বাপি, তুমি কি শুনতে পাচ্ছ...

চন্দন সরকারের সঙ্গে মেয়ে সুস্মিতা সরকার
চন্দন সরকারের সঙ্গে মেয়ে সুস্মিতা সরকার

বাপি, তুমি কি শুনতে পাচ্ছ তোমার অভাগা মেয়ের কথা? তোমার অসমাপ্ত প্যাডে তোমাকে নিয়ে লিখতে বসেছি৷ খুব পছন্দ ছিল তোমার এই স্পাইরাল বাইন্ডিং খাতাগুলো৷ বাপি, তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে, আজ আমার জন্মদিন! কী করে ভুলবে প্রতিবছর এই দিনকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য কত রকম উপহার নিয়ে অপেক্ষায় থাকতে৷
কী অদ্ভুত! আজকে আমিও তোমার জন্য উপহার নিয়ে বসে আছি৷ কেন বলো তো? আজ যে বাবা দিবস৷ ১৯১০ সালের এই দিনে একটি মেয়ে সনোরা স্মার্ট ডড সম্পূর্ণ নিজ উদ্যেগে তাঁর বাবার প্রতি অসীম ভালোবাসা থেকে দিবসটি পালন করা শুরু করেন; যদিও তিনি ১৯০৮ সালের ৫ জুলাই আমেরিকার পশ্চিম ভার্জিনিয়ার ফেয়ারমেন্টের এক গির্জায় দিনটি পালিত হওয়ার কথা কিছুই জানতেন না৷
বাবা দিবসে সন্তানের সামনে সুযোগ আসে তার বাবাকে অন্তরের অন্তস্তল থেকে কৃতজ্ঞতা জানানোর৷ দিবসটি নানা দেশে নানাভাবে পালিত হয়৷ কিন্তু একটি ক্ষেত্রে বিশেষ মিল রয়েছে৷ এদিন সব সন্তানই তার বাবাকে কিছু না কিছু উপহার দিতে পছন্দ করে৷
ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! এই দুটি দিন এই প্রথম এক হয়ে গেল আমার জীবনে৷ কতটা স্মরণীয় হতে পারত, অথচ দুর্ভাগ্যের ভয়াল থাবায় উপহার তো দূরের বিষয়, তোমাকে একবার প্রাণভরে দেখব, তোমার ডাক শুনব, সেই সুযোগটুকুও হলো না এই অভাগা সন্তানের৷
সব সন্তানের মধ্যে বাবা আমাকে যেন একটু বেশিই স্নেহ করত, নাকি ছিল নির্ভরশীলতা, বিশ্বাস৷ কিন্তু তোমার এই বিশ্বাস, নির্ভরশীলতার কোনো কিছুই রক্ষা করতে পারিনি, বাপি৷ তুমি হারানোর পর ফিরে পাওয়ার আশায় দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছি৷ সবাই সান্ত্বনা দিয়েছে ফিরে পাওয়ার৷ ফিরিয়ে তো দিয়েছে, তবে জীবন্ত নয়৷ পিতৃহারা সন্তানের নিরবধি কান্না কি তারা শুনতে পাচ্ছে?
কিন্তু কেন? কেন মেনে নিতে হবে এই নির্মম পরিণতি? কী অপরাধ ছিল তার? যে মানুষটি জাত-ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে হৃদয় থেকে এত ভালোবাসা দিয়ে গেছে, বিনিময়ে তার এই পুরস্কার জুটল!
সবার মনে হয়তো প্রশ্ন, কেন তাকে নিয়ে এত জাগরণ সৃষ্টি হলো৷ সে যে সাধারণের মধ্যে একজন অসাধারণ মানুষ ছিল৷ সব সময় আমাদের কাছে বলত, ‘শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় বড় হওয়া কোনো কৃতিত্বের বিষয় নয়, তুমি বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন না করলে কখনোই প্রকৃত মানুষ হতে পারবে না৷’ নিজের জীবনে তার সার্থক প্রতিফলন ঘটিয়েছে৷ বাবা নিজেকে শুধু আইন পেশায় ব্যস্ত রেখেছে তা-ই নয়, একটু অবসর পেলেই তার সঙ্গী হতো কবিতা, গান অথবা বাঁশি৷ এত ব্যস্ততার মধ্যেও দুটি কবিতার বই প্রকাশ করেছে, রেখে গেছে আরও অনেক অসমাপ্ত লেখা৷
শুধু তা-ই নয়, তার মধ্যে প্রকৃতিপ্রেম ছিল অনেক গভীর৷ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের তার পৈতৃক বাড়িটি স্বাধীনতার সময়ে হারানোর পর প্রতিবছর সেখানে একবার করে ছুটে যেত শুধু তার হাতে লাগানো গাছগুলো একবার দেখার জন্য৷ তারপর অনেক আশা নিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জের জালকুঁড়িতে সেই আদলে একটি বাড়ি বানাল৷ সেই দখিনা জানালা, গাছের নির্মল হাওয়ায় নিরিবিলি পরিবেশে সাহিত্যচর্চা করবে৷ অনেক বাধা দিয়েছিলাম, এত জনমানবশূন্য স্থান নিরাপদ হবে তো? প্রশান্তির হাসি হেসে বলত, ‘এখানে আমার কিছুই হবে না৷ নারায়ণগঞ্জ তো আমার অস্তিত্বের অংশ, এখানে সবাই আমাকে অনেক ভালোবাসে৷’
ছোটবেলায় বিদ্যুৎবিভ্রাট হলে আমাদের ছাদে নিয়ে যেত কখনো বা মুগ্ধ করত তার দরাজ গলায় গান অথবা সুরেলা বাঁশির শব্দে৷ এখনো অন্ধকার হলে আমি যেন শুনতে পাই তার সেই সুরেলা বাঁশির শব্দ৷ বাংলা, ইংরেজি উভয় ভাষাতেই নির্ভুলভাবে অনর্গল কথা বলতে পারত বাবা৷ তার জ্ঞানের গভীরতা আমাদের অবাক করত৷ আমরা তার নাম দিয়েছিলাম ‘চলন্ত লাইব্রেরি’! বলতাম, তোমার কাছে এলে তো সব বিষয়ই জানা যায়, বই দেখার প্রয়োজন নেই৷ তবে তার অসাম্প্রদায়িক মনোভাব আমাকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করত৷ খুব ছোটবেলাতেই লক্ষ করতাম, তার লাইব্রেিরতে স্থান করে নিয়েছে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ গীতা, আল কোরআন, বাইবেলসহ বিভিন্ন ধর্মের বহু বই৷ বলত, ‘যত দিন উপলব্ধি হবে না যে সব ধর্ম এক, সব মানুষ সমান, তত দিন প্রকৃত মানুষ হবে না৷’ যদি তা-ই হয়, তবে যারা তোমাকে নির্মমভাবে এই নিষ্ঠুর পরিণতি দিয়েছে, তাদের আর তোমার মধ্যে এত পার্থক্য হলো কীভাবে? কোনো জবাব নেই, জানি কোনো দিন পাবও না৷
তাই আজ তোমাকে হারানোর বেদনা দিয়ে তোমারই কবিতার মধ্যে তোমাকেই খুঁজে বেড়াই...
তিনি আজ নেই৷ মনে হয় সেই আঙুলের ছোঁয়া আজও
অস্তিত্বের অন্ধকারে
আলোর মিছিল৷ আমি টের পাই৷ কেউ ছুটে আসে—যেন
দেয়ালে ঝুলানো ছবি ফিরে পায় জীবন আবার৷
বলে, ‘ভয় নেই৷ আমি চিরকাল তোমার পাশেই৷ ঘন কালো
মেঘ৷ অমানিশা৷ অন্ধকার? মনে করো কিছু নয়৷ তুমি
ছুঁয়ে আছে আমার আঙুল৷’
সুস্মিতা সরকার: নারায়ণগঞ্জের নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের মেয়ে৷