সামরিক স্বচ্ছতা এবং এশীয় নিরাপত্তা

শিনজো আবে
শিনজো আবে

কথাটা আমরা সবাই শুনেছি, ‘সূর্যের আলোই হচ্ছে সর্বোত্তম জীবাণুনাশক’। এশিয়ার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এটা বিশেষভাবে সত্য। হ্যাঁ, আমি মনে করি, যে কাঠামোর ভেতরে এশীয় সরকারগুলো সামরিক বাজেট জনসমক্ষে প্রকাশ করে, তার ভিত্তি আরও শক্তিশালী হওয়া দরকার। নিজেদের মধ্যে আস্থা তৈরি ও আঞ্চলিক সমর প্রতিযোগিতা এড়াতে এটা করা দরকার।
আরও বিশদভাবে বললে, সামরিক বিস্তার রোধ, অস্ত্র বাণিজ্য চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশের সংখ্যা বৃদ্ধি ও প্রতিটি দেশের জাতীয় প্রতিরক্ষা কর্তৃপক্ষের মধ্যে আস্থা বৃদ্ধি করাটাই এখন এশিয়ার সামনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইস্ট এশিয়া সামিটে এ বিষয়টির ওপর আলোকপাত করা উচিত। স্থিতাবস্থা বজায় রাখার স্বার্থে আঞ্চলিক নিরাপত্তাবিষয়ক আলোচনায় প্রধান ফোরাম হিসেবে এটাকেই নির্বাচন করা উচিত।
বৈশ্বিক অর্থনীতির কেন্দ্র হতে গেলে এশিয়ায় সামরিক বিস্তার রোধ করতে হবে। রাষ্ট্রীয় সমৃদ্ধি ঘটলে জনগণের জীবনমান উন্নয়নে ব্যয় বাড়ানো উচিত। অস্ত্র ক্রয়ে সে টাকা ব্যয় করে লাভ নেই, কারণ তা শেষ পর্যন্ত জনগণের জীবনে কাল হয়ে আসবে।
তার পরও আইনের শাসন বজায় রাখাই হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। যেমন, আসিয়ানের সদস্যদেশগুলো নিরাপত্তা এবং নৌ ও আকাশপথে বাধাহীন যাতায়াত নিশ্চিতকরণে যে প্রচেষ্টা নিয়েছে, জাপান সেটাতে তার যথাসাধ্য সহায়তা করবে। কিন্তু জাপান আসলে ঠিক কোন ক্ষেত্রে প্রকৃত সহায়তা দেবে ও কীভাবে তা দেবে, সে বিষয়ে আমাকে স্পষ্টভাবে বলতে হবে।
আমরা ইতিমধ্যে ইন্দোনেশিয়াকে তিনটি টহল নৌযান সাহায্য হিসেবে দিয়েছি। আর ফিলিপাইনের কোস্টগার্ডকে অনুরূপ ১০টি নৌযান দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পাশাপাশি, ভিয়েতনামকে এরূপ নৌযান দেওয়া যায় কি না, আমরা তা খতিয়ে দেখছি।
জাপান সহযোগিতা করলে তার সঙ্গে বিশেষজ্ঞ দল ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণও দিয়ে থাকে, এটাও কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়। আমরা নিজেদের দায়িত্ব পালন করি, সেটা নিয়ে আমরা গর্ব করতেই পারি। আমরা উচ্চমানের নৈতিকতা ও দক্ষতার সংস্কৃতি লালন করি, এর মাধ্যমে আমরা জাপানের জনগণ ও সাহায্যগ্রহীতা দেশগুলোর মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখি।
শুধু ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়াতে আমরা ২৫০ জন কোস্টগার্ড সদস্যকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। এদিকে ২০১২ সালে আসিয়ানের পাঁচটি প্রধান দেশের নৌ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীর জন্য জাপানের তিনজন কোস্টগার্ড সদস্যকে নিয়োজিত করা হয়। তাঁরা সবাই একত্রে খেয়েছেন, ঘুমিয়েছেন ও একই ছাদের নিচে থেকেছেন।
সম্প্রতি জাপান প্রতিরক্ষাসামগ্রী ও প্রযুক্তি বিভিন্ন দেশে হস্তান্তরের লক্ষ্যে একটি নতুন কাঠামো তৈরি করেছে। কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির মাধ্যমে আমরা এখন উদ্ধার, পরিবহন, নজরদারি, মাইনবিধ্বংসী যন্ত্রপাতি প্রভৃতি অন্য দেশগুলোকে দেওয়ার প্রস্তাব করতে পারি। আসিয়ানের সদস্যদেশগুলোকে সমুদ্র রক্ষায় সহায়তা করতে জাপান নানা রকম সম্ভাবনা খতিয়ে দেখবে। এর মধ্যে রয়েছে উন্নয়নে

আনুষ্ঠানিক সহায়তা প্রদান, জাপান সেলফ ডিফেন্স ফোর্সেস–এর (জেএসডিএফ) মাধ্যমে সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং প্রতিরক্ষা যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি।

শান্তি মিশনে জাপানি সেনা: এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে শান্তির জন্য সক্রিয়
শান্তি মিশনে জাপানি সেনা: এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে শান্তির জন্য সক্রিয়

কোনো দেশই একা একা শান্তি নিশ্চিত করতে পারে না। সে কারণে আমাদের ওপর একটি দায়িত্ব বর্তায়: যৌথ নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার আইনি কাঠামো পুনর্গঠন, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষায় অংশগ্রহণ। আমাদের প্রশাসন ইতিমধ্যে এ সংস্কার শুরু করেছে।
এই সংস্কার নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কিছু নেই। জেএসডিএফ এ মুহূর্তে দক্ষিণ সুদানে জাতিসংঘের আওতায় শান্তি রক্ষায় কাজ করছে। একই সঙ্গে সেখানে কম্বোডিয়া, মঙ্গোলিয়া, বাংলাদেশ, নেপাল, কোরিয়া ও চীনের সৈন্য এবং জাতিসংঘের কর্মী ও বিভিন্ন দেশের এনজিও কর্মীরা কাজ করছে। দক্ষিণ সুদানের জাতি গঠন–প্রক্রিয়ায় এরা সবাই আমাদের অংশীদার।
কিন্তু একবার ভাবুন যে সেখানে যেসব বেসামরিক কর্মীরা কাজ করছেন, তাঁরা যদি হঠাৎ করে কোনো সশস্ত্র আক্রমণের মুখে পড়েন, তাহলে কী হবে। এখন পর্যন্ত জাপানি সরকার যে অবস্থানে আছে তাতে জেএসডিএফের পক্ষে বেসামরিক লোকদের উদ্ধার করা সম্ভব নয়। কথা হচ্ছে, এ প্রেক্ষাপটে আমাদের যে অবস্থান তা কি যথাযথ?
আমাদের সরকার এ উভয়সংকটে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। শাসক জোটের সঙ্গে এ নিয়ে নিবিড় আলোচনা চলছে। কারণ হচ্ছে, জাপান আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ওপর এতটা নির্ভরশীল যে আমরা আসলে বিশ্বশান্তির জন্য আরও সক্রিয়ভাবে লড়তে চাই।
প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে জাপানিরা একই পথে হেঁটেছে। এ পথ স্বাধীনতা, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের। আমাদের আরও কয়েক প্রজন্ম এ পথেই হাঁটতে হবে। কিন্তু আমরা এখন জাপানি অর্থনীতিতে নতুন করে প্রাণ সঞ্চারের চেষ্টা করছি, ফলে আমাদের এমন জাপানি মানুষ দরকার, যাঁরা বিশ্বপরিসরে দায়িত্ব পালন করতে পারেন, অবশ্যই আমাদের দেশের আকার ও অর্থনৈতিক সম্পদের সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে।
নতুন ধাঁচের জাপানি মানুষেরা তাঁদের পূর্বসূরিদের সদ্গুণ বর্জন করবেন না। তাঁরা দারিদ্র্যকে ঘৃণা করবেন, বৈশ্বিক মূল্যবোধ আত্মস্থ করবেন আর আনন্দের সঙ্গে কঠোর পরিশ্রম করবেন। যদি কোনো পরিবর্তন ঘটে থাকে, সেটা হচ্ছে জাপানের নারীরা আগের চেয়ে আরও বেশি সংখ্যায় জীবনে ও কর্মে এগিয়ে আসছেন। যেমন যে তিনজন বিচারক ও সরকারি আইনজীবী কম্বোডিয়ার দেওয়ানি বিধি প্রণয়নে সহায়তা করেছেন, তাঁরা সবাই তরুণী নারী।
এই নতুন জাপানিরা অবশ্যই এশীয় শান্তির লক্ষ্যে কাজ করবেন। ২০১১ সালের আগস্ট মাসে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট তৃতীয় বেনিগনো অ্যাকুইনো এবং মরো ইসলামিক লিবারেশন ফ্রন্টের চেয়ারম্যান মুরাদ ইব্রাহিম জাপানের নরিতায় বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। তিন মাস আগে দুই পক্ষই একটি পূর্ণাঙ্গ শান্তির জন্য মতৈক্যে পৌঁছেছে। দুই বছর পর বাঙ্গসামারো স্থানীয় সরকার যখন ক্ষমতা গ্রহণ করবে, জাপানি সহায়তা দল সেখানেও উপস্থিত থাকবে।
এ অঞ্চলে জীবিকা অর্জনে যে দক্ষতা দরকার, নারীদের তা অর্জনে সহায়তা করতে জাপান ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে। জাপান মিনদানাওয়ে নারীদের জন্য একটি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেছে। সেখানে এখন আর গুলি ও চিৎকার শোনা যায় না, তার বদলে সেখানে এখন সেলাই মেশিনের ঘড়ঘড় শব্দ শোনা যায়।
এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে শান্তি, নিরাপত্তা ও বৃহত্তর সমৃদ্ধি অর্জনে জাপান তার করণীয় যা আছে সবই করবে, এসব তারই ইঙ্গিত। আসিয়ান যুক্তরাষ্ট্রসহ আমাদের সব আঞ্চলিক সহযোগীদের সঙ্গে করে আমরা এই প্রত্যয়কে কাজে পরিণত করব। এ অঞ্চলে আমরা শিলাদৃঢ় স্থিতিশীলতা সৃষ্টি করব।
ইংরেজি থেকে অনূদিত; স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
শিনজো আবে: জাপানের প্রধানমন্ত্রী৷