দলের দুর্গ বেঁচেছে, ইজ্জত বাঁচেনি

নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের পাঁচতলার ঘর। জানালার পাশে বসে আছেন শামীম ওসমান। বিকেলের সোনাঝরা রোদ এসে পড়েছে মুখের এক পাশটায়। একের পর এক সাদা মার্লবোরো সিগারেট ধরাচ্ছেন। বাইরের দিকে তাকিয়ে উদাস কণ্ঠে বলছিলেন, ‘এবার আমার ছুটি। আজ আমার কান্নার দিন। ভাই মারা যাওয়ার পরের ৪৫ দিন কাঁদি নাই।ভাইয়ের কবরের সামনে আজ কাঁদব।’ বললাম, কাঁদবেন কেন? আপনারা কি নির্বাচনে হেরে যাচ্ছেন?
উত্তরটা ঘুরিয়ে দিলেন, ‘আমরা ৮০ ভাগ ভোট পাব। আইভীর বাড়ির এলাকার কেন্দ্রে আমার ভাই জিতেছে। কিন্তু এখন আমি কিছু বলব না। শুধু বলব আলহামদুলিল্লাহ।’ ভোটকেন্দ্র দখলে বাধা দেওয়া পুলিশের সাহসী এএসপি মো. বশিরউদ্দীনকেও তিনি বলেন, ‘চারটার মধ্যে ৭০ থেকে ৮০ পারসেন্ট ভোট কাস্ট করতে হবে, তুমি কেন্দ্রটা ছেড়ে দাও এবং চলে যাও।’ দুই জায়গায়ই ৮০ শতাংশ ভোটের কথা তিনি বলেছেন৷ আমাদের বলেছেন, ২০ থেকে ৩০ হাজার ভোটের ব্যবধানে আমরা জিতব৷ এই ‘আমরা’ দল নয়, ওসমান পরিবার৷ দিন শেষে তাদের জয় ১৬ হাজার ভোটে৷ কেন্দ্র দখলে বাধা না পেলে সম্ভবত শামীম ওসমানের নির্বাচনী অঙ্ক কাঁটায় কাঁটায় মিলত!
লুঙ্গি আর টি–শার্ট পরে তিনি বসেছিলেন চেয়ারে৷ বন্ধ জানালা ভেদ করে বাইরে থেকে আসছে সমর্থকদের বিজয়োল্লাস। পটকা ফুটছে৷ নারায়ণগঞ্জে আজ বিএনপি-আওয়ামী লীগ নেই, সবাই সেলিম ওসমানের জাতীয় পার্টি৷ প্রথম বিজয় মিছিল বের হয় বিকেল পাঁচটায়। ভোট গণনা শেষ না হতেই জয়ধ্বনি কেন? নির্বাচনী কর্মকর্তা ও প্রতিপক্ষের ওপর চাপ তৈরি করা?
উত্তেজনা লুকাতে পারছিলেন না তিনি৷ গড়গড় করে অনেক কথা বলছেন৷ দলে দলে কর্মীরা আসছেন। পায়ে হাত দিয়ে নেতাকে সালাম করছেন। ভোটের ঠিকাদারের মতো ভোটের হিসাব দেখাচ্ছেন৷ নেতা তাঁদের বললেন, ‘উল্লাস করবা না, মাথা নত রাখবা৷’ কীভাবে সেটা করতে হবে মাথা ঝুঁকিয়ে তাও দেখিয়ে দিলেন৷
সন্ধ্যার মুখে একটা ফোন এলে চঞ্চল হলেন। ফোন নামিয়ে বললেন, ‘মিডিয়া ক্যু হচ্ছে নাকি? ওরা আনারসের (এস এম আকরােমর প্রতীক) এগিয়ে থাকার কথা বলছে কেন? আর কথা না, তোমরা যাও, পারলে খোঁজ নাও৷ আমি এখন আসরের কাজা নামাজ পড়ব।’
সারা দিন ঘুরে যা দেখেছি, শামীম ওসমানের কথায় তারই স্বীকৃতি৷ ওসমান পরিবার যে ক্ষমতার নিবিড় জাল দিয়ে জেলার প্রশাসন ও রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে, সেই জাল দিয়েই ছেঁকে ভোট তুলে আনা হয়েছে৷ তারপরও আশঙ্কা কেন? কারণ, সম্ভবত এএসপি বশিরের পোষ না মানা আচরণ৷ একজন এএসপি যেভাবে এত বড় ক্ষমতাচক্রকে
নািড়য়ে দিলেন, প্রধানমন্ত্রীর খোলামেলা সমর্থন না পেলে ওসমানদের কী পরিণতি হতো, সেটা ভাবার বিষয়৷ বোঝা যায়, ওসমান পরিবারের ক্ষমতার শিকড় মাটিতে নয়, আকাশে৷
নদীর এপার-ওপার মিলিয়ে দুই ধরনের ভোটকেন্দ্র দেখলাম: জনশূন্য ও কর্মীবহুল৷ আমলা পাড়া, কবি নজরুল, দাসেরগাঁও বিদ্যালয়ে ভোটার আসছে টিপটিপ বৃষ্টির মতো একটি-দুটি করে৷ আর বার একাডেমি, মরিয়ম উচ্চবিদ্যালয়, নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে ওসমান সমর্থকদের ভিড়৷ প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের সামনে দলবল নিয়ে তারা আছেন৷ স্বতন্ত্র প্রার্থী এস এম আকরামের লোকজন বিরল৷ দুজনকে পেলাম শীতলক্ষ্যার খেয়ানৌকায়৷ বয়স্ক এক নারী ইিঙ্গতে বোঝালেন আকরামকেই তাঁর পছন্দ৷ তাঁর যুবক পুত্রও তাই৷ নবীগঞ্জ গুদারাঘাটে পেলাম একদল তরুণকে, লাঙ্গলের লোক। জিজ্ঞাসা কির, ভোট দিতে যাচ্ছেন, নাকি নিতে? একজন হেসে উত্তর দিলেন, ‘দুইডাই।’ অর্থাৎ তাঁরা ভোট দেবেও, নেবেও।
ভোট কীভাবে নেয়, তা দেখলাম সকালে, বার একাডেমি ভোটকেন্দ্রে। পুরুষদের অংশে চারটি বুথ। একটিতেও আনারসের পক্ষের প্রকৃত পোলিং এজেন্ট নেই। একজনের ভোটার তালিকা, নির্বাচন কমিশনের দেওয়া পরিচয়পত্র কিছুই নেই৷ আরেকজনের পরিচয়পত্রে নামই নেই৷ একই প্রার্থীর হয়ে কাজ করলেও কেউ কাউকে চেনেন না৷ এক এজেন্ট নাম বললেন আজিজুল হক অথচ পাশের ঘরে থাকা তাঁরই সহকর্মী বললেন ওই এজেন্টের নাম আসিফুজ্জামান। ১ নম্বর বুথে ভোটার স্লিপ ছাড়াই একজন ঢুকলেন, বললেন হার্টের রোগী; তাই তাড়াতাড়ি ভোট দিয়ে চলে যাবেন। সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার যাচাই না করেই ব্যালট পেপার তুলে দিলেন। পোলিং এজেন্টরা নির্বিকার৷ আরেক ঘরে ৩০ বছর বয়সী এক নারী এলেন৷ লাঙ্গলের এজেন্ট তাঁকে দিলেন ৬০ বছর বয়সী আরেক ভোটারের পরিচয় নম্বর। সেখানেই আরেক ভুয়া ভোটার মিলল৷ সাংবাদিক দেখে তাৎক্ষণিকভাবে ভোটারের লাইন সাজিয়ে ফেলা হলো৷ বারান্দায় ঘোরাফেরা করা সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারকে নিয়ে বেঞ্চে বসানো হলো৷ বিবি মরিয়ম উচ্চবিদ্যালয়ে আনারসের পোলিং এজেন্ট আনুষ্ঠানিক পরিচয়পত্র দেখাতে পারলেন না। কেন্দ্রে কেন্দ্রে যে সিস্টেমেটিক কারচুপি, তা অভিনব ও অবাধ৷
লাঙ্গলের লোকেরা আসল আর প্রতিপক্ষ আনারসের বেশির ভাগ এজেন্টই নকল—এমনটা হয় কখন? যখন একই পক্ষ করে সরকারি ও বিরোধী দলের অভিনয়৷ সংসদে জাতীয় পার্টি যেমন সাজানো বিরোধী দল, নারায়ণগঞ্জে তেমনি আনারসের আসল এজেন্টদের তাড়িয়ে বসানো হয়েছে বানোয়াট প্রতিদ্বন্দ্বী। ডান হাত-বাঁ হাত মিলে খেলছে মনমতো খেলা। দেখার কেউ নেই৷
নুলুয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসা থেকে আনারসের প্রতিনিধি নিলয় দাসকে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ করলেন

আনারস প্রতীকের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান মাসুম। ক্ষণে ক্ষণে তাঁর কাছে অভিযোগ আসছিল৷ জানালেন, নিলয় দাসকে দুই ঘণ্টা আটকে মারধর করে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
মুছাপুর ইউনিয়নের দাসেরগাঁও প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গেলাম বেলা আড়াইটার দিকে। সকালে এখানকার আনারসের এজেন্টকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল৷ দুপুরে তাঁকে পাওয়া গেল, তবে পরিচয়পত্রে ছবি নেই, নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তার সই নেই। তিনি তাঁকে বের করে দেওয়ার কথা অস্বীকার করলেন। বললেন, মুঠোফোন নিয়ে ভোটকেন্দ্রে থাকার নিয়ম না থাকায় ফোন বাড়িতে রাখতে গিয়েছিলেন। অথচ সেখানকার অন্য এজেন্টরা দিব্যি তাঁদের মুঠোফোন প্রিসাইডিং অফিসারের কাছে জমা রেখেছেন। আরেক কক্ষের আনারসের পোলিং এজেন্ট আমেনা বেগম। তাঁকে পাঠিয়েছেন এক ‘ভাই’। বলেছেন ৫০০ টাকা দেবেন। আমেনা বেগমের আশা এক হাজার টাকা। আনারসের আরেক এজেন্ট মনির হোসেন৷ বললাম, আপনি আওয়ামী লীগ করেন? হকচকিত হয়ে বললেন, ‘হ৷’ তাঁকে বসানো হয়েছে আনারসের মনোয়ারা বেগমের বদলি হিসেবে৷ মনোয়ারা বেগম নাকি অসুস্থ হয়ে চলে গেছেন!
এখানে সকালে আওয়ামী লীগের শত শত কর্মী ছিলেন। এখনো আছেন জনা পঞ্চাশেক৷ পথে আর ভোটকেন্দ্রে এ রকম দলবদ্ধ মহড়া দেখে প্রতিপক্ষের সমর্থক ও ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আসার সাহস হওয়ার কথা নয়। এঁদেরই একজন ফোনে বলছিলেন, ‘ঘরে ঘরে কইয়া দিছি লাঙ্গলে ভোট দিবি। না দিলে আসার দরকার নেই।’ তিনি এলাকার যুবলীগের আহ্বায়ক আলমগীর আহমেদ। বললেন, ‘অভিযোগ মিথ্যা। আনারসের প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট দিবারই পারেনি৷ দু-চারজন যারা আছে হেরা আমাগেরই লোক।’ বললেন, ‘আপনি তো জানেন কেন এখানে আছি। দলের নির্দেশ, আমরা দল মানি৷’ বললাম, আপনি লোকজনকে আনারসে ভোট দিতে নিষেধ করছিলেন কেন? আমি নিজের কানে শুনেছি বলায় হেসে ফেললেন, ‘আরে, ওইটা ভাবি ছিল, একটু দুষ্টামি করছি।’ ভোটাররা যুবলীগের নেতার ভাবি বা দুলাভাই হলে দুষ্টুমি তো মধুরই হবে!
এই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার কাজী কাওসার আহমেদ। ভাত খেয়ে পান চিবুচ্ছিলেন৷ বললেন, কোনো অনিয়ম নেই। অথচ তাঁর ৩০ গজ দূরেই ভোটারদের আসবার চিকন আইলপথে বেঞ্চি পেতে বসা চারজন তরুণ৷ সাংবাদিকেরাই যা একটু পাত্তা পাচ্ছেন। তাই তাঁদের ওপর চোটপাট দেখালেন নারায়ণগঞ্জ নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহা। ভোট গ্রহণের একেবারে শেষ মুহূর্তে নারায়ণগঞ্জ ক্লাব কেন্দ্রে গিয়ে প্রিসাইডিং অফিসারকে ধমকালেন, কেন সাংবাদিকেরা সেখানে আছে। পুলিশ সামলেছেন, প্রশাসন সামলেছেন, বাদ সেধেছে মিডিয়া।
খেয়ানৌকার ওই প্রৌঢ় নারী বলছিলেন, ‘ভোট তো দিছি কিন্তু যেভাবে নামছে, কী যে অইব।’ কী হবে তা বোঝা গেল শামীম ওসমানের কথায়। ভোট গণনা শেষ হওয়ার আগেই তিনি বিজয়ের জন্য ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বললেন। বলছিলেন, নারায়ণগঞ্জকে তিনি পাল্টে দেবেন। বললাম, আপনি তো বললেন ছুটি নেবেন আর সাংসদ থাকবেন না। তাহলে কীভাবে পাল্টাবেন? কপালে হাত দিয়ে বললেন, ‘নেত্রীকে বলব, তিনিই সব করবেন। তবে এখন কিছু বলব না, আগে বাবার সঙ্গে কথা বলব, তারপর সব জানাব।’ তাঁর কথায় মনে হলো, এই ‘বাবা’ উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কেউ। তাঁকে দেখার ইচ্ছা মিটল না৷ আফসোস!
শামীম ওসমানের কক্ষ থেকে যখন বেরিয়ে আসি, তখন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা বাজে। ফল ঘোষিত হয়নি। তবু মিছিলের পর মিছিলে ভরে গেছে জাতীয় পার্টির দপ্তরের সামনের রাস্তা৷ একটু আগে শামীম বলছিলেন, ‘মিডিয়া ক্যু করে আমাদের হারিয়ে দেবে না তো?’ ক্যু বলি, আর কারচুপি বলি—কিছু একটা হয়েছে। তবে সেটা যে ওসমান পরিবারের পক্ষে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
শহরজুড়ে বৃষ্টি নেমেছে। শামীমের ভাষায়, ‘রহমতের বৃষ্টি’৷ ‘নারায়ণগঞ্জের মোদি’ এখন একা থাকবেন, ‘বাবার’ সঙ্গে কথা বলবেন৷ আমরা বেরিয়ে এলাম। মনে প্রশ্ন, এই বিজয়ে কি ত্বকীর খুনিরা বেঁচে যাবে? সাত খুনে ওসমান পিরবারের জড়িত থাকার অভিযোগ হালকা হবে? প্রতিহিংসা নেমে আসবে না তো বিপক্ষের ওপর?
নারায়ণগঞ্জ শেখাল, কীভাবে ক্ষমতার দাপটে গণরায় লোপাট করা যায়। এটা একটা মডেল৷ সরকার এই ফর্মুলা সারা দেশে কাজে লাগাতে পারে৷ তাহলে আর ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন করতে হবে না। সরকারের একটি দুর্গ রক্ষা পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু নির্বাচনের ইজ্জত বাঁচেনি৷ তবে খেলা এখনো বাকি৷ এখন মধ্যাহ্ন বিরতি৷
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
[email protected]