দায় চিকিৎসকের, চিকিৎসাপদ্ধতিরও

চিকিৎসাপদ্ধতির সঙ্গে ‘সেবা’ শব্দের পরিবর্তে ‘বাণিজ্য’ শব্দটি এখন প্রতিষ্ঠিত। চিকিৎসা নামক পণ্যের কারবারি যাঁরা, তাঁরা অনেক সময় রোগীদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে অর্থ উপার্জনের জন্য সব রকম নির্মমতা প্রয়োগ করেন। একজন সাধারণ মানুষ যখন রোগী হয়, তখন সে চিকিৎসকের অর্থ উপার্জনের ঘুঁটিতে পরিণত হয়। কিছু কিছু চিকিৎসক অতিরিক্ত উপার্জনের জন্য অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর ওষুধ লেখেন ব্যবস্থাপত্রে। অনেক সময় অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারেরও শিকার হতে হয় রোগীকে। কোনো উপায় থাকে না বলে একজন রোগী অনেক অবিশ্বাস-অনিশ্চয়তা জেনেও চিকিৎসকের দ্বারস্থ হয়। সব চিকিৎসকই যে এই অনৈতিক কাজ করেন, তা নয়। অনেক চিকিৎসক আছেন, যাঁরা মেডিকেল ইথিকস মেনে চিকিৎসা দেন। রোগীরা তাঁদের দেবতাতুল্য জ্ঞান করে। কিন্তু চিকিৎসাপদ্ধতি দুষ্টুচক্রে পরিণত হওয়ায় সামগ্রিকভাবে এ পদ্ধতি সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারণা ধীরে ধীরে বর্তমান আস্থাহীনতার পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে।
সারা দেশে যখন চিকিৎসকদের আচরণ-কর্মকাণ্ড নিয়ে নেতিবাচক সমালোচনা চলছে, তখন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) উদ্যোগ নিয়েছে এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যতক্রমধর্মী কাজের—আস্থা ফেরানোর উদ্যোগ, আত্মশুদ্ধির উদ্যোগ। চিকিৎসকদের যেমন ত্রুটি আছে, তেমনি অনেক সীমাবদ্ধতার কারণেও তাঁরা বিভিন্ন সমালোচনামূলক পরিস্থিতির শিকার হন। বিএমডিসি যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, তা আমাদের দেশে বিরল। এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানানো উচিত। বিএমডিসির উদ্যোগ হচ্ছে চিকিৎসকদের শোধরানোর একটি উপায় বের করা। সেই উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় রংপুরে ২৬ জুন আয়োজন করা হয় ‘ইথিক্যাল গাইডলাইনস ফর মেডিকেল প্রাকটিস’ শীর্ষক এক কর্মশালার। এখানে রংপুর বিভাগের সুশীল সমাজের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি, শীর্ষস্থানীয় চিকিৎসক, চিকিৎসক নেতা ও সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। রংপুর মেডিকেল কলেজের সভাকক্ষে ÿপ্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ আবদুর রউফের সঞ্চালনায় কর্মশালায় আয়োজকেরা সবার উদ্দেশে চিকিৎসকদের ভুলত্রুটিগুলো তুলে ধরতে অনুরোধ করেন। তাঁরা চিকিৎসকদের কী কী ভুলত্রুটি আছে, কীভাবে সেগুলো সংশোধন করা যায়, সে বিষয়ে সবার মতামত চান।
কর্মশালায় শুধু নীতিকথা বলে নয়, শক্ত আইন প্রণয়ন করে তা প্রয়োগ করা, প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে এক্সটারনালদের টাকাভর্তি খাম দিয়ে শিক্ষার্থীদের পাস করানোসহ চিকিৎসকদের অনেক ত্রুটির কথা যেমন উঠে এসেছে, তেমনি সরকার প্রকৃত অর্থে সাধারণ জনগণকে চিকিৎসাসেবা দিতে চায় কি না, সেই প্রশ্নও উত্থাপিত হয়েছে। এর মধ্যে যে কথাটি বারবার আলোচিত হয়েছে, সেটা হলো চিকিৎসকদের আচরণ। অনেকেই চিকিৎসকদের আচরণ বন্ধুসুলভ করার পরামর্শ দেন।
সিপিবির রংপুর জেলা সভাপতি শাহাদৎ হোসেন চিকিৎসকদের সারা রাত ধরে রোগী দেখার বিরুদ্ধে আইন থাকা উচিত বলে মত দেন। বিএমডিসির সভাপতি আবু শাফি আহমেদ আমিন সাধারণ মানুষ রোগের স্বীকার হলে কীভাবে গরিব হয়, সেই বাস্তবতা ব্যাখ্যা করে এটাকে গরিবি চক্র বলে উল্লেখ করেন। সরকারি কলেজের অধ্যাপক মোজাহার আলী চিকিৎসাকেন্দ্রগুলো দালালমুক্ত করার কথা বলেন। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক কোষাধ্য মোজাম্মেল হক চিকিৎসকদের অন্তর্কোন্দল দূর করে সেবক-চিকিৎসকদের পুরস্কৃত করার কথা বলেন। প্রাইভেট মেডিকেল প্র্যাকটিশনারস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক অশোক ভদ্র মেডিকেল শিক্ষার্থীদের ওরিয়েন্টেশন এবং সনদ প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করে তাঁদের ইথিকস সম্পর্কে ধারণা দেওয়া প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন। লাইজু চিকিৎসকদের নৈতিকতা শিক্ষার ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা বলেন। সেই সঙ্গে ভুল চিকিৎসা আস্থা কমায় বলে তা প্রচারণা বন্ধ করার পরামর্শ দেন, ভুল চিকিৎসা হয়েছে কি না, তা নির্ধারণ করার জন্য বোর্ড থাকা উচিত বলে মনে করেন। সাধারণ মানুষের চিকিৎসক সম্পর্কে ধারণা খুবই খারাপ বলে উল্লেখ করেন বিএমএর সভাপতি দেলোয়ার হোসেন। ওষুধ কোম্পানি প্যাথলজি চিকিৎকদের নষ্ট হওয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত বলে উল্লেখ করেন।
চিকিৎসাসেবা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে সরকারের পদ্ধতিগত ত্রুটিও কম নয়। আমাদের চিকিৎসাপদ্ধতিতে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয় উপজেলা হাসপাতালে। উপজেলা হাসপাতালে জরুরি বিভাগের জন্য কোনো চিকিৎসক দেওয়া নেই। এ কারণে যে কয়েকজন চিকিৎসক আছেন, তাঁদের দিয়েই চলে জরুরি সেবার কাজও। উপজেলা হাসপাতালগুলো আগে ছিল ৩১ শয্যার। সেগুলোর অধিকাংশই এখন ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়েছে। চিকিৎসকের সংখ্যা নয়জনের স্থানে ২২ জন করার কথা থাকলেও সেই সংখ্যা নয়জনই আছে। জেলা শহরের

সবচেয়ে নিকটবর্তী উপজেলা ছাড়া কোনো উপজেলায় পূর্ণসংখ্যক চিকিৎসক থাকেন না। কখনো কখনো আবাসিক চিকিৎসক এবং উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ছাড়া মাত্র একজন মেডিকেল কর্মকর্তা দিয়েই চালানো হয়
একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। পূর্ণসংখ্যক চিকিৎসক থাকলেও একেকজন মেডিকেল অফিসারকে দৈনিক গড়ে ১৪ থেকে ১৬ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করতে হয়। একজন চিকিৎসক নিয়মিত দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যখন আর কোনো কাজ করতে পারেন না, তখন তাঁরা ফাঁকির আশ্রয় নেন।
চিকিৎসক ছাড়া দেশের আর কোনো ক্যাডার নেই, যেখানে পদোন্নতির জন্য স্নাতক পাসের পর আরও কোনো ডিগ্রি প্রয়োজন হয়। অন্য সব পেশার জন্য কাজের চাপ কম, আবার পদোন্নতির জন্য কোনো ডিগ্রির প্রয়োজন হয় না। চিকিৎসকদের যেহেতু পদোন্নতির জন্য আরও ডিগ্রির প্রয়োজন আছে, তাই তাঁদের সেই ডিগ্রি অর্জনের জন্য কাজ ফাঁকি দিয়ে ডিগ্রি অর্জনের জন্য লেখাপড়া শুরু করেন। দেশে এখন পর্যন্ত তুলনামূলক মেধাবী শিক্ষার্থীরা চিকিৎসা বিষয়ে পড়তে যান। কিন্তু রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে তাঁরা পদোন্নতি-বৈষম্যের শিকার হন। অথচ অন্য যেকোনো ক্যাডারের চেয়ে রাজনীতির প্রশ্নে চিকিৎসকেরা সবচেয়ে প্রকাশ্যে যুক্ত।
অনেকগুলো উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জরুরি প্রসূতিসেবা পদ্ধতি সরকার চালু করলেও তা বাস্তবে অকার্যকর হয়ে আছে। প্রসূতি বিশেষজ্ঞ ও অবেদনবিদকে বেলা দুইটার পরও জরুরি সেবা দিতে হবে বলে তাঁরা প্রসূতিসেবার কোনো কাজই করেন না।
এ ছাড়া ইউনিয়ন পর্যায়ে অনেকগুলো উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র খোলা হয়েছে। খুবই ভালো উদ্যোগ। কিন্তু ইউনিয়ন পর্যায়ে একজন চিকিৎসকের থাকার অবকাঠামোগত এবং নিরাপত্তাগত কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই ইউনিয়ন পর্যায়ে কোনো চিকিৎসক থাকতে চান না।
অনেক সময় তাই চিকিৎসা কর্মকর্তা ইউনিয়ন পর্যায়ে পদায়ন করা থাকলেও উপজেলা হাসপাতালে তাঁদের সংযুক্তি হিসেবে কাজ করানো হয়। উপজেলা পর্যায়ে রাজনীতিকদের কিংবা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মিথ্যা মেডিকেল সার্টিফিকেটের এবং জোর করে রোগী ভর্তি করিয়ে রাখার জন্য চাপ থাকে।
জেলা পর্যায়ের হাসপাতালেও জরুরি বিভাগে কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকেন না। এমনকি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও জরুরি বিভাগে কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকেন না। দেশের সব চিকিৎসাকেন্দ্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে অন্তর্বিভাগ এবং জরুরি বিভাগেও ২৪ ঘণ্টা রাখার ব্যবস্থা করা অত্যন্ত জরুরি। নন–প্র্যাকটিসিং চিকিৎসকদের জন্য বিশেষ ভাতা থাকা জরুরি। তা না হলে ব্যাসিক বিষয়ে পড়ানোর জন্য এখন যে চিকিৎসক-সংকট রয়েছে, তা দূর হবে না।
হাসপাতালগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য সরকারের প্রয়োজনীয় অর্থ ও জনবল অপর্যাপ্ত। যে জনবল আছে, তাদের দিয়েও পরিষ্কার-পচ্ছিন্নতার কাজ ঠিকভাবে করানো সম্ভব হয় না, যার দায় বর্তায় চিকিৎসকদের ওপর। হাসপাতাল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য বেসরকারি সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও বারডেম হাসপাতালে এই পদ্ধতি চালু আছে। হাসপাতালগুলোয় রোগীদের অপেক্ষা করার মতো কোনো ব্যবস্থা না থাকার কারণে চিকিৎসা নিতে এসে তারা অপেক্ষা করতে চায় না। সে জন্য রোগীরা একটুতেই উত্তেজিত হয় এবং চিকিৎসাপদ্ধতি সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে। হাসপাতালগুলোয় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ–ব্যবস্থা রাখা জরুরি।
বর্তমান চিকিৎসা-সংকট কাটাতে তাই চিকিৎসকদের যেমন নৈতিকতায় ফিরতে হবে, তেমনি সরকারি সীমাবদ্ধতা দূরীকরণে প্রয়োজনীয় উদ্যোগও জরুরি। তা না হলে রোগীবান্ধব চিকিৎসাপদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করা যাবে না।

তুহিন ওয়াদুদ, শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর

[email protected]