সলমা-জরির ফুল ও বিহারি দণ্ডকারণ্য কথা

সলমা-জরির অন্ধকার ইতিহাস
‘বন্ধু, তোমার হাতের উপর হাত রাখলেই আমি টের পাই তোমার বাজারে অনেক দেনা, ছেলেটা উচ্ছন্নে গেছে, মেয়ে রাত করে বাড়ি ফেরে, আজ যা–বলার আছে তুমি আমাকেই বলো, স্ত্রীর মুখরতার কথা বলো, সহকর্মীদের শঠতার কথা বলো, রাতে ঘুম হয় না সেই কথা বলো, আর যদি কাঁদতেই হয় তবে এই কাঁধে মাথা রেখে কাঁদো, বন্ধু।’ কবিতাটি পশ্চিমবঙ্গের কবি উৎপলকুমার বসুর সলমা-জরির কাজ বইয়ের৷ এর সঙ্গে মিরপুরের বিহারি ক্যাম্পের সলমা-জরি ও বেনারসিশিল্পীদের জীবনের সরাসরি সম্পর্ক নেই৷ কিন্তু এই কবিতার দুঃখ আর মিরপুরের নিহত-লাঞ্ছিত-ভাগ্যহত মানুষের জীবনের মধ্যে কোথায় যেন একটা টনটন মিল৷
ক্যাম্পের অলিগলিতে ঘুরতে ঘুরতে মনে হবে, জীবনের রূপ-রস-গন্ধ এখানে নেই৷ হাজার হলেও জীবের জীবন৷ সেই জীবনের সব কাজ-খাওয়া-ঘুম-রান্না-রতি-হাসিকান্না সব আট বাই দশ ফুট ঘরেই সারতে হয়৷ মেঝেতে বসে দুজন হয়তো কাপড়ে জরির কাজ করছে, তিন-চারজন মিলে চৌকিতে বসে কাগজের ঠোঙা বানাচ্ছে৷ ছেলেমেয়েরা তার মধ্যেই ঘুরঘুর করছে, গলিপথে খেলছে৷ যার চোখে মায়া আছে, সে দেখতে পাবে ‘মানুষ’ থাকার জন্য জীবগুলোকে প্রতিনিয়ত কী রকম ‘বিদ্রোহ’ করে যেতে হয়! স্ত্রী-সন্তান-স্বজন হারানো মানুষের মুখের গহ্বরে, গুলি খাওয়া মৃত্যুতে, নির্যাতনের চিহ্নে আর প্রতিবাদে যা প্রকাশ পায়, তা মানুষেরই ভাষা৷ রামু-সাঁথিয়ায় সেই ভাষা বাংলা, বিহারি ক্যাম্পে তার নাম উর্দু৷ কিন্তু যাদের জীবনে যাপন নেই, তাদের শোক কি জায়েজ?
সোনালি-রুপালি সুতা দিয়ে তারা কাপড়ে ফোটায় অপূর্ব সলমা-জরির নকশা, কারচুপির লতাপাতা-ফুল৷ এই জরির নকশা, সুতার ফুলতোলা জামা-শাড়ি তারা পরতে পাবে না৷ তাদের জীবনে এসব সুন্দরের প্রবেশাধিকার নেই৷ অথচ তারাই কি না আঙুলের যত্নে ফোটায় সূক্ষ্ম কারুকাজ৷ এটুকুই তাদের মনের সুকুমার সৌন্দর্যের পাবলিক সাক্ষ্য৷ এসব কারুকাজের মধ্যে গোপনে হয়তো তারা বাঁচিয়ে চলেছে হারানো দেশ-জীবনের কৌম স্মৃতি৷ তাণ্ডবের স্মৃতি ধরে রাখতে তারা জমা করেছে গুলি-টিয়ারের সাক্ষ্য–প্রমাণ৷ যুগের পর যুগ দেশহীন, অধিকারহীন রেখেও, পুড়িয়ে মেরেও তাদের এই সুকুমার মন আর এই প্রতিবাদী জেদ ধ্বংস করা যায়নি৷ তাদের হাতের ওপর হাত রাখলেই টের পাই, শিরার দপদপানিতে রোদন করছে এক অন্ধকার ইতিহাস৷ দেশভাগ শেষ হলেও, জাত–পরিচয়ের ভাগাভাগির জের বিহারিদের জীবনে আজও চলমান৷

‘কানুন নাই সাহারা নাই’

অস্ত্রের বাজারের ছবি দেখেছি, কিন্তু যুদ্ধরত দেশ ছাড়া আর কোথাও ‘ইউজড’ অস্ত্রের প্রদর্শনী দেখিনি৷ ‘যুদ্ধাহত’দের ছবি দেখেছি, কিন্তু গায়ে নির্যাতনের চিহ্ন বহন করাদের এত বড় সমাবেশ দেখিনি৷ গত বুধবারে কালশীর বিহারি ‘ক্যাম্পে’ যখন পেঁৗছি তখন দুপুর৷ রাস্তার মধ্যে কাপড়ের ওপর সাজানো ছোটখাটো এক যুদ্ধের অবশেষ: ডজন খানেক টিয়ার শেলের খোল, বেশ কিছু ছররা গুলি ও তার খোল, রাবার বুলেট ইত্যাদি৷ এক বৃদ্ধা এসবের দিকে আঙুল তুলে বললেন, ‘গুলি খায়া কা হাম৷ হামাদের জন্য কানুন নাই সাহারা নাই?’
আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায়৷ দলটির প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৬-এর দাঙ্গার সময় হাজার হাজার বিহারিকে বিহার থেকে ট্রেনে করে এনে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন৷ স্বাধীনতার আগেও তিনি বিহারি-বাঙালি দাঙ্গা থামাতে ছুটতেন৷ ইতিহাসের পরিহাস, তঁার দলের লোকজনই আজ বিহারিদের বিনাশ করছে৷
‘বিহারির বাচ্চারা কত খারাপ’
বদনামই যাদের ‘নাম’, তাদের কথা শুনবে কে? বেনারসিশিল্পী বদরুদ্দীন (৪০) তবু শোনাতে চান: ৪৩ বছর ধরে পড়ালেখা নাই, কাজ নাই৷ শিক্ষা পাইনি৷ ৮ বাই ১০ ফুট ঘরে পরিবেশ কোথায়? তাই রাস্তায় খেলে বলে বিহারির বাচ্চারা খারাপ৷ খেলতে গিয়ে বাঙালিদের সঙ্গে গন্ডগোল হলেও দোষ হয় আমাদেরই৷ রাতে কারেন্ট চলে গেলে গরমে অতিষ্ঠ বউ-বাচ্চা নিয়ে রাস্তায় গিয়ে বসে থাকি৷ রাস্তায় বসি বলেও আমরা খারাপ৷
নিউ কুর্মিটোলা ক্যাম্পের ভেতরের পানির কলের চত্বরে দাঁড়িয়ে গৃহিণী শরিফা বলছিলেন, ‘পাকিস্তান আমলে আওয়ামী লীগকে

ভোট দেইনি বলে জীবন গেছে৷ তাই এবার আমরা জয় বাংলা বলে ভোট দিতে গেছি৷ যাতে জীবন বঁাচে৷ পানিত থাক্যা কুমিরের সাথে গন্ডগোল করা যায় না৷’ তবু গন্ডগোল লাগে৷ সেই ‘গন্ডগোলের’ ছয় দিন পরেও ইমরান মিয়ার ভয়, ছয় দিন হইল কাজে যাই না৷ আড়াই হাজার জনের নামে মামলা দিসে৷ বাইরে গেলেই যদি ধরে, মারে?’ তাই ধারদেনা করে চলতে হচ্ছে৷ সহিংসতার ভয় আর শোকের মধ্যে অবরুদ্ধ এক দ্বীপ যেন কালশীর কুর্মিটোলা ক্যাম্প৷

শরীর সাক্ষী, জীবন সাক্ষী

রামুতে শোনা গেছে, সঁাথিয়ায়ও শুনেছি, ‘স্বাধীনতার পর এমনটা দেখিনি৷’ কালশীর বদরুদ্দীন বলছিলেন, ‘৪০ বছরে বাঙালিদের সাথে সমস্যা হয়নি৷ তারাও তো আমাদের সাথে কাজ করে, আমাদের ভাষা বোঝে৷’ রামুর বৌদ্ধ, সাঁথিয়ার হিন্দুদের কথায়ও এই দাবি ছিল যে আগে এমন বিপদ আসেনি৷ যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ; এটা সবাই বলে৷ সমস্যা অতীতেও ছিল৷ তাহলেও রামুতে-সঁাথিয়ায় বা কালশীতে প্রকাশ্যে প্রশাসনের মদদে যা হয়েছে, তা পাহাড়ে ঘটলেও রাজধানীতে অভূতপূর্ব৷ গরিব হলে বিপদ, সংখ্যালঘু হলে বিপদ; অবাঙালি ও অমুসলিম হলেও বিপদ৷ তাহলেও সংখ্যার বিষয়টা প্রধান নয়, প্রধান হলো ক্ষমতাবঞ্চনা৷ মাত্র ১ শতাংশ লোক ৮৫ শতাংশ মুসলমান, ৯৫ শতাংশ বাঙালির ভাগ্যবিধাতা৷ যখন ‘কানুন নেই, সাহারা নেই’; তখন সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরুর জীবন হয়ে পড়ে একই রকম অরক্ষিত৷
বৃদ্ধা কলিমের মায়ের কপালে কাটা দাগ৷ বেছনী বেগমের মাথায়ও ইট পড়েছিল৷ তঁারা বসে ছিলেন ক্যাম্পের সবেধন, বিধ্বস্ত ডিপ টিউবওয়েল ঘিরে৷ একসঙ্গে তঁারা বলতে থাকলেন, ‘পুলিশ বাঙালি পোলাগুলারে কইতাছে, আগুন ধরা৷ যারাই আগাইতেছে তাগোই গুলি করতাছে৷ আজাদও তো আগুন নিভাইতে যাইয়া গুলি খাইয়া মরসে৷ পুলিশ গ্যাস না ছাড়লে হয়তো মানুষগুলারে বঁাচাতে পারতাম’৷ বিহারি ক্যাম্পের ইট-কাঠ-টিন এবং শিশু-বুড়ো-তরুণের শরীর সাক্ষ্য দিচ্ছে৷ কানুন থাকলে, বিচারের জন্য এটুকুই যথেষ্ট৷
বাইরে বাংলাদেশি, ভেতরে শরণার্থী
ক্যাম্পের ভেতরের ইমামবাড়া৷ সেখানে লাল সালুতে আগরবাতির সঙ্গে কম্পিউটারের চিপসও রাখা৷ কম্পিউটার সারাই যার পেশা, সে কি কম্পিউটারের যন্ত্রাংশই মুর্শিদের নামে উৎসর্গ করল? বৃদ্ধ জরিফা বেগমের পা ভাঙা; শিশু নাতনিকে বঁাচাতে গিয়ে পুলিশের লাঠিতে এই দশা তঁার৷ তঁার পেছনের দরজায় বাংলাদেশের পতাকার স্টিকার লাগানো৷ কোনো কিশোরের কাজ৷ তারা পাকিস্তান দেখেনি, ভারত চেনেনি, চিনেছে কেবল বাংলাদেশ৷ তাদের দুটি ভাষা, দুটি পরিচয়, বুকে দুটি দেশের টান৷ মাঝখানে তারা ভাসমান৷ বাইরে তারা বাংলাদেশি, ভেতরে উর্দুভাষী ও শরণার্থী৷
দূরদর্শী শাসক এদের দক্ষতাকে কারুশিল্পের বিকাশে কাজে লাগাতেন৷ দেশদরিদ নেতা ভাবতেন, এক ভাষা এক ধর্ম এক জাতির রাষ্ট্র মানে তো বর্ণবাদী ইসরায়েল! বাংলাদেশে সংস্কৃতি, ভাষা, ধর্ম, জীবনধারা ও নৈপুণ্যের যত বৈচিত্র্য আসবে, ততই দেশটা সমৃদ্ধ ও ভারসাম্যপূর্ণ হবে৷ তাই পাহাড়িদের উচ্ছেদে, হিন্দুদের দেশান্তরে, বৌদ্ধদের হতাশায়, রোহিঙ্গাদের প্রতি অবিচারে আর বিহারিদের নির্মূল করায় রাজনৈতিক দস্যুদের লাভ থাকা সম্ভব; কিন্তু এ আমার তোমার পাপ, এ বাংলাদেশের সর্বনাশ৷

শরণার্থীদের কোনো দেশ নেই

দেশভাগ পাকাপাকি হওয়ার পর পাকিস্তানি হিন্দুরা ভারতে আর ভারতীয় মুসলমানরা পাকিস্তানে হিজরত করে৷ বাংলাদেশ থেকে যাওয়া এ রকম লাখো উদ্বাস্তুকে ভারত সরকার মধ্যপ্রদেশের দণ্ডকারণ্যে জায়গা দেয়৷ রামায়ণে একে বলা হয় রাক্ষসপুরী৷ অনাদিকাল থেকে এ অরণ্যে দেশহারা দণ্ডিত ও পলাতকেরা আশ্রয় নিত; তাই এর নাম দণ্ডকারণ্য৷ এ যেন বিরাট আরেক বিহারি ক্যাম্প৷ এহেন রাক্ষসপুরীতে টিকতে না পেরে হাজার হাজার উদ্বাস্তু সুন্দরবনের কোলঘেঁষা মরিচঝঁাপি দ্বীপে চলে আসে৷ আশপাশের বাঙালিরা তাদের চায় না৷ সরকার তাদের চায় না৷ প্রথমে বিহারিদের মতোই তাদের রুটি-রুজি-ত্রাণের পথ বন্ধ করা হয়৷ অবরুদ্ধ করেও লাভ না হলে ১৯৭৯ সালের ২৪ জানুয়ারি চারদিক ঘিরে গণহত্যা চালানো হয়৷ অনেক লাশ গুম হয়, অনেকের লাশ সমুদ্রে ভেসে যায়৷ বাকিদের কিছু অংশকে আবার দণ্ডকারণ্যের নির্বাসনে পাঠানো হয়৷
দেশের আনাচকানাচে নতুন নতুন দণ্ডকারণ্য জাগছে৷ কালশী বস্তি আমাদের মরিচঝঁাপি৷ পৃথিবীতে শরণার্থীদের কোনো দেশ নেই৷ মরিচঝঁাপির মতো কি আমরা এদের হত্যা করব, আরেক দফা নির্বাসিত করব পাকিস্তানি দণ্ডকারণ্যে? মোদি যখন ‘বাংলাদেশি উদ্বাস্তু’দের অনুপ্রবেশকারী বলে তাড়াতে চান, তখন কি বাংলাদেশও বিহারি খেদাবে, হিন্দু তাড়াবে! একাত্তরে ভারত থেকে বিতাড়িত বিহারিদের সেই ভারতেই শরণার্থী হওয়া সম্ভব ছিল না৷ পাকিস্তানও তাদের নেবে না৷ এ দেশেও তাদের পাকিস্তানি থাকা অসম্ভব৷ কিন্তু মুখের দিকে তাকালে দেখি তারাও মানুষ৷ পিঠের দিকে দেখি উদ্বাস্তু জীবনের কালশিটে দাগ৷ বিবেকের ভণ্ডামি আর আইনের কারচুপি দিয়ে এসব দাগ লোপাট করা যাবে না৷ সময় শোধ নেবে৷

ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।

[email protected]