভ করেছিলেন। সেই হিসাবে তিনি আজ থেকে দুই হাজার ৬৩৭ বছর আগে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
িযশুখ্রিষ্টের জন্মের ৬২৩ বছর আগে সিদ্ধার্থ গৌতমের জন্ম হয়। ৩৫ বছরে তিনি বুদ্ধত্ব লাভ করেন। যিশুখ্রিষ্টের জন্মের ৫৮৮ বছর আগে তিনি বুদ্ধত্ব লাভ করেন। অর্থাৎ তিনি যিশুখ্রিষ্টের জন্মের ৪৪৩ বছর আগে মহাপরিনির্বাণ (মৃত্যু) লাভ করেন। গৌতম বুদ্ধ বলে গেছেন, অন্তত পঁাচ হাজার বছর পর্যন্ত তঁার ধর্ম পৃথিবীতে স্থায়ী হবে। এরপর পঁাচটি পর্যায়ক্রমে বুদ্ধের ধর্ম বিলুপ্ত হবে। বুদ্ধ বলেন, প্রথমত, প্রতিসংবিধাপ্রাপ্ত অর্হৎ ভিক্ষু জন্মগ্রহণ করবেন না; দ্বিতীয়ত, মার্গফলপ্রাপ্ত ভিক্ষু খুবই দুর্লভ হবে; তৃতীয়ত, শীলবান ভিক্ষু দুর্লভ হবে; চতুর্থত, ত্রিপিটক অধ্যয়ন, অনুশীলন বিলুপ্ত হবে; পঞ্চমত, ভিক্ষু সংঘ বিনয় পালন থেকে বিরত হয়ে পড়লে নবগুণধারী মহান সংঘ ঘুচে যাবে। চীবরধারী কোনো ভিক্ষু দেখা যাবে না। বুদ্ধের একটি বাণী বলার ও শোনার কোনো লোক থাকবে না। বুদ্ধ শাসন শূন্য হয়ে পড়বে। গৌতম বুদ্ধের পঁাচ হাজার বছর ধর্ম শাসন শেষে বুদ্ধ শূন্যে কল্পে তার সব ধাতু পৃথিবী, স্বর্গলোক এবং নাগলোক থেকে এসে গয়ার বোধিবৃক্ষÿমূলে উপনীত হয়ে আবার বুদ্ধরূপ ধারণ করবে। গৌতম বুদ্ধের এই রূপকে বলা হবে ‘নিমিত্ত বুদ্ধ’। এই নিমিত্ত বুদ্ধ আবার চতুরার্য সত্য ও আর্য-অষ্টাঙ্গিক মার্গ দেশনা করবেন। তখন ১০ হাজার চক্রবালের সমস্ত দেব-ব্রহ্মা সেখানে সমবেত হবেন, দেশনা শেষে দেব-ব্রহ্মাগণ অনাগত আর্যমিত্র বুদ্ধের সাক্ষাৎ লাভে বিমুক্তি সুখপ্রাপ্তির প্রার্থনা জানাবেন। তারপর বুদ্ধজ্যোতি তেজে আগুন ধরে নিমিত্ত বুদ্ধরূপ ভস্মীভূত হবে। তখন ভীষণ ভূমিকম্প হবে। পুষ্পবৃষ্টি ও প্রচণ্ড ধারায় বুদ্ধের ভস্ম ধুয়ে যাবে। তখনই গৌতম বুদ্ধের ধর্মশাসন পুরোপুরি বিলুপ্ত হবে। এটা হবে গৌতম বুদ্ধের অনুপাদিশেষ নির্বাণ লাভ।
বুদ্ধের জন্ম সব কালে, সব দেশে হয় না। কিন্তু বুদ্ধরা অপার মৈত্রীবলে ভারতবর্ষ থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েন স্বমহিমায়। আড়াই হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে ভারতবর্ষে জন্ম নেওয়া একজন গৌতম বুদ্ধ এখনো মানুষের হৃদয়বেিদতে আসন পেতে আছেন। তঁার অহিংসা নীতি এবং মানবতাবাদের জন্য বিশ্ববাসী তঁাকে এখনো ভুলতে পারেনি। শত্রুতাকে মিত্রতা দিয়ে, লোভকে ত্যাগ দিয়ে, ক্রোধকে মৈত্রী দিয়ে জয় করার যে শিক্ষা তিনি দিয়েছেন, আজও তার মহানতা এবং প্রয়োজনীয়তা এতটুকু কমেনি। মানবতাকে উদ্ধার এবং লালনের এমন শিক্ষা থেকে মানুষ যেদিন দূরে সরে যাবে, সেদিন থেকে পৃথিবী আবার অনাচারে পূর্ণ হয়ে উঠবে। বুদ্ধের শিক্ষা সব জীবের সুখ, শািন্ত এবং বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সহায়ক বলেই পৃথিবীতে যুগে যুগে জন্ম নেওয়া আলোকিত মানুষমাত্রই বুদ্ধের শিক্ষাকে গ্রহণ করেন, বড় করে দেখেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ দার্জিলিং সফরের সময় বুদ্ধকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে তঁার এক কবিতায় লিখেছেন,
কাল প্রাতে মোর জন্মদিনে/ এ শৈল-আতিথ্যবাসে
বুদ্ধের নেপালি ভক্ত এসেছিল মোর বার্তা শুনে।
ভূতলে আসন পাতি/ বুদ্ধের বন্দনা মন্ত্র শুনাইল আমার কল্যাণে,
গ্রহণ করিনু সেই বাণী।
এ ধরায় জন্ম নিয়ে যে মহামানব
সব মানুষের জন্ম সার্থক করেছে একদিন
মানুষের জন্মক্ষণ হতে
নারায়ণী ও ধরণী
যার আবির্ভাব লাগি অপেক্ষা করেছে বহুযুগে
যাহাতে প্রত্যক্ষ গেলো ধরায় সৃষ্টির অভিপ্রায়
শুভক্ষণে পুনমন্দ্রে
তঁাহারে অমরণ করি জানিলাম মনে
প্রবেশি মানবলোক আশি বর্ষ আগে
এই মহাপুরুষের পুণ্যত্যাগী হয়েছি আমি
[জন্মদিনে, ৬ সংখ্যক কবিতা, মেংসু, বৈশাখ ১৩৪৭]
কবি তঁার বুদ্ধদেব গ্রন্থে লিখেছেন,
বর্ণে বর্ণে, জাতিতে জাতিতে, অপবিত্র ভেদবুদ্ধির নিষ্ঠুর মূঢ়তা ধর্মের নামে আজ রক্তে পঙ্কিল করে তুলেছে এই ধরাতল; পরস্পর হিংসার চেয়ে সাংঘাতিক পরস্পর ঘৃণায় মানুষ এখানে পদে পদে অপমানিত। সর্বজীবে মৈত্রীকে যিনি মুক্তির পথ বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন সেই তঁারই বাণীকে আজ উৎকণ্ঠিত হয়ে কামনা করি এই ভ্রাতৃবিদ্বেষ কলুষিত হতভাগ্য দেশে পূজার বেদীতে আবির্ভূত হোন মানবশ্রেষ্ঠ, মানবের শ্রেষ্ঠতাকে উদ্ধার করবার জন্যে, ...ভগবান বুদ্ধ একদিন রাজসম্পদ ত্যাগ করে তপস্যা করতে বসেছিলেন। সে তপস্যা সকল মানুষের দুঃখমোচনের সংকল্প নিয়ে। এই তপস্যার মধ্যে কি অধিকারবোধ ছিল? কেউ ছিল কি ম্লেচ্ছ? কেউ ছিল কি অনার্য? তঁার সেই তপস্যার মধ্যে ছিল নির্বিচারে সকল দেশের সকল মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা, তঁার সেই এত বড়ো তপস্যা আজ কি ভারতবর্ষ থেকে বিলীন হবে? [বুদ্ধদেব, পৃ. ৮-৯]
জাতি-ধর্মনির্বিশেষে সবার প্রতি শুভ বুদ্ধপূর্ণিমার মৈত্রীময় শুভেচ্ছা রইল। বাংলাদেশ চিরজীবী হউক।
জগতের সকল প্রাণী সুখী হউক।
প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু: সহকারী পরিচালক, কেন্দ্রীয় সীমা বৌদ্ধবিহার৷