পুঁজি পাচারকারীদের সেকেন্ড হোম

বাংলাদেশিদের আন্তর্জাতিক অভিবাসন এবং দেশের অর্থনীতিতে এর অভিঘাত আমার গবেষণার ক্ষেত্র। আজকের কলামে এমন কিছু বিষয়ে আলোচনার অবতারণা করব, দেশের অর্থনীতির বর্তমান বাস্তবতায় যেগুলোর অভিঘাত অত্যন্ত ক্ষতিকর পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। দেশের ৮৫ লাখ থেকে এক কোটি ১০ লাখ মানুষ বিদেশে অভিবাসী কিংবা অনিবাসী বাংলাদেশি হিসেবে বসবাস করছেন বলে ধারণা করা হয়, যার মধ্যে ২০ থেকে ২৫ লাখ অবৈধ বলে ধারণা করা হচ্ছে। কলামে আমি সংখ্যাটাকে এক কোটি বলে অভিহিত করব আলোচনার সুবিধার্থে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান শক্তির অন্যতম প্রধান স্তম্ভ বিবেচনা করা হয় এই এক কোটি বাংলাদেশি অভিবাসী এবং অনিবাসী বাংলাদেশি কর্তৃক বৈধ চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে পাঠানো ১৪ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি রেমিট্যান্স–প্রবাহকে। সোজা-সরল দৃষ্টিতে বাংলাদেশের মতো একটি অতি ঘন জনবসতিপূর্ণ দেশের জন্য আন্তর্জাতিক অভিবাসনকে আল্লাহর রহমত বলা যেতে পারে।
কারণ, প্রতিবছর বাংলাদেশের শ্রমবাজারে প্রায় ১৫ থেকে ১৭ লাখ কর্মপ্রত্যাশী মানুষ প্রবেশ করলেও দেশের অর্থনীতি সাত-আট লাখের বেশি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে আজও অপারগ রয়ে গেছে। প্রতিবছর বৈধ-অবৈধ পথে ছয়-সাত লাখ মানুষ বিদেশে চলে যাওয়ার সুযোগ না পেলে বাংলাদেশের সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে কী প্রচণ্ড বিপর্যয়কর অবস্থার সৃষ্টি হতো, তা চিন্তা করতেই ভয় লাগে!
তাই আন্তর্জাতিক অভিবাসনকে তাত্ত্বিকভাবে ‘মেধা পাচার’ হিসেবে দেখার যুক্তি থাকলেও বেকারত্ব ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির চ্যালেঞ্জের দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের মতো তুলনামূলকভাবে জনাকীর্ণ দেশের জন্য এটাকে ‘সেফটি ভাল্ভ’ হিসেবে ইতিবাচকভাবে দেখাটাই বেশি যৌক্তিক। জীবন ও জীবিকার তাগিদে বাধ্য হয়ে এই অভিবাসীরা বিশ্বের নানা দেশে ছড়িয়ে পড়লেও তাঁদের অভিবাসন-প্রক্রিয়ায় সরকারের যে খুব বেশি কৃতিত্ব নেওয়ার অবকাশ আছে, তা বলা যাচ্ছে না। বরং আমার গবেষণাগুলোয় যে বিষয়টা বারবার ফুটে উঠেছে তা হলো, পুরো অভিবাসন-প্রক্রিয়াকে ঘিরে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে লোভাতুর ‘আদম ব্যাপারী চক্রের’ দোর্দণ্ড প্রতাপ অভিবাসন–প্রত্যাশীদের শোষণ ও লুণ্ঠনের অসহায় শিকারে পরিণত করে চলেছিল কয়েক দশক ধরে।
এ জন্য বলা চলে, অন্য সব দেশের অভিবাসীদের তুলনায় এখনো বাংলাদেশের অভিবাসীরাই সবচেয়ে বেশি খরচ করে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছেন। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, ভিয়েতনাম ও মেক্সিকোর অভিবাসীদের বাংলাদেশিদের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশও খরচ করতে হয় না। বর্তমান সরকারের আমলে সরকারি উদ্যোগে কোনো কোনো দেশে জনশক্তি পাঠানোর কিছু প্রয়াস দেখা গেলেও তা এখনো উল্লেখযোগ্য সাফল্য বয়ে আনতে পারেনি। সাম্প্রতিক কালে সরকারি উদ্যোগে মাত্র ৪০ হাজার টাকারও কম খরচে কয়েক হাজার মানুষ মালয়েশিয়া যেতে পেরেছেন। ম্যানপাওয়ার এজেন্সিগুলোর মাধ্যমে আগে মালয়েশিয়া যেতে এর প্রায় পাঁচ গুণ বেশি টাকা লাগত। বোধগম্য কারণেই ব্যক্তি খাতের জনশক্তি রপ্তানিকারকেরা সরকারের এই শুভ উদ্যোগটিকে বানচাল করতে উঠেপড়ে লেগেছে এবং সরকারের সঙ্গে এই ইস্যুতে তাদের ঝগড়া ও টানাপোড়েন কয়েকটি দেশে জনশক্তি রপ্তানি-প্রক্রিয়াকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে। উপরন্তু, সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় কাতার, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশি জনশক্তি রপ্তানি ইদানীং প্রায় বন্ধ হয়ে রয়েছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, উল্লিখিত দেশগুলোর অভিবাসীদের তুলনায় বাংলাদেশি অভিবাসীদের ৯৫ শতাংশই শিক্ষা ও দক্ষতার দিক থেকে সবার চেয়ে পেছনে। তাই সবচেয়ে কম মজুরির ‘থ্রি ডি জব’গুলোই (ডার্টি, ড্যানজেরাস অ্যান্ড ডিমান্ডিং জবস) তাদের ভাগে জুটছে বেশি। কিন্তু পরিবারের মা-বাবা, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, ভাইবোনদের ভরণপোষণের দায়িত্ব পালনের জন্য বাংলাদেশের অভিবাসীরা তাঁদের এই নিম্ন আয়ের ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশই নিয়মিতভাবে রেমিট্যান্স হিসেবে দেশে পাঠাচ্ছেন। বিশ্বের রেমিট্যান্সের গন্তব্য দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান এখন ষষ্ঠ—ভারত, মেক্সিকো, ফিলিপাইন, তুরস্ক ও ইন্দোনেশিয়া বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। পাকিস্তানের প্রায় এক কোটি অভিবাসী বিদেশে থাকলেও তাঁদের রেমিট্যান্স–প্রবাহ বাংলাদেশের তুলনায় কম।
আমার গবেষণায় যে বিষয়টি রেমিট্যান্স পাঠানোর বিষয়ে উঠে এসেছে তা হলো, বাংলাদেশি অভিবাসীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ‘হুন্ডি’ পদ্ধতিতেই দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে চলেছেন, যার ফলে বিশ্বের দেশে দেশে যেখানেই বাংলাদেশি অভিবাসীদের ঘনত্ব পরিলক্ষিত হয়ে থাকে, সেখানেই হুন্ডি চক্রগুলোর হাতে অভিবাসীদের

সঞ্চয়ের বিপুল একটা অংশ পাচার হয়ে যাচ্ছে। অভিবাসীদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার এই অংশটা একটা ‘প্যারালাল বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে’ পণ্য হিসেবে ক্রয়-বিক্রয় হয়ে চলেছে। প্রধানত মার্কিন ডলারেই এই বাজারে ক্রয়-বিক্রয় চলে বিধায় এটাকে ‘হুন্ডি ডলারের বাজার’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। জোগান ও চাহিদার শক্তিশালী কাঠামো গড়ে ওঠায় ‘হুন্ডি ডলারের’ এই বাজার দেশে-বিদেশে ক্রমপ্রসারমাণ। বিশেষ করে গত তিন দশকে বাংলাদেশে বৈধ বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের সমান্তরালে এই ‘কার্ব মার্কেট’ প্রসারিত হয়ে দেশের বড়সড় নগরের সীমা পেরিয়ে দেশের আনাচ–কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন আর তেমন রাখঢাকের প্রয়োজন পড়ছে না কার্ব মার্কেটে ডলার কেনাবেচায়, এমনকি ব্যাংকারদের মধ্যস্থতায় অতি সহজেই নগদ ডলারের ব্যবসা চলছে খোলামেলাভাবে। পত্রপত্রিকায় ডলারের যে দাম প্রকাশিত হয়, তার চেয়ে এক-দেড় টাকা বেশি দামে দেদার ডলার ক্রয় করা যায় ঝামেলা ছাড়াই। কিন্তু এই হুন্ডি ডলার বাজারের কতগুলো অপব্যবহার দেশের অর্থনীতির জন্য ভীষণ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে পুঁজি পাচারকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে। আমি এগুলোর দিকেই পাঠকদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাইছি।

গত অর্থবছরে ১৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স দেশে পাঠানো হয়েছে বলে সরকারিভাবে তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করা হলেও হুন্ডি পদ্ধতিতে সারা বিশ্বের ডলার বাজারে বাংলাদেশি অভিবাসী ও অনিবাসী বাংলাদেশিরা কত পরিমাণ ডলার জোগান দিয়েছেন, তার প্রাক্কলিত তথ্য-উপাত্ত সরকারিভাবে কিংবা কোনো বিশ্বাসযোগ্য গবেষণার মাধ্যমে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। এ ব্যাপারে যে অঙ্কগুলো মাঝেমধ্যে বিভিন্নজন উদ্ধৃত করে থাকেন, সেগুলোর পেছনে ভালো গবেষণার অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে না বিধায় ওগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা বোধগম্য কারণেই প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় হুন্ডি ডলার বাজারে পাচার হওয়া বাংলাদেশি অভিবাসীদের সঞ্চয়ের এই বিশাল প্রবাহটার প্রধান ফায়দাভোগীতে পরিণত হয়েছে চোরাচালানিরা এবং দেশ থেকে বিদেশে পঁুজি পাচারকারী ব্যবসায়ী, গার্মেন্টস মালিক-শিল্পপতি, দুর্নীতিবাজ আমলা ও পুঁজি-লুটেরা রাজনীতিবিদেরা। ব্যাংক ঋণখেলাপিদের ওপর ২০১০ সালে প্রকাশিত আমার গবেষণাগ্রন্থ আ প্রোফাইল অব ব্যাংক লোন ডিফল্ট ইন দ্য প্রাইভেট সেক্টর ইন বাংলাদেশ-এ উপস্থাপিত বাংলাদেশের ১২৫টি ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের ওপর পরিচালিত জরিপের সংগৃহীত তথ্যে প্রমাণিত হয়েছে যে ওই সব প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মালিকেরা তাঁদের ব্যাংকঋণের একটা বড়সড় অংশ বিদেশে পাচার করে দিয়েছেন। বিশেষ করে ওই বইয়ে প্রকাশিত ৩১ জন ‘স্টার ঋণখেলাপির’ কেস স্টাডিতে পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে যে তাঁদের বেশির ভাগই ১৯৭২-২০০৭ পর্যায়ে ব্যাংকঋণ বাগিয়েছেন তাঁদের রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক কানেকশন

কিংবা দুর্নীতির বখরা ভাগাভাগির ‘সিস্টেমের’ ফায়দাভোগী হয়ে।
এ প্রবণতা গত সাত বছরে আরও ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এখন বাংলাদেশের ধনাঢ্য-উচ্চবিত্ত-উচ্চমধ্যবিত্ত এমনকি মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, সামরিক-বেসামরিক আমলা ও পেশাজীবীদের ধ্যান-জ্ঞান হয়ে গেছে যে তাঁদের পরিবার-পরিজন-সন্তানদের জন্য বাংলাদেশ আর বাসযোগ্য জায়গা বিবেচিত হওয়ার যোগ্য নয়, এবং তাঁদের যথাসম্ভব শিগগিরই বিদেশে পাড়ি জমাতে হবে। বলা বাহুল্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই তাঁদের বিবেচনায় স্বপ্নের স্বর্গরাজ্য। কিন্তু ওই দেশে অভিবাসী হওয়া তো খুবই দুরূহ। তাই কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, ইতালি এবং সম্ভব হলে অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে পাড়ি জমানোর প্রাণপণ প্রয়াস এখনকার সচ্ছল পরিবারগুলোর নিরলস সাধনায় পরিণত হয়েছে।
অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে আমার কাছে বিষয়টার আপত্তিজনক দিক হলো, দেশের ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের বৃহৎ অংশই ব্যাংকঋণ পাচারকেই তাঁদের এই মিশনের মূল ‘মেকানিজম’ হিসেবে ব্যবহার করছেন, যার ফলে দেশের মূল্যবান বিনিয়োগযোগ্য পঁুজি থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি বঞ্চিত হয়ে চলেছে। দুঃখজনক হলো যে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং ব্যাংকিং সেক্টরের কর্তাব্যক্তিরা এ বিষয়টাকে কার্পেটের তলায় লুকাতেই তাঁদের সর্বশক্তি ব্যয় করে চলেছেন। প্রকল্প ঋণের ক্ষেত্রে ব্যাংকারদের সহযোগিতায় ‘ইনফ্ল্যাটেড প্রজেক্ট কস্ট’ ও ‘ওভার ইনভয়েসিং’ পদ্ধতিতে কোটি কোটি ডলার যে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের বিদেশের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাচার হয়ে থাকে, এটা পুরোনো খবর। কিন্তু বিপুল পরিসরের ‘হুন্ডি ডলারের বাজার’ এখন এহেন পঁুজি পাচারকে একেবারেই সহজ করে দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, রাজনীতিবিদ ও আমলাদের ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি ও পঁুজি লুণ্ঠনের তাণ্ডব থেকে উদ্ভূত অনর্জিত কালোটাকাকে বিদেশে পঁুজি পাচারের (ক্যাপিটাল ফ্লাইট) মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি থেকে চিরতরে পলায়নের ব্যবস্থাকে ব্যাপক বেগবান করে চলেছে এই হুন্ডি পদ্ধতি। ভারতে চলে যাওয়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনও হুন্ডি ডলারের বেশ বড়সড় খদ্দের।
গত ২৮ মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসে বাংলাদেশি টিভি চ্যানেলে দুর্নীতি দমন কমিশনের একজন সদস্যকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতে দেখলাম। তাঁকে বলতেই হচ্ছে, বাগাড়ম্বর এবং কুতর্ক করে দুদকের প্রতি জনগণের হারানো আস্থা ফেরানো যাবে না। তার চেয়ে কানাডার টরন্টোর ‘বেগমপাড়ায়’ কোন কোন রাজনীতিবিদ, সামরিক অফিসার এবং সিভিল আমলার বেগমেরা পরিবার-পরিজন নিয়ে বহাল তবিয়তে বসবাস করছেন, কিংবা ঋণখেলাপি ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা কে কোন দেশে পুঁজি পাচার করে শিল্প-কারখানা-ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন এবং মালয়েশিয়ায় ‘সেকেন্ড হোম’ কিনেছেন, তার খবর নিতে একটা শক্তিশালী তদন্ত শুরু করুন। এর মাধ্যমেই দুর্নীতির গোড়ায় পৌঁছানো যাবে।

মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি৷