জামায়াতের বিচার প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর যুক্তি দুর্বল

গত ৩১ মের সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে বেশ কিছু মন্তব্য করেন৷ তাঁর বক্তব্যে অগ্রাধিকার পায় জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা না-করা, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের বৈধতা, নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনা, মুক্তিযুদ্ধের সুহৃদদের দেওয়া সম্মাননা ক্রেস্টের সোনা জালিয়াতির বিষয়৷ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে নাগরিক সমাজের দুই প্রতিনিধির প্রতিক্রিয়া এখানে প্রকাশ করা হলো:

প্রতিক্রিয়া
প্রতিক্রিয়া

৩১ মে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের অনেকগুলো দিকই মনঃপূত হয়নি৷ সাদামাটাভাবে যত বড়ই হোক না কেন, তাঁর মতামত গ্রহণ না-করা, সমালোচনা করা কিংবা মতের সঙ্গে দ্বিমত করা—এসব মিলিয়েই গণতন্ত্র৷ সেই গণতন্ত্রচর্চার অংশ হিসেবেই আমার এই প্রতিক্রিয়া৷
প্রথমেই আসে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামীর বিচার প্রসঙ্গ। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, এই মুহূর্তে বিচার সম্ভব নয়৷ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে তাঁর আইনমন্ত্রীই সঠিক বলেছেন৷ প্রধানমন্ত্রী এ-ও বলেছেন যে তাঁদের বক্তব্যের সঙ্গে একমত না হলে সেটা বিভ্রান্তি ছড়ানো হবে৷ একমত না হওয়াটাই গণতন্ত্র। সেটাকে বিভ্রান্তি বলা অসাধুতা এবং গণতন্ত্রের জন্য সুখকর নয়।
জামায়াতের বিচার না-করা প্রসঙ্গে যে আইনি যুক্তিগুলো দেখানো হয়েছে, তার যে কোনো ভিত্তিই নেই, আমি সেই দাবি করছি না। তবে যুক্তিগুলো দুর্বল। বিশেষ করে এক মামলা থাকলে আরেক মামলা হবে না অর্থাৎ জামায়াতের নিবন্ধন-সংক্রান্ত একটি মামলা বিচারাধীন আছে, জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের মামলার রায়ে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালও জামায়াতে ইসলামীর ব্যাপারে কিছু মন্তব্য করেছেন—এ সবই সত্য। কিন্তু অন্য আদালতে মামলার কারণে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াতে ইসলামীর এখন বিচার করা যাবে না, এটা গ্রহণযোগ্য আইনি যুক্তি নয়। শাস্তির ব্যাপারে আইনের ২০ ধারায় কিছুটা অস্পষ্টতা আছে৷ কিন্তু এই অস্পষ্টতা দূর করার জন্য, জুতসই আইনি ব্যবস্থা দেওয়া খুব কঠিন বলে মনে হচ্ছে না।
আর বিচার না করার পক্ষে যদি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হয়েই থাকে এবং সেই সিদ্ধান্তকে আইনি মোড়কে দেশবাসীকে উপহার দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, তাতে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক সততা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
র্যাবের তিন কর্মকর্তাকে হাইকোর্টের আদেশে গ্রেপ্তার করায় প্রধানমন্ত্রী যে খুশি হননি, সেটা তাঁর কয়েক দিন আগের মন্তব্যেই আঁচ করা গিয়েছিল। ৩১ মের সংবাদ সম্মেলনে সেটি আরও স্পষ্ট হলো। প্রথমবারে উষ্মা প্রকাশ পেয়েছিল রিট আবেদনকারী আইনজীবীর প্রতি, এবারে তিনি নাখোশ হলেন গ্রেপ্তারের আদেশ দেওয়া বিচারপতিদ্বয়ের প্রতি। হাইকোর্টের আদেশে এই তিন কর্মকর্তার গ্রেপ্তারে দেশবাসী যখন স্বস্তি পেয়েছে, তখন সেটা প্রধানমন্ত্রীর কেন বেপছন্দ হলো, তা বোধগম্য নয়।
আজকাল আমরা প্রধানমন্ত্রীর কটাক্ষ আর সময়ে সময়ে বেফাঁস কথায় হকচকিয়ে যাই না। মুক্তিযুদ্ধের সম্মাননা ক্রেস্টের সোনা নিয়ে যে দুর্নীতি ও জালিয়াতি হয়েছে এবং তাতে সারা বিশ্ববাসীর কাছে লজ্জায় আমাদের মাথা নিচু হয়ে গেছে। আমাদের মন্ত্রী, কর্মকর্তাদের দুর্নীতি বিশ্ববাসীর কাছেও প্রামাণিক দলিল হয়ে আছে৷ কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কাছে এটা কোনো বড় ব্যাপারই নয়। আসল হোক নকল হোক, সম্মাননা তো দেওয়া হয়েছে, এই বলে তিনি আমাদের সান্ত্বনা দিয়েছেন। আসল ও নকলের ফারাকটা তাঁর কাছে বড় না-ও হতে পারে। কিন্তু অভাগা আমজনতা ওই সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দ, আসল-নকল—এই সবকিছুই এক চোখে দেখে না। সৎ কর্মে অর্থ আয় আর ঘুষ খেয়ে টাকা জমানোর মধ্যে ইহকাল-পরকালের মতো ফারাক রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী সেটি বুঝতে না পারলেও ধারণা করি, সম্মাননাপ্রাপ্ত বিদেশি বন্ধুরা ক্রেস্টের জালিয়াতি জানার পরে তাঁদের গর্বে ভরে ওঠা বুকটা নিশ্চয়ই অনেক সংকুচিত হয়ে গেছে এবং আমাদের প্রতি তাঁদের কৃতজ্ঞতার মাত্রাটাও হয়তো অনেক কমে গেছে।
প্রধানমন্ত্রীর চোখে বিএনপির বড় দোষ ছিল ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে না যাওয়া। এখন আরও বড় দোষ হয়েছে আবার নির্বাচন চাওয়া। বিএনপির দোষ-গুণের চেয়ে নাগরিকের জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো ভোট দিতে পারা না-পারাটা। আমরা আবার কখন ভোট দিতে পারব, আদৌ পারব কি না এবং পারলেও সেটা পাতানো নির্বাচনে হবে কি না; এসব বিএনপি নির্বাচনে এল না গেল, তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের ভোট না পেয়ে, ভোট পেয়েছে—সেটা ধরে নেওয়ার সরকার জনগণের খুব বেশি কল্যাণ করতে পারবে বলে মনে হয় না।
আর এই সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন যে গত নির্বাচনে প্রশাসন, সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব—সবই তাঁর সঙ্গে ছিল। একদম হক কথা। ছিল না শুধু জনগণ৷

শাহদীন মালিক: জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট; পরিচালক, স্কুল অব ল, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি।