দুই কোরিয়া, এক হওয়ার স্বপ্ন

দুই কোরিয়া, এক হওয়ার স্বপ্ন
দুই কোরিয়া, এক হওয়ার স্বপ্ন

শীতল যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর দিনে দিনে এর অনেক ক্ষতই শুকিয়েছে। একমাত্র কোরীয় উপদ্বীপকেই এখনো বয়ে বেড়াতে হচ্ছে সেই যুদ্ধের দগদগে ঘা। যুক্তরাষ্ট্র ও একসময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নের শক্তির প্রতিযোগিতায় কৌশলগত ভারসাম্যের বলি হিসেবে বিভক্ত হয়েছে কোরীয় উপদ্বীপ। প্রায় ৭০ বছর ধরে উত্তর ও দক্ষিণে বিভক্ত দুই কোরিয়া দুই পথেই হাঁটছে।
বিশ্ববাসীর কাছে উত্তর কোরিয়া যেন এক অজানা দ্বীপের নাম। ‘কিম ডাইনেস্টির’ শাসনে দুনিয়াবিচ্ছিন্ন উত্তর কোরিয়া টিকে থাকার বিস্ময়কর ক্ষমতার প্রকাশ দেখিয়ে যাচ্ছে। আর দক্ষিণ কোরিয়া অর্জন করেছে চমকে দেওয়ার মতো অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। মাথাপিছু ৩০ হাজার ডলারের বেশি আয় নিয়ে বিশ্ব জিডিপির সূচকে দেশটির স্থান এখন ১৩ নম্বরে। পারমাণবিক সক্ষমতা বাদ দিলে সামরিক শক্তিতেও দেশটি এখন সামনের কাতারে, বিশ্বের মধ্যে নবম। ইসরায়েল ও জাপানের মতো দেশ থেকেও এগিয়ে। এই অর্থনৈতিক সামর্থ্য ও সামরিক শক্তি নিয়েও এশিয়ার সামগ্রিক ভূ-রাজনীতিতে দেশটির প্রভাব এই অঞ্চলের অপর দুই শক্তিশালী দেশের (চীন ও জাপান) তুলনায় কম। দক্ষিণ কোরিয়া সম্ভবত বর্তমানে এ দিকেই মনোযোগ দিতে শুরু করেছে।
২০১৩ সালে ক্ষমতায় এসে দক্ষিণ কোরিয়ার নতুন প্রেসিডেন্ট পার্ক গুয়েন-হে বিদেশনীতির ক্ষেত্রে ‘ট্রাস্টপলিটিক’ নামে এক নীতির ঘোষণা দিয়েছেন; যার ঘোষিত লক্ষ্য হচ্ছে সন্দেহ-অবিশ্বাস ও সংঘাতের পরিবেশকে আস্থা ও সহযোগিতায় রূপান্তরিত করা এবং ‘একটি নতুন কোরীয় উপদ্বীপ, নতুন উত্তর-পূর্ব এশিয়া ও একটি নতুন বিশ্ব গড়ে তোলা।’ সবকিছু মিলিয়ে তিনি এক কোরিয়ার স্বপ্ন দেখছেন এবং দক্ষিণ কোরিয়ার জনগণ ও বিশ্ববাসীকে সেই স্বপ্নের সাথি করতে চাইছেন।
সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ায় হয়ে গেল বিশ্ব সাংবাদিক সম্মেলন৷ মূল িথম কোরীয় উপদ্বীপের শান্তি ও দুই কোরিয়ার একত্রীকরণ। দক্ষিণ কোরিয়ার সাংবাদিক সমিতির আয়োজনে এ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন ৫০টি দেশের শ খানেক সাংবাদিক। দক্ষিণ কোরিয়া, সামগ্রিকভাবে কোরীয় উপদ্বীপকে জানা-বোঝা, দুই কোরিয়ার এক হওয়ার সম্ভাবনা এবং এসব নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাংবাদিক ও কোরিয়া পক্ষের মধ্যে আলোচনা ও মতবিনিময়ের এক সুযোগ করে দিয়েছিল এই সম্মেলন। দক্ষিণ কোরিয়ার বর্তমান সরকার যে ‘এক কোরিয়া’ ইস্যুটিতে দুনিয়ার মনোযোগ চাইছে, সেটা সম্মেলনে যোগ দেওয়া সব সাংবাদিকের কাছেই স্পষ্ট হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এর সম্ভাবনা বা বাস্তবতা আসলে কতটকু?
শীতল যুদ্ধের শেষ হয়েছে সেই কবে। দুই ভিয়েতনাম এক হয়েছে, জার্মানি এক হয়েছে—তা–ও ২৩ বছর হয়ে গেছে। দুই কোরিয়ার এক হতে বাধা কোথায়? সম্মেলনে অংশ নেওয়া চীনের এক সাংবাদিকের মতে বাধাগুলো হচ্ছে, দুই কোরিয়ার রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও উন্নয়নের মধ্যে বিশাল পার্থক্য এবং বড় দেশগুলোর হস্তক্ষেপ। রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও উন্নয়নের পার্থক্য জার্মািন, ভিয়েতনামসহ বিভক্ত অন্য দেশগুলোতেও ছিল। কোরীয় উপদ্বীপের সমস্যা নিয়ে ছয় দেশীয় যে উদ্যোগ ও আলোচনা অনিয়মিতভাবে হয়ে থাকে, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া বাদে বাকি চারটি দেশ হচ্ছে চীন, জাপান, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র। দুই কোরিয়ার এক হওয়ার ক্ষেত্রে এই আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোই কি তবে সবচেয়ে বড় বাধা?
সাংবাদিকদের সঙ্গে এক নৈশভোজে এসেছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার মিনিস্ট্রি অব ফরেন অ্যাফেয়ার্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট। তাঁর কাছে বিদেশি সাংবাদিকদের জানার বিষয় ছিল, দুই কোরিয়ার এক হওয়ার ব্যাপারে চীনের অবস্থান কী? ‘চীনের অবস্থানগত পরিবর্তন হয়েছে, এখন অন্তত আমরা চীনের সঙ্গে এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে পারছি।’ উত্তরটি কূটনৈতিক৷ কিন্তু চীনের অবস্থান কী হতে পারে, তা আমরা অনুমান করতে পারি৷ একীভূত কোরিয়া বড় এক শক্তি হিসেবে চীনের জন্য ভবিষ্যতে হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। দক্ষিণ চীন সাগরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, তাইওয়ান, ব্রুনাইয়ের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে আছে চীন। অন্যতম নৌ রুট ও প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ পুরো দক্ষিণ চীন সাগরকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চীনের মরিয়া অবস্থান কোনো লুকানো বিষয় নয়। দক্ষিণ চীন সাগরের বিতর্কিত পারসেল দ্বীপের কাছে গত মাসেই তেল অনুসন্ধানে বিশাল রিগ পাঠিয়েছে চীন, যে অঞ্চলটির ওপর দাবি রয়েছে ভিয়েতনামেরও। এ নিয়ে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কড়া কথার বিনিময় হয়েছে। চীনের এই উদ্যোগ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ‘উসকানিমূলক’। আর দক্ষিণ চীন সাগরের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান চীনের কাছে ‘অগ্রহণযোগ্য হস্তক্ষেপ’। এ পরিস্থিতিতে বিভক্ত কোরিয়া, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ‘শত্রু’ উত্তর কোরিয়ার প্রয়োজনকে চীন অস্বীকার করবে কীভাবে?
মাত্র ১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ হলেও উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়ার মধ্যে একটি সীমান্ত রয়েছে। সীমান্ত দিয়ে সংযুক্ত কোরীয় উপদ্বীপ ও এই অঞ্চলের ভূরাজনীতিতে রাশিয়া তার স্বার্থ রক্ষায় সচেষ্ট ও প্রভাব বজায় রাখতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। উত্তর কোরিয়ার কীর্তিকলাপ নিয়ে রাশিয়ার উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা কম নয়। কিন্তু শীতল যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ইউক্রেন প্রশ্নে পশ্চিমের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক এখন সবচেয়ে খারাপ পর্যায়ে এসে ঠেকেছে। ইউক্রেন বিরোধের কারণে পশ্চিমের অবরোধের মুখে পড়লে রাশিয়া কোরীয় উপদ্বীপের রাজনীতিতে আরও সক্রিয় হয়ে উঠতে মার্কিন ও পশ্চিমাবিরোধী অবস্থান নিতে পারে, যার সহজ অর্থ হচ্ছে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক আরও জোরদার করা। এক কোরিয়া এবং এর নেতৃত্বে যদি থাকে দক্ষিণ, তবে সেখানে মার্কিন

প্রাধান্যের বিষয়টিই নিশ্চিত হবে। রাশিয়া কি তা চাইবে?
কোরীয় উপদ্বীপকে একসময় উপনিবেশ বানিয়েছিল জাপান। আর এখন সামরিক শক্তিতে দক্ষিণ কোরিয়া জাপানকে ছাড়িয়ে গেছে। তবে সমৃদ্ধ অর্থনীতি হিসেবে এশিয়ার রাজনীতিতে জাপানের একটা শক্ত অবস্থান রয়েছে, যা দক্ষিণ কোরিয়ার নেই। দক্ষিণ কোরিয়া এখন তা অর্জনের চেষ্টায় মাঠে নেমেছে। এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের এই ঘনিষ্ঠ দুই মিত্রের মধ্যে ঐতিহাসিক কারণেই সম্পর্কের মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন রয়ে গেছে। জাপান ও উত্তর কোরিয়া গত মাসে নতুন করে আলোচনা শুরুর ঘোষণা দিয়েছে। জাপানের এই উদ্যোগে যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়া বিস্মিত। কোরিয়ান-আমেরিকান সাংবাদিক টনি নামকুং দীর্ঘদিন ধরে দুই কোরিয়ার রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করছেন৷ তিনি এক লেখায় লিখেছেন, জাপানের প্রধানমন্ত্রী আবের কাছে এই অঞ্চলে পুনরায় পা ফেলার উপায় হচ্ছে উত্তর কোরিয়া। কোরীয় উপদ্বীপে ‘পুনরায় পা ফেলা’ বা প্রভাব বজায় রাখা যদি জাপানের লক্ষ্য হয়ে থাকে, তবে এক ও শক্তিশালী কোরিয়া জাপানের জন্য খুব স্বস্তির কারণ হবে বলে মনে হয় না।
গত জানুয়ারিতে দক্ষিণ কোরিয়ায় মোতায়েন মার্কিন সেনার সংখা ছিল ৩০ হাজার। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি দেশটি সফরে এসে আরও ৮০০ সৈন্য বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। কারণ, দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিরক্ষায় তাঁরা ‘প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’। নিরাপত্তা নিশ্চয়তা চুক্তি অনুযায়ী দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষে তার শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ওয়াশিংটন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অথচ সমালোচকেরা বলেন, নিজেকে রক্ষার ক্ষমতা দক্ষিণ কোরিয়ার এককভাবেই রয়েছে। কোরীয় উপদ্বীপে উত্তর কোরিয়ার মতো একটি দেশ আছে বলেই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এই অঞ্চলে চীন-রাশিয়ার খুব কাছাকাছি সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এক কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্রকে সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করতে পারে।
এই যে এত আলোচনা, সেখানে উত্তর কোরিয়া কোথায়? একত্রীকরণ নিয়ে দেশটি বা এর জনগণ কী ভাবছে, তার পুরোটাই অজনা। যুক্তরাষ্ট্রের ফিন্যান্সিয়াল টাইমস পত্রিকার উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া প্রতিনিধি সিমন মান্ডি এক আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন সাংবাদিকদের এই সম্মেলনে। তাঁর মতে, বর্তমান উত্তর কোরিয়া সরকারের শান্তিপূর্ণ একত্রীকরণে সাড়া দেওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। এ ধরনের কিছু হলে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন ও তাঁর ঘনিষ্ঠ অনুচরদের সবই হারাতে হবে, এমনকি তাঁরা শাস্তি বা মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখিও হতে পারেন। তাঁর মতে, একমাত্র উত্তর কোরিয়ার সরকারের উৎখাতই দুই কোরিয়ার এক হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে। আর তা হতে পারে দুই উপায়ে: প্রথমত, কিম উনের ঘনিষ্ঠ অনুচরদের কেউ এককভাবে যদি হত্যাকাণ্ড ঘটান অথবা উচ্চপর্যায়ে যদি কোনো ষড়যন্ত্র ঘটে; আর দ্বিতীয় পথটি হচ্ছে গণ-অভুত্থান। গণ-অভুত্থানের আপাতত কোনো সম্ভাবনা নেই বলেই মনে করেন এই মার্কিন সাংবাদিক। তবে উত্তর কোরিয়া সরকারের উচ্চপর্যায়ে বিভক্তির আলামতের তথ্য তাঁর কাছে রয়েছে বলে জানিয়েছেন। দুই কোরিয়ার এক হওয়ার জন্য িক তবে উত্তর কোরিয়ার সরকার উৎখাত বা এ ধরনের কোনো ষড়যন্ত্রের জন্য অপেক্ষা করতে হবে!
কোরীয় উপদ্বীপ নিয়ে উল্লেখযোগ্য আন্তর্জাতিক উদ্যোগ হচ্ছে দুই কোরিয়া, চীন, জাপান, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে ছয় দেশীয় আলোচনা। অনিয়মিত এই উদ্যোগের কার্যকারিতা নিয়ে হতাশা রয়েছে দক্ষিণ কোরীয় মহলে। দক্ষিণ কোরীয়দের মনোভাব অনেকটা এ রকম যে কোরীয় উপদ্বীপের শান্তির চেয়ে সবাই বরং এ নিয়ে খেলছে। কিন্তু এটাও তাদের মানতে হচ্ছে যে চীন, জাপান, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের আন্তরিক উদ্যোগ ছাড়া এই উপদ্বীপে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও এক হওয়ার কোনো উদ্যোগের সূচনা করাও অসম্ভব। কিন্তু এই অঞ্চলের বর্তমান জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সবগুলো দেশ একসঙ্গে কোরীয় উপদ্বীপের শান্তি ও একত্রীকরণের ব্যাপারে ‘আন্তরিক’ হয়ে উঠবে, এমন আশা করা কঠিন। ‘কোরীয় উপদ্বীপের একত্রীকরণ’ আপাতত একটি স্বপ্নের নাম। দক্ষিণ কোরিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট তাঁর এই স্বপ্নকে নিজের জনগণ ও বিশ্ববাসীর সামনে হাজির করেছেন। কাউকে না কাউকে তো স্বপ্ন দেখতে হবেই, তার বাস্তবায়ন আপাতত যত কঠিন ও অসম্ভবই মনে হোক না কেন।

দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ফিরে
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
[email protected]