নারায়ণগঞ্জের নতুন যুদ্ধ

অলংকরণ : তুলি
অলংকরণ : তুলি

নারায়ণগঞ্জে জন্ম নিয়েছেন ওসমান ভ্রাতৃবৃন্দ, যাঁরা জনগণের কাছে ত্রাস নামে পরিচিত।এই নারায়ণগঞ্জেই জন্ম নিয়েছেন সেলিনা হায়াৎ আইভী আর এস এম আকরামের মতো পরিশীলিত রাজনীতিবিদ। ২০১১ সালের মেয়র নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জের মানুষ শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে বিপুলভাবে বিজয়ী করেছিল সেলিনা হায়াৎ আইভীকে। ২০১৪ সালে সংসদ উপনির্বাচনে তাদের সামনে আরেকটি সুযোগ এসেছে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এস এম আকরামকে বেছে নেওয়ার। এই উপনির্বাচনের মাহাত্ম্য এখানেই।
৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর দেশে আরও কিছু উপনির্বাচন হয়েছে। মূল নির্বাচনের মতো সেই সব উপনির্বাচন নিয়েও মানুষের কোনো আগ্রহ ছিল না। কিন্তু ২৬ জুনের উপনির্বাচন নিয়ে নারায়ণগঞ্জ শুধু নয়, সারা দেশের মানুষ আগ্রহী হয়েছে একে একটি প্রতীকী যুদ্ধ হিসেবে দেখে। এই যুদ্ধ শুধু সন্ত্রাসী রাজনীতির সঙ্গে সুস্থ ধারার যুদ্ধ নয়; এটি সন্ত্রাসী রাজনীতির প্রতি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার বিরুদ্ধে মানুষের শুভবুদ্ধির প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এটি নির্বাচনে কারচুপি ও অনিয়মের আশঙ্কার বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের শৌর্য আর সাহসিকতারও পরীক্ষা। প্রশাসন আর নির্বাচন কমিশনকে তাদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালনে বাধ্য করতে পারে তারাই। তা না করা গেলে এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, নির্বাচনী ব্যবস্থা, বর্তমান সরকারের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সমাজে বিরাজমান প্রশ্নগুলো আরও দৃঢ়তর হয়ে উঠবে।
নারায়ণগঞ্জ তাই নতুন বিতর্ক বা নতুন সম্ভাবনার জন্ম দিতে পারে ২৬ জুনের নির্বাচনের পর।

২.
নারায়ণগঞ্জ নানা কারণেই এ দেশে আলোচিত একটি স্থান। নারায়ণগঞ্জের সুনাম ছিল শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের নগর হিসেবে। সেই সুনাম ছাপিয়ে নারায়ণগঞ্জ সন্ত্রাস আর চাঁদাবাজির জায়গা হিসেবে কুখ্যাতি পেয়েছে গত কয়েক বছরে। নারায়ণগঞ্জের অধিকাংশ পাশবিক ও নিন্দনীয় ঘটনার জন্য ব্যাপকভাবে অভিযুক্ত হয়েছেন ওসমান পরিবারের সন্তানেরা।
শামীম ওসমানের কথাবার্তা শুনে কখনো মনে হয়নি যে এসব অভিযোগের আদৌ কোনো পরোয়া করেন তিনি। পরোয়া করার হয়তো কারণও নেই কোনো। নারায়ণগঞ্জে সাম্প্রতিক সাত খুনের প্রধান আসামি নূর হোসেনের ভারতে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনার সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে নানাভাবে। তাঁকে এ জন্য গ্রেপ্তার দূরের কথা, কোনো জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হতেও হয়নি। আগেও সন্ত্রাসের বহু ঘটনার সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততার অভিযোগ ছিল, জোরালো মামলাও ছিল তাঁর বিরুদ্ধে। তবু তিনি ২০১১ সালে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থন পেয়েছিলেন। এবার সাত খুনের ঘটনায় তিনি সারা দেশে ধিক্কৃত হওয়ার পরও স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ওসমান পরিবারের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন। এ ঘোষণার পর সাত খুন বা অন্য কোনো অভিযোগে তাঁর পরিবারের সদস্যদের টিকিটি স্পর্শ করার সাহস পাবে না পুলিশ বা প্রশাসন। শামীম ওসমানদের তাই এই সরকারের আমলে ভীত বা সংযত হওয়ার কোনো কারণ নেই।

ওসমান পরিবারের ছোট ছেলে সেলিম ওসমান নির্বাচন করছেন মূলত শামীম ওসমানের শক্তিতেই। শামীম ওসমান মানে স্থানীয় পুলিশ ও জনপ্রশাসনও। ইতিমধ্যে স্থানীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে

তাঁর প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এসেছে। সর্বশেষ ত্বকী মঞ্চের নেতাদের ওপর সেলিমের সমর্থকদের হামলার ঘটনায় পুলিশের প্রশ্রয় ছিল, পুলিশের কাছে এ নিয়ে তাই অভিযোগ করার ভারসা পাননি আক্রান্ত ব্যক্তিরা৷ এ ধরনের ঘটনায় নির্বাচন কমিশনও কোনো ভূমিকা নেয়নি।
২৬ জুনের নির্বাচনে তাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে সব হুমকি থেকে ভোটারদের রক্ষা করে তাঁদের ভোটকেন্দ্রে নিয়ে আসা এবং তাঁদের ভোট ঠিকমতো গণনা হচ্ছে, এটি নিশ্চিত করা। এসব কাজ করা গেলে এই নির্বাচনে এস এম আকরামের পরাজয়ের কোনো কারণ নেই। আইভীর নির্বাচনে তাঁর পক্ষে দাঁড়িয়ে তিনি আগেই নৈতিকভাবে বিজয়ী হয়েছেন। তখনকার সময়ের চেয়ে নারায়ণগঞ্জের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। সাত খুনের ঘটনায় বিক্ষুব্ধ মানুষের তাই এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে শক্তি হিসেবে আকরামকে সর্বতোভাবে সমর্থন করার কথা।
খুন, গুম, চাঁদাবাজি আর দুর্নীতিতে অতিষ্ঠ নারায়ণগঞ্জের জনপদে আকরামের মতো পরিষ্কার ইমেজের মানুষের গ্রহণযোগ্যতা আগে থেকেই ছিল। তিনি আগেও জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতি বা সন্ত্রাসের অভিযোগ কখনো উচ্চারিত হয়নি। এমনকি বিরোধী দলের পক্ষ থেকেও তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করা হয়নি। তাঁকে অনৈতিকভাবে হারিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হলে এই নির্বাচনে পরাজিত হবে আসলে সরকার, আওয়ামী লীগ ও সুস্থধারার রাজনীতি।

৩.
উপনির্বাচনে এস এম আকরাম বিজয়ী হলে তা হবে মানুষের স্বাধীন ও সুশীল সত্তার জয়। আকরামের বিজয়ের পথে সন্ত্রাস বা প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রতিবন্ধক না হয়ে দাঁড়ালে তা হবে নারায়ণগঞ্জের গাঢ় অন্ধকারে নতুন আলোর রেখা। এক অর্থে সরকারের জন্যও তা হবে ইতিবাচক। কারণ, ওসমান পরিবারের পাশে থাকা মানে তাদের যেকোনো তাণ্ডবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া নয়, এই বার্তা মানুষকে দিতে হবে। সরকারের স্বার্থেই এই বার্তা দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর সরকার বলার চেষ্টা করেছে যে বিরোধী দল আসেনি বলেই সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি। সরকারের এই দাবি ম্রিয়মাণ হয়ে গেছে পরের উপজেলা নির্বাচনগুলোয় ব্যাপক, বেপরোয়া ও বেসামাল কারচুপির মধ্য দিয়ে। এখন ২৬ জানুয়ারির নির্বাচনে কারচুপি হলে বিএনপির ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত আরও বেশি করে গ্রহণযোগ্যতা পাবে।
এই নির্বাচনে আকরাম বিজয়ী হলে নারায়ণগঞ্জকেন্দ্রিক রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের ভূমিকা পুনর্মূল্যায়নের নতুন তাগিদ সৃষ্টি হবে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মতো নারায়ণগঞ্জের সমাজজীবন ও রাজনীতিতেও সন্ত্রাসের আধিপত্য সৃষ্টি হয়েছে, এসব অঞ্চলে গডফাদার হিসেবে পরিচিত লোকদের নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া, সব অপরাধের দায় থেকে তাদের মুক্ত রাখা এবং প্রকাশ্যে তাদের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করার মাধ্যমে। নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের এই বার্তা দেওয়া আবারও প্রয়োজন হয়ে পড়েছে যে মানুষ সন্ত্রাস এবং এর প্রতি রাষ্ট্রের সমর্থন কতটা অপছন্দ করে। আওয়ামী লীগ আর জাতীয় পার্টির পছন্দের প্রার্থীর বিরুদ্ধে নাগরিক ঐক্য নামের অরাজনৈতিক একটি নতুন সংগঠনের প্রার্থী আকরামকে বিজয়ী করার মধ্য দিয়ে এই বার্তা দেওয়া সম্ভব।
এই বার্তা নারায়ণগঞ্জের মানুষকে দিতে দেওয়া হবে কি? এই বার্তা দেওয়া সম্ভব হলে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব তা বিবেচনায় নিয়ে তাঁর শুভবুদ্ধির পরিচয় দিতে পারবেন কি? ওসমান, হাজারী, বদি, ইলিয়াস মোল্লাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার সর্বনাশা রাজনীতি থেকে এরপর নিজেদের দূরে রাখার চেষ্টা করবেন কি?
সরকারকে এর আগে মানুষ বিভিন্নভাবে বার্তা দিয়েছে। যেমন মেয়র নির্বাচনে সরকারি দলের বিপক্ষে ভোট দিয়ে, সংসদ নির্বাচন বর্জন করে, উপজেলা নির্বাচনে বিরোধী দলের পক্ষে দাঁড়িয়ে। সরকার জনগণের বার্তা পড়তে পারেনি, পড়তে চায়নি। এসব যেকোনো নির্বাচনের চেয়ে নারায়ণগঞ্জে নাগরিক সমাজ আর গণমাধ্যমের উপস্থিতি থাকবে ব্যাপক এবং গভীরতর। সাত খুনের ঘটনার পর এই নির্বাচনের প্রতি আন্তর্জাতিক সমাজেরও নজর থাকবে।
আত্মহননের নেশায় বিবেকবুদ্ধিহীন না হয়ে পড়লে সরকারের উচিত নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনকে সুষ্ঠুভাবে হতে দেওয়া। বহু বছর ধরে বঞ্চিত, শঙ্কিত ও শৃঙ্খলিত নারায়ণগঞ্জের মানুষ অন্তত এটুকু দাবি করতেই পারে।

আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।