মাটিতে আবারও রক্তের দাগ

আইটি ম্যানেজার মোহসিন শেখ হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ
আইটি ম্যানেজার মোহসিন শেখ হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ

ভারতের সাবেক কৃষিমন্ত্রী ও মহারাষ্ট্রের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী শারদ পাওয়ার বলেছেন, বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর সাম্প্রদায়িকতা ফিরে এসেছে। কথাটা তিনি ঠিকই বলেছেন। আর সেটা ঘটেছে মোদির সরকার ক্ষমতা গ্রহণের ১৫ দিনের মধ্যে। ক্ষমতার পাঁচ বছর পূর্ণ হতে ঢের বাকি। মহারাষ্ট্রের সবচেয়ে উদার শহর পুনেতে দেখা গেল, একদল লোক রণমূর্তি ধারণ করে শহরময় ছুটে বেড়াচ্ছে। একটি উগ্রপন্থী হিন্দু গোষ্ঠী মোহসিন শেখ নামের ২৮ বছর বয়সী এক আইটি ম্যানেজারকে হত্যা করেছে। অভিযোগ হচ্ছে, এই ব্যক্তি নাকি শিবাজি ও ঠাকরের ব্যঙ্গাত্মক ছবি পোস্ট করেছিলেন। উগ্রপন্থী দল শিবসেনার প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন এই বাল ঠাকরে। যে অভিযোগে মোহসিনকে হত্যা করা হয়েছে, তার সমর্থনে কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই।
এটা ঠিক, ভারতীয় জনতা পার্টি এ হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করেছে। তবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে এটা এক বড় সুযোগ। মুসলমানরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। মোদি তাদের এই বলে আশ্বস্ত করতে পারেন যে তাঁর সরকার ব্যাপারটি খতিয়ে দেখছে এবং হত্যাকারীদের শিগগিরই আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। কিন্তু মোদি এমনই একজন মানুষ, যাঁকে একবার কোনো ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত এক ব্যক্তিকে সমব্যথা জানানোর অনুরোধ করা হলেও তিনি সেই অনুরোধ রাখেননি৷
মোদির এই মনোভাবে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। এমনকি ২০০২ সালে তিনি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে প্রশাসন ও পুলিশের মদদে দুই শতাধিক মুসলমান নিহত হয়, সেই ঘটনার পর তিনি দুঃখ পর্যন্ত প্রকাশ করেননি। ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে তিনি নির্দোষ খেতাব লাভ করেন, এর বদৌলতে তিনি সব সমালোচনা থামিয়ে দেন। আজ পর্যন্ত তিনি এ ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেননি। পুনের এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তিনি দুঃখ প্রকাশ করলে তা মুসলমানদের অন্তত সান্ত্বনাটুকু দেবে৷ আর বহুত্ববাদী ভারতের ভিত আরও পোক্ত হবে।
নির্বাচনী প্রচারণার সময় মোদি যখন বিজেপির হিন্দুত্ববাদী উত্তরীয়ের প্রশংসায় আপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন, ভারতমাতা তখন ভেবেছিল, এটা একরকম আবেগের বহিঃপ্রকাশ। আর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি বলেছিলেন, ভারতের ১২৫ কোটি মানুষকেই তিনি তাঁর উন্নয়নের অংশীদার হিসেবে দেখতে চান, এতেও ভারতমাতা আশ্বস্ত হয়েছিল।
কিন্তু দলটি যতই তার কর্মসূচি দিচ্ছে, ততই দেখা যাচ্ছে যে মোদির এ কথা ধাপ্পা ছাড়া আর কিছু না। এর আড়ালে বিজেপি আসলে আরএসএসের বিভাজনমুখী নীতি বাস্তবায়ন করছে। মোদি নিজেকে একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তি হিসেবে প্রচার করার চেষ্টা করছেন, আর বিজেপি এবং আরএসএস ভারতের বহুত্ববাদী সংস্কৃতি নস্যাৎ করার পথে এগোচ্ছে।
আরএসএস ইতিমধ্যে বিভিন্ন কমিশন ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে তাদের বিশ্বস্ত মানুষদের বসানো শুরু করেছে। আর নিম্নস্তরের কাজগুলো করার জন্য প্রশাসনের ক্যাডারদের মধ্য থেকে তরুণদের বেছে নেওয়া হচ্ছে। হাওয়া যেদিকে বয়, আমলাতন্ত্রও সেদিকে ঝোঁকে। ফলে নিজেদের কর্মসূচি বাস্তবায়নে বিজেপি এবং আরএসএসের কোনোই ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে না।
আরএসএস নিজেকে সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে দাবি করে। সে কারণে রাজনীতি করা তাদের সাজে না। আরএসএসের কর্মী নাথুরাম গডসে গান্ধীকে হত্যা করার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নেহরু আরএসএসকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তারপর ১৯৪৯ সালে আরএসএস এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য দেনদরবার শুরু করলে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল আরএসএসের কাছ থেকে এই মর্মে মুচলেকা নেন যে ‘আরএসএস কোনো রাজনৈতিক তৎপরতায় অংশ নেবে না’। তারা ‘শুধু সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেবে’।
কিন্তু প্যাটেল সাহেব এতেও সন্তুষ্ট হননি। তিনি দাবি করেছিলেন, আরএসএস এই প্রতিশ্রুতি তাদের গঠনতন্ত্রে

সংযুক্ত করুক, যাতে চিরকালের জন্য আরএসএস রাজনীতি থেকে দূরে থাকে। এটা ১৯৪৯ সালের ঘটনা, তারপর সরকার আরএসএসের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। কিন্তু ২০১৩ সালে সংগঠনটির সরসংঘচালকের প্রধান মোহন ভাগওয়াতের নেতৃত্বে আরএসএস মারাত্মক বিশ্বাসঘাতকতা করে আগ্রাসী রাজনীতি শুরু করে বসে। লক্ষ্য ছিল আরএসএসের সাবেক প্রচারক নরেন্দ্র মোদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত করা। তার ফলাফল আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি।
তার পরও ভারতের ১৫-১৬ কোটি মুসলমানের ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ, ভারত রাষ্ট্রটি তার সংবিধান অনুযায়ী পরিচালিত হয়। সংবিধান অনুযায়ী সে দেশের প্রত্যেক নাগরিক আইনের চোখে সমান। সেখানে আদালত আছে, সংবাদমাধ্যম আছে। উদারনৈতিক ব্যক্তিরা আছেন, যাঁরা মুসলিম সম্প্রদায়ের যেকোনো বিপদ-আপদে তাদের পাশে এসে দাঁড়ান। বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং গুজরাটে মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা শুরু হওয়ার পর আমরা সেটা দেখেছি।
ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদে মুসলিম-অধ্যুষিত জম্মু ও কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এই অনুচ্ছেদ ভারতীয় সংবিধানের সমবয়সী, এর বয়স এখন ৬৫ বছর। মোদির আমলে এ প্রদেশের বিশেষ মর্যাদা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে, সেখানকার মানুষ তেমনটা মনে করতেই পারে। যাঁরা এই অনুচ্ছেদের অমর্যাদা করতে চান, তাঁরা ইতিহাস জানেন না। এমনকি সত্য সন্ধানেও তাঁদের তেমন আগ্রহ নেই।
ভারত ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হয়। সে সময় ৫৬০টি রাজাশাসিত রাজ্যের সামনে দুটি সুযোগ খোলা ছিল। হয় তাদের ভারতের সঙ্গে যোগ দিতে হতো, অথবা নবগঠিত পাকিস্তানে যোগ দিতে হতো। সেই ফয়সালাটা অবশ্য ধর্মের ভিত্তিতেই হয়েছে। সেই সব রাজ্যের শাসকেরা অবশ্য চাইলে স্বাধীন থাকতে পারতেন।
জম্মু ও কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিং বেশ দেরিতে ভারতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, যদিও সেই প্রদেশের অধিকাংশ মানুষ মুসলমান। আমার পাঠ হচ্ছে, আরেকটু ধৈর্যশীল হলে প্রদেশটি হয়তো পাকিস্তানের সঙ্গেই যেতে পারত। কিন্তু পাকিস্তান প্রথমে আদিবাসী এবং পরে সেনা পাঠিয়ে প্রদেশটিকে নিজের ঘরে আনার চেষ্টা করে। মহারাজা ভারতে যোগদানের চুক্তি স্বাক্ষর করে এই খুনোখুনি বন্ধ করার চেষ্টা করেন। তবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে তিনি মাত্র তিনটি বিষয় তুলে দেন: প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগ।
অন্য বিষয়গুলো রাজ্যের হাতেই থাকে। ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদে সে আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন ঘটেছে। ভারতীয় ইউনিয়ন আরও মন্ত্রণালয় দাবি করলে রাজ্যটির সিদ্ধান্তক্রমেই তা হতে হবে। রাজ্যটি এ শর্তেই ভারতীয় ইউনিয়নে যোগ দিয়েছিল। ফলে আরএসএস যে ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদটি বাতিল করার দাবি জানাচ্ছে, সেটা অবৈধ।
বাস্তবে ব্যাপারটা এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে এর সমাধানে তিন পক্ষের সম্মতি লাগবে: ভারত, পাকিস্তান এবং জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণ। আজ যদি গণভোট হয়, তাহলে জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণ স্বাধীন রাষ্ট্রের পক্ষেই ভোট দেবে। জম্মুর অধিকাংশ মানুষ হিন্দু, তারা চাইবে ভারতের সঙ্গে যেতে। লাদাখের অধিকাংশ জনগণ বৌদ্ধ, তারা সরাসরি নতুন দিল্লির অধীনে ‘ইউনিয়ন টেরিটরি’র অধিকার দাবি করবে। এসব ভিন্ন ভিন্ন বিবেচনার কারণে সমস্যাটি আরও জট পাকিয়ে উঠেছে। এই প্রেক্ষাপটে মনে হচ্ছে, রাষ্ট্রের সীমানা তুলে দিলেই সব সমস্যার সমাধান হবে, সেটাই এ সমস্যার একমাত্র সমাধান।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন

কুলদীপ নায়ার: ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক৷