রাস্তার রাজা-প্রজা ও জীবনের সাতটি বছর

রাস্তাই বলে দেয় বাংলাদেশটা কার দখলে
রাস্তাই বলে দেয় বাংলাদেশটা কার দখলে

দিব্যদৃষ্টি সহসা আসে না। ব্যতিব্যস্ত জীবনে সেই সময়ই বা কোথায়? কিন্তু ঢাকার যানজটে বসে থাকতে থাকতে একদিন আমারও তৃতীয় নয়ন খুলল। স্পষ্ট দেখতে পেলাম, রাস্তায় বসে বসেই বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। যানজটে আটকে গরমে সেদ্ধ হওয়া যেন আমাদের সম্মিলিত সশ্রম কারাদণ্ড। অথচ এই ঢাকার রাস্তা নিয়েই আশির দশকে সিনেমার গান ছিল, ‘পিচঢালা এই পথটারে ভালোবেসেছি, তার সাথে এই মনটারে বেঁধে নিয়েছি’। হায়, সেই বাঁধন এমনই বাঁধন, জীবনের স্বর্ণসময়টা পথে পথেই খরচ হয়। রাস্তা নিয়ে বরং কাঙালিনী সুফিয়ার ‘পরানের বান্ধব রে, বুড়ি হইলাম তোর কারণে’ গানটাই যথার্থ। চীনের দুঃখ নাকি হোয়াংহো নদী, ঢাকার দুঃখ এর রাজপথ। আমাদের পৃথিবীতে গতি নেই; দুর্গতি আছে। যানজটের যে অবস্থা তাতে দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত ঢাকার মানুষকে মোটমাট কত বছর রাস্তায় আটকে থাকতে হয়? আমার হিসাবে সাড়ে সাত বছর। অস্ট্রেলিয়ার যাত্রীরা যাতায়াতে সাপ্তাহিক ব্যয় করেন তিন ঘণ্টা ৩৭ মিনিট। ঢাকায় প্রতিদিনই লাগে কমপক্ষে তিন ঘণ্টা। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু এখন ৬৮ বছর। এ হিসাবে দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত যাতায়াতের সময়ের আনুমানিক যোগফল হবে কমসে কম সাড়ে সাত বছর। এমন দেশ আর কোথায় পাব, যেখানে রাজধানীতে বসবাসের খেসারত হিসেবে ৯ ভাগের ১ ভাগ আয়ু গচ্চা দিতে হয়? এই সাড়ে সাত বছরে বহু বিদ্যা পাস দেওয়া যায়, বহু টাকা রোজগার করা যায়, বহু পণ্য উৎপাদন করা যায়, বহু দেশ ঘুরে দেখা যায়। এটা গায়েবি গজব না, মনুষ্যসৃষ্ট আজাব। কিন্তু এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের দিকে আঙুল উঁচিয়ে কি বলতে পারব, ফিরিয়ে দাও আমার জীবনের সাড়ে সাতটি বছর?
ঔপন্যাসিক মিলান কুন্ডেরা মধ্যযুগের সঙ্গে আধুনিক যুগের পার্থক্য করেছিলেন গতি দিয়ে। ঢাকায় আমরা এখনো মধ্যযুগবাসী। যে দেশে গতি বেশি, সেই দেশে সুখ-সমৃদ্ধি ও স্বাধীনতা বেশি। এই দিক থেকে দুনিয়া গতিসমৃদ্ধ আর গতিদরিদ্র ভাগে বিভক্ত। ঢাকা থেকে একজন সিঙ্গাপুরে গিয়ে শোনে, তাকে যারা প্লেনে তুলে দিতে এসেছিল তারা এখনো বাড়ি পৌঁছায়নি। গতিই শক্তি। এই শক্তির অভাবে বাংলাদেশের তরুণেরা গতিশীল দুনিয়ার তরুণদের সঙ্গে কখনোই পেরে ওঠেন না। জীবনের রাস্তা কি যাতায়াতের রাস্তা—সবখানেই তাদের পাহাড় ঠেলে এগোতে হয়। রাস্তায় যাদের বেশি দেখা যায় তারা সেই ডিজিটাল বাংলাদেশে গতিযুদ্ধে পরাস্ত তরুণ সৈনিক। বাসের খুপরিমতো জানালায় বিষণ্ন-বিধ্বস্ত যে মুখগুলো দেখা যায়, তারাই ঢাকার গতি-ক্ষমতাহীন জনতা।
আরও মর্মান্তিক, ঢাকার মোট চলাচলের ৬২ শতাংশই হয় পায়ে হেঁটে। গরিব ও শ্রমজীবী, যাদের মধ্যেপোশাকশ্রমিকেরাই বেশি, তাদের আধুনিকতা এখনো পায়ে হাঁটার স্তরে। ঢাকার সড়কে যানজটের প্রধান কারণ প্রাইভেট কার। রাস্তার ৭০ শতাংশ জায়গা দখল করে রাখে এই বাহন। অথচ ঢাকার মাত্র ৪ শতাংশ মানুষের এটি আছে। ব্যক্তিগত গাড়িহীন ৯৬ শতাংশ যাত্রী ৩০ শতাংশ জায়গার দখল নিতে মানবেতর কায়দায় ধাক্কাধাক্কি করে (ডেইলি স্টার, ২৩ জানুয়ারি)। রাস্তার চালচিত্রই বলে দেয় বাংলাদেশটা কার দখলে।
গতিই ক্ষমতা। বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্ষমতাবান মানুষটি হলেন প্রধানমন্ত্রী; তাঁর গতি দুর্বার। তিনি ছাড়া এই গতিদরিদ্র দুনিয়ার গাড়িমালিক শ্রেণীটি কিছু গতিবেগ উপভোগ করেন। যানজটের মধ্যেও বাসের অন্তত ১০ জন যাত্রীর জায়গা নিয়ে একজন এসি কারে বসে চোখ বুজে থাকেন। দৃশ্যটা দেখে ঘামে উত্তপ্ত দেহঘর্ষণে জ্বলতে থাকা যাত্রীদের বালুতে উটপাখির মাথা গুঁজে থাকার কথা মনে এলে দোষ দেওয়া যাবে না। এই শহরে কারণে-অকারণে গাড়ি ভাঙচুরের সামাজিক মনস্তত্ত্বটা এই তীব্র শ্রেণীবৈষম্য থেকেই তৈরি। এ ধরনের যোগাযোগব্যবস্থায় বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মেলামেশার সুযোগ তো থাকেই না, বরং পরস্পরের প্রতি বৈরিতা আরও বাড়ে। ড. বিনায়ক সেন একবার বলেছিলেন, কলকাতার সাহিত্যের মতো ঢাকাই গল্পে বাস বা ট্রেনযাত্রী নারী-পুরুষের প্রেম হওয়ার সুযোগ নেই। তার কারণ এই অমানবিক যাতায়াতব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় নারী-শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীদের কষ্টও কেউ দেখে না।
বাংলাদেশে রাস্তা যন্ত্রণা আর ঝুঁকির জায়গা। একে তো ছিনতাই, দুর্ঘটনা ইত্যাদির ঝুঁকি, তার ওপর গতি ও স্থানের জন্য কামড়াকামড়ি। যাদের সামর্থ্য আছে, তারা ওই নরকের মধ্যে এক টুকরা স্বর্গীয় শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য গাড়ি কিনে বাকি সবার সমস্যা থেকে চোখ বুজে থাকেন। সামষ্টিক সমস্যার এই ব্যক্তিগত সমাধানে কষ্ট আরও বাড়ে। বছরে ৪০ হাজার কার ঢাকার রাস্তায় নামছে আর গণপরিবহনের গণযাত্রীদের আরও কোণঠাসা করে ফেলছে। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে উড়ালসড়ক বানানো হচ্ছে এই গাড়িওয়ালাদের জন্যই। তাঁরা ওপরের সড়কে শাঁ শাঁ করে ছুটবেন, আর তলার রাস্তায় লাখো যাত্রী ধুঁকতে ধুঁকতে ওপরতলার বাসিন্দাদের চলাচল দেখবে আর ফুঁসবে। কিন্তু আখেরে তাদেরও লাভ নেই। নিচের তলার রাস্তায় গাড়িগুলোকে নামতেই হবে, আর তখনই যানজট যাবে আরও অসহনীয়ভাবে বেড়ে। সাপ্তাহিক ২০০০-এর এক প্রতিবেদনে বুয়েটের অধ্যাপক সারোয়ার জাহান জানান, উড়ালসড়ক যানজট নিরসনে ভূমিকা রাখবে না...উড়ালসড়কের র‌্যাম্পগুলো দিয়ে গাড়ি ওঠানামার সময় যানজট তৈরি হবে। শহরের মানুষের চলাচলের জন্য দরকার গণপরিবহন। কিন্তু অভিযোগ আছে, গাড়ি ব্যবসায়ী ও পরিবহনমালিকদের চাপে গণপরিবহনব্যবস্থার উন্নতি হচ্ছে না। সরকারও এই খাতে টাকা দিতে চায় না। ওই পত্রিকার তথ্যমতে, নয় কিলোমিটার ফ্লাইওভার তৈরির খরচ দিয়ে ঢাকার জন্য ৫৫ কিলোমিটার বাস র‌্যাপিড ট্রান্সপোর্ট তৈরি করা সম্ভব।
একজনকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, যানজটে আটকে থাকতে থাকতে আপনার কী ইচ্ছা হয়? সোজা উত্তর: খুন করতে ইচ্ছা হয়। আরেকজনের উত্তর, কানে হেডফোন দিয়ে চোখ বুজে গান শুনি। বলা দরকার, দুজন দুই রকম বাহনের যাত্রী। একজন ঠ্যাসাঠেসি বাসে এক পা রাখার জায়গা পান, তো আরেক পা বকপাখির মতো শূন্যে রাখতে হয়। বাসে সিট পান তো ঘাড়ের ওপর দাঁড়ানো যাত্রীর ঘাম ঝরে। অন্যজন এসি প্রাইভেট কারে বসে বসে চলেন। কেউ রাস্তার রাজা আর কেউ প্রজা। বাংলাদেশে শ্রেণীবৈষম্যের রগরগে রূপটা রাস্তায় নামলেই বোঝা যায়। কয়েক দিন বাসে চলাচল করলেই যে কেউ গালিগালাজের ডিকশনারি লিখতে পারবেন। যাঁরা দূরদর্শী তাঁরা গালি দেন সরকারকে, আর অদূরদর্শীরা সহযাত্রী কিংবা বেচারা ট্রাফিক পুলিশকে গালিগালাজ করে তপ্ত হূদয় শান্ত করেন।
ঢাকার মানুষের সার্বিক স্বাস্থ্য সমস্যার অন্যতম কারণ যাতায়াতের ভোগান্তি। এক গবেষণায় দেখা গেছে, যানজটের জন্য যাত্রীদের নার্ভাসনেস, টেনশন, ব্যথা ও জড়তা, শরীর জ্বালাপোড়া, মাথা ঘোরা, রক্তচাপ বৃদ্ধির মতো শারীরিক সমস্যা হয়। মানসিক সমস্যার মধ্যে খিটখিটে মেজাজ, অমনোযোগী হওয়া ও কর্মস্থলে খারাপ করা, হতাশা বাড়া ইত্যাদি দেখা দেয়। যানজটে কেবল অতিরিক্ত জ্বালানি পুড়ে টাকা ও পরিবেশ দুটোই নষ্ট হয় না, জাতীয় কর্মশক্তির বড় অংশই অপচয় হয়ে যায়। রাস্তায় ১০ মিনিট দেরি করা মানে সামাজিক যোগাযোগ ১০ শতাংশ কমে যাওয়া। আজকাল ঢাকায় সময় ও শক্তিক্ষয় হবে বলে এক এলাকার মানুষ আরেক এলাকার বন্ধু বা আত্মীয়ের বাড়ি যান না। রাস্তার ধকলে কাবু মানুষ বাড়ি পৌঁছানোর পর আর আপনজনের সঙ্গে সময় কাটানোর দম পান না।
ঢাকার রাস্তা এ শহরের যাবতীয় দুর্গতির সঙ্গে সম্পর্কিত। বুয়েটের অধ্যাপক আদনান মোর্শেদ কলম্বিয়ার উদাহরণ দিয়ে লিখেছেন, দক্ষিণ আমেরিকার এই অপরাধপ্রবণ শ্রেণীবিভক্ত শহর নব্বই দশকের শেষ দিকে নগর পরিবেশ আমূল বদলে দিয়েছিল ট্রান্সমিলেনিও নামে এক টেকসই গণপরিবহনব্যবস্থার মাধ্যমে। এই ব্যবস্থা শহরের চলাচলেই শুধু গতি আনেনি, বিভিন্ন অর্থনৈতিক শ্রেণীকে একসঙ্গে এনে শহরের সামাজিক ভারসাম্যকে করেছে শক্ত। কমেছে অপরাধপ্রবণতাও। বলা বাহুল্য, ওই শহরের মেয়রকে এ জন্য রাজনীতি ও অর্থনীতির দুর্বৃত্ত শক্তির বাধা ডিঙাতে হয়েছিল।
বাংলাদেশে সড়ক পরিবহনের সমস্যা কারিগরি নয়, সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। রাজনীতির অপশক্তির যোগসাজশেই এভাবে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের জীবনের মূল্যবান অনেক বছর। এই শহরের দেড় কোটি মানুষ তাদের লোভ আর অযোগ্যতার জিম্মি। পাঠিকা, যত জানবেন তত মাথা গরম হবে। যানজট কালকেই দূর হচ্ছে না। তাই আপাতত মাথা ঠান্ডা রাখার একটা ব্যবস্থা জোগাড় করেছি। ফার্মগেটের ফুটপাতে ৫০ টাকায় আজব এক মাথামালিশের যন্ত্র পাওয়া যায়। একটা কাঠির আগায় অনেকগুলো পাতলা শিকের এই যন্ত্র মাথায় ঘষাঘষি করলে সুড়সুড়ির আরাম হয়। যাত্রী মহোদয়, যানজট নিয়েমাথাব্যথা প্রশমনে আপাতত এই যন্ত্রই অগতির গতি।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
[email protected]