উপদলীয় কোন্দলে মার্কিন মদদের খেসারত

ইরাকে সুন্নি জঙ্গিদের অগ্রাভিযান
ইরাকে সুন্নি জঙ্গিদের অগ্রাভিযান

ইরাকি শিয়া যোদ্ধারা বাগদাদের রাস্তায় রাইফেল হাতে ১৩ জুন টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে নেচে নেচে স্লোগান দিচ্ছিলেন, ‘লাবেইকি ইয়া জয়নাব’৷ দৃশ্যত, তাঁরা আরও কঠিন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন৷ তাঁরা মনে করেছেন, জয়নাবে আহ্বানে সাড়া দেওয়াই হবে সবচেয়ে কার্যকর স্লোগান৷ জয়নাব হচ্ছেন ইসলামের মহান খলিফা হযরত আলীর মেয়ে, ১৪ শতক আগে যিনি মদিনায় বসবাস করতেন৷ সে সময়েই শিয়ারা ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে৷ যে রাজনৈতিক কলহের ওপর ভিত্তি করে এই গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছে, তার ফলাফল এখনো দৃশ্যমান৷
এই স্লোগান থেকেই বোঝা যায়, ইরাকের চলমান যুদ্ধের উপদলীয় চেহারা কতটা মারাত্মক৷ সাম্প্রতিক সময়ে এটা আরও চরমে উঠেছে৷ ইসলামি স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড শ্যাম (আইসিস) নামের সংগঠন থেকে এক হাজারের কিছু কমসংখ্যক সেনা ১০ জুন ইরাকের বৃহত্তম শহর মসুলের বিরুদ্ধে অভিযানে নামলে ইরাকের সেনাবাহিনীর প্রায় ৩০ হাজার সদস্য প্রাণের ভয়ে পশ্চাদপসরণ করেন৷ ইরাকের সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় শিয়া নেতা আয়াতুল্লাহ আলী আল-সিস্তানি এক বিবৃতিতে অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার আহ্বান জানান৷ কারবালায় শুক্রবারের নামাজে তাঁর পক্ষে এই বিবৃতি পড়ে শোনানো হয়৷ এতে বলা হয়, অস্ত্র হাতে নিতে এবং সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণে সক্ষম ব্যক্তিদের এই মহান লক্ষ্য অর্জনে নিরাপত্তা বাহিনীতে যোগ দেওয়া উচিত৷
সিস্তানি যে সন্ত্রাসীদের কথা বলছেন, তারা এই আইসিস ও এর সদস্য৷ সংখ্যায় তারা বড়জোর সাত হাজার হবে৷ কিন্তু তারা সুসংগঠিত, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত৷ আচার-আচরণে অত্যন্ত হিংস্র৷ মসুল দখলের এই অসামান্য অর্জনকে স্থায়ী করতে তারা এখন দক্ষিণের শহরগুলোর দিকেও ছুটছে৷ ১১ জুন বাইজি আক্রমণ করে তারা শহরটি দখল করে নেয়৷ একই দিন দখল করে তিরকিত, এটি ইরাকের সাবেক রাষ্ট্রপতি সাদ্দাম হোসেনের শহর৷ সেখানে সাবেক বাথপন্থী যোদ্ধারাও তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে৷
দুই দিন ধরে তারা সামারা দখলের চেষ্টা করেছে, কিন্তু পারেনি৷ তারপর তারা জালাওয়ালা ও সাদিয়াহর দিকে চলে যায়৷ আইসিসের দখলে চলে যাওয়া শহরগুলোয় কী হচ্ছে বলা মুশকিল৷ কিন্তু সিরিয়াতে তারা যেরূপ রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়েছে, তা দেখে এবং সংগঠনটির নিজস্ব অনলাইন প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বলা যায়, সেখানকার অবস্থা ভালো নয়৷
কিছুদিনের মধ্যে এত বেশি এলাকা আইসিসের দখলে চলে গেছে যে সেখানে এক নতুন রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করা অসম্ভব কিছু নয়; ঔপনিবেশিক ফ্রান্স ও ব্রিটেন এক শতাব্দীকাল আগে ঠিক এ রকম স্বপ্নই দেখেছিল৷ ভবিষ্যতে কী আছে, তা বলা মুশকিল৷ আরও একবার ইরাকের ভেতর ঢুকতে হবে, এই চিন্তায় পশ্চিমের ঘুম হারাম হওয়ার উপক্রম৷ পশ্চিমা হস্তক্ষেপের এটাই ছিল আদিরূপ৷ সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ বুশের জামানার নব্য রক্ষণশীল কর্তাদের অবিমৃশ্যকারিতার কারণে এই দ্বন্দ্ব-সংঘাত শুরু হয়৷ তাঁরা ভুল স্বীকার করে ২০১১ সালের ডিসেম্বর মাসে পিঠটান দেন৷ যদিও তাঁরা আশা করেছিলেন, ইরাকের নতুন শিয়া প্রধানমন্ত্রী নুরি-আল-মালিকির সরকারের ওপর তাঁরা প্রভাব বিস্তার করতে পারবেন, কিন্তু এ লক্ষ্যে তাঁরা কামিয়াব হতে পারেননি, বরং সবকিছু লেজেগোবরে হয়ে যায়৷ আর এখন বাগদাদে প্রভাবশালী বিদেশি শক্তি হচ্ছে ইরান৷
বাস্তবে ইরাকে বর্তমানে ইরানি প্রভাব এত শক্তিশালী যে বারাক ওবামার প্রশাসন যতই শক্তির আস্ফালন দেখাক না কেন, সেখানে এখন ইরানের সহায়তা ছাড়া এই দ্রুত পরিবর্তনশীল বাস্তবতার মোড় ঘোরানো সম্ভব হবে না৷ মার্কিন ও ব্রিটিশ মিডিয়ার খবর অনুসারে, শুধু ইরাক নয়, সিরিয়াতেও আইসিসকে ঠেকাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান জুটি বাঁধতে যাচ্ছে৷ ইতিহাস লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে চলেছে৷ যেসব জোটের কথা আগে ভাবা যেত না, খুব দ্রুতই সেসব জোট গঠিত হচ্ছে৷ মানচিত্র নতুন করে আঁকা হচ্ছে, আর সেটাও হচ্ছে রাইফেল হাতে খোলা জিপে ঘুরে বেড়ানো মুখোশ পরিহিত সৈন্যদের অঙ্গুলিহেলনে৷ এটা ঠিক, কেউই ভাবেননি পরিস্থিতি এরূপ মোড় নেবে৷ কিন্তু যাঁরা বলেছিলেন, ইরাক যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছিল, তাঁরা আসলে ঠিক এটাই মনে করেছিলেন৷
বুশ যখন আল-কায়েদা হটাতে ইরাকে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন, তখন এই দলটির কোনো অস্তিত্ব ছিল না৷ আত্মাভিমান, সত্য সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং ইরাকের ইতিহাস

সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে বুশ প্রশাসন এই ভয়াবহ যুদ্ধ চালিয়েছে৷ লাখ লাখ ইরাকি এ যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে৷ যাদের হত্যা করা হয়নি, তাদের পিটিয়ে বিকলাঙ্গ করা হয়েছে, ধর্ষণ ও নির্যাতন করা হয়েছে৷ অথবা তারা ইরাকের ধু ধু প্রান্তরে দুঃসাহসিক অভিযানে নেমেছে৷
আমেরিকা নানাভাবে ইরাকের সঙ্গে ইঁদুর-বিড়াল খেলা খেলেছে৷ তারা সেনাবাহিনী ভেঙে দিয়েছে, সব সরকারি প্রতিষ্ঠান বাতিল করেছে৷ পেন্টাগন ও ভার্জিনিয়ায় বসে থাকা সিআইএ বিশ্লেষকদের মতামত অনুসারে সেখানে নতুন এক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে৷ মার্কিনরা সুন্নি মুসলমানদের অত্যাচার করেছে৷ শিয়াদের ক্ষমতায়ন করেছে৷ আর পরিণতির কথা না ভেবেই উপদলীয় কোন্দলে তেল-জল জুগিয়েছে৷ যখন সবকিছু পরিকল্পনা মাফিক হয়নি, তখন তারা কোনো এক শিয়া গ্রুপকে অপর শিয়া গ্রুপের চেয়ে বেশি পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে৷ আবার কোনো কোনো সুন্নি গোষ্ঠীর হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে সামগ্রিকভাবে মার্কিনদের বিরুদ্ধে ইরাকের প্রতিরোধ যুদ্ধ নস্যাৎ করে দিয়েছে৷ এসবের পরিণতি হয়েছে খুব মারাত্মক৷ ২০০৬-০৭ সালে ইরাকের গৃহযুদ্ধে লাখো মানুষ মারা গেছে৷ কোনো ছলচাতুরীর নির্বাচন দিয়ে ক্ষত সারানো সম্ভব ছিল না৷ নির্যাতনের কোনো কৌশলেই বিদ্রোহ দমন করা সম্ভব ছিল না৷ উপদলীয় কোন্দল ও নৃতাত্ত্বিক বিন্যাস নিয়ে যতই জল ঘোলা করা হোক না কেন, কাঙ্ক্ষিত ‘সাম্যাবস্থা’ ফিরিয়ে আনা সম্ভব ছিল না৷
২০১১ সালের ডিসেম্বর মাসে আমেরিকা ইরাক ছেড়ে চলে যায়৷ কিন্তু যে যুদ্ধ তারা শুরু করেছিল, সেটার শেষ তারা দেখে যায়নি৷ ইরাকে এখন যা হচ্ছে, তা মার্কিন সৃষ্ট দাঙ্গা-হাঙ্গামারই অংশ৷ এটা বিশেষ গুরুত্ববহ ব্যাপার যে আইসিসের নেতা আবু বাকের আল-বাগদাদি সামারা থেকে আগত একজন ইরাকি৷ তিনি মার্কিনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন৷ এমনকি ধরা পড়ার পর তাঁকে ইরাকের সর্ববৃহৎ মার্কিন কারাগার ক্যাম্প বুকায় পাঁচ বছর আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়৷
এটা বলা ঠিক হবে না যে ইরাকের মার্কিন কারাগারে আইসিসের জন্ম হয়েছে৷ এই আইসিসকে আরও গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে হবে৷ কারণ এর জন্ম হয়েছে এই চলমান দ্বন্দ্বের গহিন থেকে৷ ধর্মের নামে মুখোশ পরে নির্দয়ভাবে যারা মানুষ মারছে বা গলা
কাটছে, তারা আসলে কী কারণে তা করছে, এটা যেমন রহস্যজনক, ঠিক তেমনি এই আইসিসও রহস্যজনক৷
কিন্তু এতে কোনো ভুল নেই যে ইরাকিদের ওপর আমেরিকার চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ, বিশেষ করে সুন্নিদের ওপর নিপীড়ন এই আইসিস গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে৷ সংগঠনটির নৃশংসতা চালানোর ক্ষেত্রেও এর ভূমিকা আছে৷ আইসিস যেসব এলাকা দখল করেছে, তারা তা ধরে রাখতে পারবে কি না, সেটা পরিষ্কার নয়৷ বিশেষ করে যখন শিয়ানিয়ন্ত্রিত বাগদাদ, ইরান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একজোট হয়েছে, তখন তাদের টিকে থাকা কঠিন৷ কিন্তু কিছু বিষয় পরিষ্কার: সুপরিকল্পিতভাবে ইরাকের সুন্নি সম্প্রদায়কে ক্ষমতাকাঠামোর প্রান্তে ঠেলে দেওয়াটা অর্থহীন, এটা টিকবে না৷ মার্কিন আগ্রাসনের ফলে যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, সেখান থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে এক নতুন সামাজিক ও রাজনৈতিক বর্গ তৈরি করতে হবে৷ ইরানের হস্তক্ষেপসহ অন্যান্য দেশের হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য৷
এই বিবাদ এমন জট পাকিয়ে উঠেছে যে ইরাকে কোনো রাজনৈতিক মীমাংসা করতে হলে সিরিয়ার আদলেই তা করতে হবে, যে সিরিয়া বর্তমানে নৃশংসতার ভিত্তিভূমি হয়ে উঠেছে৷ সিরিয়ার সরকার, বিরোধী পক্ষ ও আইসিস—সবাই এর জন্য দায়ী৷ এই মৌলবাদী তৈরির কারখানা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বন্ধ করতে হবে, যাতে করে সিরিয়া ও তার সম্প্রসারণক্রমে ইরাকের ক্ষতও উপশম করা যায়৷
হংকংভিত্তিক এশিয়া টাইমস অনলাইন থেকে নেওয়া; ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন

রামজি বারুদ:
মধ্যপ্রাচ্যের সাংবাদিক৷