কাপুরুষই মেয়েদের ওপর হামলা করে

সম্প্রতি পর পর কয়েকটি উদ্বেগজনক ঘটনা ঘটে গেছে৷
নাইজেরিয়ার একটি উগ্র ধর্মীয় দল প্রায় ৩০০ স্কুলছাত্রীকে অপহরণ করে অজ্ঞাত স্থানে আটকে রেখেছে৷ অপহরণের কারণ, মেয়েগুলো স্কুলে শিক্ষা গ্রহণ করছিল৷ সন্দেহ করা হচ্ছে, বোকো হারাম নামের এই দল অপহরণকৃত মেয়েদের দেশের বাইরে পাচার করে দিয়েছে এবং জোর করে তাদের বিয়ে দিয়ে দিয়েছে৷
পাকিস্তানে পাঞ্জাবের একটি গ্রামে ২৫ বছর বয়স্ক ফারজানা পারভিন নামের সন্তানসম্ভবা একটি মেয়েকে তাঁর বাবা, চাচা ও নিকট আত্মীয়রা পালাক্রমে পাথর ছুড়ে সর্বসমক্ষে হত্যা করেছে৷ মেয়েটির অপরাধ, পরিবারের সম্মতি ছাড়া প্রেম করে বিয়ে করেছিল৷ বলা হচ্ছে, পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে এই খুন৷
ভারতের উত্তর প্রদেশে একই পরিবারের দুই জ্ঞাতিবোন প্রতিবেশী উচ্চবর্ণের যুবকদের হাতে অপহৃত হওয়ার পর ধর্ষণের শিকার হয়৷ ধর্ষণ শেষে মেয়ে দুটিকে হত্যা করে তারা গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখে৷ এ নিয়ে অভিযোগ নথিবদ্ধ করতে গেলে স্থানীয় পুলিশ প্রথমে ব্যাপারটা হেসেই উড়িয়ে দেয়৷
মেয়েদের বিরুদ্ধে এই সন্ত্রাস শুধু তৃতীয় বিশ্বের দেশেই ঘটে তা নয়, আমেরিকার মতো দেশে মেয়েদের ওপর হামলা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা৷ যেমন: এ দেশে কলেজপড়ুয়া প্রতি চারজনের একজন তাদের ছাত্রজীবনে অন্ততপক্ষে একবার হয় ধর্ষিত হয় অথবা ধর্ষণের সম্মুখীন হয়৷ তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌন নিগ্রহের শিকার হয়, এমন কলেজপড়ুয়া মেয়েদের সংখ্যা, অতি সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুসারে, কমপক্ষে ২০ শতাংশ৷ সব বয়সে মার্কিন নারীদের মধ্যে যৌন নিগ্রহের শিকার হয়—তাদের সংখ্যা প্রতি ২৮ মিনিটে একজন৷
পৃথিবীর অন্যত্র এই ছবি সম্ভবত আরও নির্মম৷ আমাদের মতো দেশে গার্হস্থ্য সহিংসতার খবর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গোপন রাখা হয়৷ খুন পর্যন্ত না গড়ালে এ নিয়ে কথা ওঠে না৷ ফলে, পরিসংখ্যানের অঙ্ক দেখে সমস্যার মাত্রা বোঝা যাবে না৷ রাষ্ট্রপ্রধান থেকে পাড়ার দারোগা, সবাই ব্যাপারটা হেসে উড়িয়ে দেন, নয়তো ধামাচাপা দিতে পারলে বাঁচেন৷ ভারতের যে দরিদ্র মেয়ে দুটি খুন হলো, তাদের কথা ধরুন৷ উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে এ নিয়ে সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করলে তাঁর উত্তর ছিল, ‘বাপু, তোমাদের এ নিয়ে এত মাথাব্যথা কেন? তোমরা তো বেশ নিরাপদে আছ৷’ একই রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, হামলা থেকে বাঁচার জন্য মেয়েদের উচিত আরও শালীনভাবে পোশাক-আশাক পরা৷ ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের প্রধান রঞ্জিত সিনহা আরও এক কদম এগিয়ে এসে বলেছেন, ধর্ষণ যদি ঠেকানো না যায়, তাহলে বুদ্ধিমানের কাজ হবে সেটা উপভোগ করা৷ জুয়া খেলার সঙ্গে তুলনা করে ভদ্রলোক (লোকটাকে ভদ্র বলা যায় কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে) বলেন, জুয়া যদি বন্ধ না-ই করা যায়, তাহলে দেখতে হবে তা থেকে মুনাফা আদায় করা যায় কি না৷ জুয়া নিয়ন্ত্রণবিষয়ক এক সভায় তাঁর এই মন্তব্য শুনে ঘরভর্তি লোক সম্ভবত হেসে গড়াগড়ি খেয়েছিল৷
এই যে মাথামোটা ও মেদবহুল মানুষগুলো মূর্খের মতো এমন সব কথা বললেন, তাঁদের কাছে জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে, নিজের কন্যা বা স্ত্রী যদি ধর্ষণের শিকার হন, তাহলেও কি তাঁরা নির্দ্বিধায় উপভোগের পরামর্শ দেবেন?
কী জানি, তাও দিতে পারেন৷ মেয়েদের ব্যাপারে, তা সে কন্যা হোক বা স্ত্রী, অনেক পুরুষেরই কোনো বাড়তি দায়িত্ববোধ নেই৷ পাকিস্তানে যে গর্ভবতী নারী প্রকাশ্যে খুন হলেন, তা ঘটেছে দিনদুপুরে, সারা পাড়ার লোকের চোখের সম্মুখে, আর কাজটা করেছে তাঁর নিকটতম আত্মীয়স্বজনই৷ এই পরিবারের পুরুষদের দাবি, পরিবারের সম্মান রক্ষার জন্যই মেয়েটিকে কোরবানি দেওয়া হলো৷ একটি মেয়েকে, তঁার নিজের স্বাদ-আহ্লাদ বিবেচনায় না এনে, পরিবারের এক কল্পিত সম্মানের কথা মাথা রেখে হত্যার মতো দণ্ড দিতে হলো৷ এমন হত্যাকাণ্ডে সম্মানের কী আছে?
অবাক কাণ্ড হলো, এমন একটা বর্বর কাণ্ডের পরেও তার সাফাই গাওয়ার লোকের অভাব নেই৷ পুলিশ বলেছে, পাথর ছুড়ে হত্যা করা হয়নি, কেউ একজন রাগের বশে একটা ইট ছুড়ে মারে৷ পুরো ব্যাপারটাই ঘটে খুব দ্রুত ও আকস্মিকভাবে৷ কেউ কেউ আবার উপজাতীয় আচার-আচরণের কথা বলে এই ঘটনার ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছে৷ এমন ব্যাখ্যার অর্থ ঘটনাটি

মেনে নেওয়া এবং হাজার বছর ধরে যাতে সে জগদ্দল পাথর মেয়েদের বুকের ওপর বসে থাকে, তা নিশ্চিত করা৷ অপরাধটা মেয়ের, এমন কথাও শোনা গেছে৷ কোনো কোনো পত্রিকা পুলিশের বরাত দিয়ে বলেছে, মেয়েটির নাকি অন্য এক পুরুষের সঙ্গে আগে বিয়ে হয়েছিল৷ সেই
বিয়ে বাতিলের আগেই মেয়েটি অন্য এক পুরুষের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন৷
সোজা কথা, যে যা-ই বলুক, সব দোষ ওই মেয়েরই৷ আমাদের মধ্যযুগীয় মূল্যবোধে মেয়েদের তরফ থেকে পান থেকে চুল খসলেই সম্মানহানি হয়৷ ছেলেদের বেলায় এর চেয়ে ১০ গুণ বেশি অপরাধ করলেও সাত খুন মাফ৷ ফারজানা যে কারণে খুন হলেন, সেই একই কারণে তাঁদের পুত্রসন্তানটিকে বলি দেওয়ার কথা কি কেউ ভাববেন?
মেয়েদের ব্যাপারটা আমরা কতটা উপেক্ষার সঙ্গে দেখি, তার ভালো প্রমাণ নাইজেরিয়ার স্কুলছাত্রী অপহরণের ঘটনাটি৷ দুই মাস হয়ে গেল, এ নিয়ে বিবৃতি দেওয়া ছাড়া দেশের সরকার খুব একটা কিছু করেনি৷ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন সাহায্যের প্রস্তাব করলে প্রথমে তা নিতে অস্বীকার করা হয়৷ এমন একটা বর্বর ঘটনা ঘটে গেল, অথচ অন্য কোনো আফ্রিকান বা মুসলিম দেশে এ নিয়ে উচ্চবাচ্য ওঠেনি৷ সালমান রুশদি একখানা বই লিখলে সে বই না পড়েই কেউ কেউ দাঙ্গা বাধাতে প্রস্তুত, অথচ এমন একটা অপরাধ হয়ে গেল, তা নিয়ে রা নেই৷
এই মুখ বুজে মেনে নেওয়া শুধু অনগ্রসর দেশের সমস্যা নয়৷ ১৯৯০ সালের আগে আমেরিকায় মেয়েদের বিরুদ্ধে সহিংসতা নিরোধে কোনো ভিন্ন আইন ছিল না৷ আমেরিকার চলতি ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, তখন তিনি সিনেটর বাইডেন, গার্হস্থ্য নিগ্রহসহ মেয়েদের বিরুদ্ধে সব রকম সহিংসতার বিরুদ্ধে একটি আইন প্রস্তাব করলে তাঁর নিজের দলের লোকেরাই তঁাকে নিরস্ত করতে চেয়েছেন৷ বাইডেনকে এই আইন পাস করতে চার বছর একটানা লড়াই করতে হয়েছে৷ শেষ পর্যন্ত সেই আইন গৃহীত হয় আপসরফার মাধ্যমে৷ সে সময় তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘প্রতিবছর কোনো একটা ব্যাধিতে ৩০-৪০ লাখ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, এমন কথা জানাজানি হলে তা নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড হবে৷ আশু ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রচণ্ড চাপ আসবে৷ অথচ প্রতিবছর ৩০-৪০ লাখ মেয়ে সহিংসতার শিকার, তাদের ব্যাপারে আমরা বিনা দ্বিধায় মুখ বুজে থাকতে প্রস্তুত৷’
পুরুষেরা মুখ বুজে থাকবে, সেটা স্বাভাবিক৷ মেয়েদের ওপর মালিকানা খাটানো তাদের জন্মসূত্রে পাওয়া অধিকার৷ তাদের বাধ্য না করা হলে সে অধিকার তারা ছাড়বে কেন! পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে—ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান তাদের অন্তর্গত—ইতিমধ্যে মেয়েদের বিরুদ্ধে সহিংসতা রোধে কঠোর আইন হয়েছে৷ এটা অবশ্যই অগ্রগতি, কিন্তু সে অগ্রগতির কারণ এই নয় যে আমাদের মাতবর পুরুষেরা একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ঠিক করল, না, আজ থেকে আর বউ পেটাব না৷ বস্তুত, এই পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে মেয়েদের দাবির কারণেই৷ অর্ধশতক ধরে বিশ্বজুড়ে নারী অধিকারের পক্ষে অভাবনীয় আন্দোলন গড়ে উঠেছে৷ মেয়েরা নিজেরাই সেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, ভীতির বাতাবরণ উপেক্ষা করে তাতে শরিক হয়েছেন৷ এ থেকেই বোঝা যায়, পরিবর্তন আসে পরিবর্তনের দাবি উঠলে, অন্যথায় নয়৷
অস্বীকার করার উপায় নেই, নারীর সামাজিক মর্যাদার আইনগত স্বীকৃতি মিলেছে৷ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনে নারীর সম-অধিকার স্বীকৃত হয়েছে৷ কিন্তু আইন প্রতিপালন না হলে সে আইন বড়জোর এক টুকরা কাগজ, তার বেশি কিছু নয়৷ আমাদের মতো দেশে এখনো যে অহরহ মেয়েদের ওপর হামলা চলছে, তার কারণ সহিংসতার বিরুদ্ধে আইন থাকলেও সে আইনের প্রতিপালন নেই৷ সে কারণে মেয়েদের বিরুদ্ধে সহিংসতা এখনো বিশ্বজুড়ে একটি সংক্রামক ব্যাধি হয়ে রয়েছে৷
শুধু কাগুজে আইনে মেয়েদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ঠেকানো যাবে না; যে মূল্যবোধের কারণে আমরা মেয়েদের যোগ্য সামাজিক মর্যাদা দিতে অস্বীকার করি অথবা মুখে কুলুপ এঁটে থাকি, আসল লড়াই হলো সেই মূল্যবোধের বিরুদ্ধে৷
১০ জুন ২০১৪, নিউইয়র্ক

হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷