দেশে দেশে উচ্চশিক্ষা নিয়ে প্রতারণা

উচ্চশিক্ষা
উচ্চশিক্ষা

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য আর বাংলাদেশ তিন মেরুর তিন দেশ। সাম্প্রতিক কালে তিন দেশই একটি অভিন্ন সমস্যায় ভুগছে, আর তা হচ্ছে উচ্চশিক্ষায় নানামুখী সংকট। একসময় বাংলাদেশের ছাত্ররা যুক্তরাষ্ট্রে পড়ালেখা করার জন্য যেতে কত রকমের চেষ্টা-তদবির করতেন। যুক্তরাষ্ট্র আবার ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো বোঝে। তারা টোএফএল, জিআরই, জিমেট, স্যাট—কত রকমের পরীক্ষার পসরা সাজিয়ে সারা দুনিয়ার ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে কোটি কোটি ডলার তুলে নিত। এই পরীক্ষায় পাস করা ছিল সে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তির পূর্বশর্ত।
এখন এসবের ওপর বেশি জোর দেওয়া হয় না। বলে, ঘাটতি থাকলে তাতে সমস্যা নেই। যুক্তরাষ্ট্রে আসতে পারলে আমরাই তোমাদের ঘাটতি পুষিয়ে দেব। তবে ঢালতে হবে এক কাঁড়ি ডলার। গত শনিবার পত্রিকান্তরে যুক্তরাষ্ট্রের ৩৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে একটি এদেশীয় এজেন্ট বিজ্ঞাপন দিয়ে বলেছে, তারা এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোসহ যুক্তরাষ্ট্রের ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য সব ধরনের সহযোগিতা করবে। এগুলোর প্রায় সবই প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়।
যুক্তরাজ্যে ৬০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি নিষিদ্ধ করা হয়েছে সম্প্রতি, কারণ তারা ভর্তি-বাণিজ্য করছিল। এ দুটি দেশের উচ্চশিক্ষা সম্পর্কে আলোচনায় পরে আসছি। আগে নজর ফেরাই নিজের দেশের দিকে।
কয়েক দিন আগে একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্যের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। নিয়োগ পেয়েছেন বেশি দিন হয়নি। জানতে চাই, কেমন চলছে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়। জবাবে বললেন, চেষ্টা করছেন, কিন্তু তেমন ভালোভাবে চালাতে পারছেন না। প্রথমে ছাত্রলীগ নামধারী মাস্তানরা নানা অজুহাতে প্রায়ই ক্যাম্পাস অচল করে দেয়। আগে তাদের সঙ্গে অন্য ছাত্রসংগঠনগুলোর সংঘাত হতো। বর্তমানে ক্যাম্পাসে বিরোধী ছাত্রসংগঠনগুলোর তেমন তৎপরতা নেই। ফলে ছাত্রলীগ নিজেরাই ভাগ হয়ে একে অন্যের প্রতিপক্ষ হয় আর হানাহানি করে।
উপাচার্য জানালেন, তাঁর এলাকায় নতুন উপদ্রব রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা। সাংসদ থেকে উপজেলা পরিষদের সদস্য—কেউ বাদ যাচ্ছেন না। সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ডে নাক গলাতে চান। পদ না থাকলেও বলেন, তাঁর পছন্দ মাফিক লোকজনকে চাকরি দিতে হবে। না দিলে দেখে নেওয়ার হুমকি। সবাই মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়টি যেহেতু তাঁর এলাকায় প্রতিষ্ঠিত, সেহেতু এটি তাঁর পৈতৃক সম্পত্তি। বুঝতে চান না যে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য একটি নিজস্ব আইন আছে। এটি মনে করিয়ে দিলে তাঁরা ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ‘আমাকে আইন দেখাবেন না।’
উপাচার্যদের এমন অসহায় অবস্থা আগে কখনো দেখা যায়নি। কদিন আগে আমার আগের কর্মক্ষেত্র চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম চ্যান্সেলরের মনোনীত সদস্য হিসেবে বার্ষিক বাজেট অধিবেশনে অংশ নিতে। অস্বীকার করার উপায় নেই, এই বিশ্ববিদ্যালয় আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো চলছে। সেশনজট থেকে অনেকটা মুক্ত। প্রচুর উন্নয়নের কাজ হচ্ছে। মাঝেমধ্যে উল্লিখিত ওই ছাত্রসংগঠনের নিজেদের মধ্যে সৃষ্ট হানাহানির কারণে বিশ্ববিদ্যালয় অচল থাকে। একবার এ বিষয়ে লিখেছিলাম বলে আমি সেখানে অবাঞ্ছিত ঘোষিত হয়েছিলাম।
সিনেট অধিবেশনে একজন সদস্য জানতে চাইলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অফিস কেন ভারপ্রাপ্তদের দিয়ে চলছে? অবাক করার বিষয় হচ্ছে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় দুই দশকের বেশি সময় ধরে কোনো দপ্তরেই পূর্ণকালীন অফিসপ্রধান নেই। এই না থাকার কারণ, বিভিন্ন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মকর্তা পর্যায়ে যেসব নিয়োগ হয়েছিল, তা সব সময় যোগ্যতার ভিত্তিতে হয়নি। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও এই অনিয়ম অনেক সময় হয়েছে। কেন কোনো অফিসে পূর্ণকালীন অফিসপ্রধান নেই, তা নিশ্চয় সবাই অনুমান করতে পেরেছেন। ভারতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে অফিসপ্রধান নিয়োগের ব্যবস্থা আছে, বিশেষ করে রেজিস্ট্রার পদে। অনেক সময় প্রেষণেও আনা হয়। প্রয়োজনে বাংলাদেশেও এই ব্যবস্থা প্রবর্তনের চিন্তা করা যেতে পারে।
বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার নজরদারি করার জন্য আছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় আর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। দুটিরই কর্ণধার দুজন যোগ্য ও বিচক্ষণ ব্যক্তি। কিন্তু তাঁদের পক্ষে সব সময় উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাপনা প্রত্যাশা অনুযায়ী করা সম্ভব হয় না। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের অনেকটা ব্যক্তিগত উদ্যোগে নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়েছিল, যদিও তা বাস্তবায়নের গতি অত্যন্ত ধীর। এই প্রথমবার একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হলো, যাকে নিয়ে তেমন বিতর্ক ওঠেনি।
২০১০ সালে নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। এটিও নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ৷ কিন্তু সেই আইনে অনেক অসংগতি আর অবাস্তব ধারা রয়ে গেছে, যা অনেকবার উল্লেখ করেছি। যেমন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হলে এক একর অখণ্ড জমির বাধ্যবাধকতা। এমন অবাস্তব শর্ত বিশ্বের অন্য কোনো দেশে আছে বলে জানা নেই। হওয়া উচিত ছিল ছাত্র অনুপাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গার প্রাপ্যতা। ঢাকা শহরে একাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যেখানে ১৫ থেকে ২০ হাজার ছাত্র ভর্তি আছেন। তাঁরা কোথায় বসে ক্লাস করেন, কারা পড়ান, তার খোঁজ কি শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কখনো নেওয়ার চেষ্টা করেছে? প্রায়ই মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান এ কে আজাদ চৌধুরী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা দেখে অনেকটা আহাজারি করেন, কিন্তু কাজ হয় না। সম্প্রতি কমিশন ১০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে শনাক্ত করে বলেছে, এগুলো অবৈধভাবে তাদের কার্যক্রম চালু রেখেছে। এরপর কিন্তু মঞ্জুরি কমিশনের আর কিছু করার থাকে না কারণ তাদের নানা সীমাবদ্ধতা আছে। আর যেসব বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে এই কথাগুলো বলা হচ্ছে, দেখা যাবে সেগুলোর সঙ্গে অনেক ক্ষমতাধর ব্যক্তি জড়িত আছেন।
অথচ এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী নিয়মিত প্রতারিত হচ্ছেন। ভর্তি-বাণিজ্য কথাটি বহুল প্রচলিত। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অথবা কলেজে ছাত্রনেতারা এই বাণিজ্য করেন।কিন্তু কজনে জানেন, কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বাণিজ্যের সঙ্গে বোর্ড অব ট্রাস্টিজের বেশ কিছু সদস্যও জড়িত আছেন? শিক্ষক পদেও নিয়োগের বাছাইপর্বে বোর্ড সদস্যদের কোনো ভূমিকা থাকা উচিত নয়। কিন্তু কিছু হাইপ্রোফাইল বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যেগুলোয় বোর্ড সদস্য যাকে নিয়োগ দিতে বলেন, তার বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা উপাচার্য বা নির্বাচনী বোর্ডের নেই।এখানেও বাণিজ্য হয় বলে অভিযোগ আছে।
মঞ্জুরি কমিশন বলছে, তারা অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল করবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পড়ালেখার মান পরিমাপ করার জন্য। ভালো উদ্যোগ নিঃসন্দেহে, কিন্তু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কেন বাদ যাবে? অনেক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কোনো বিভাগ আছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থার চেয়ে খারাপ। অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল হলে তা সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হওয়া উচিত। আর বর্তমান অবস্থায় মঞ্জুরি কমিশন এই কাজটুকু কতটা সাফল্যের সঙ্গে করতে পারবে, তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কমিশনকে উচ্চশিক্ষা কমিশনে রূপান্তর করার দাবি বহু পুরোনো। সম্ভবত ২০০৭ সালেই আমি প্রথমবার এ বিষয়ে লিখেছিলাম। এ পর্যন্ত কাজ হয়নি কিছু। তবে যেসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চশিক্ষার নামে সরাক্ষণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতারণা করছে, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে। আর যারা ভালো করার চেষ্টা করছে, তাদের উৎসাহিত করতে হবে। মনে রাখা ভালো, বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ভর্তি আছেন। আর সরকার বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বাংলাদেশে চরম বৈষম্যমূলক শর্তে যে স্টাডি সেন্টার খোলার অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা পুনরায় ভেবে দেখতে বলব। এটি হতে পারে একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।
যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলাম। উচ্চশিক্ষা নিয়ে সেই দেশে যে বাণিজ্য হয়, তা অন্য কোনো দেশে চিন্তাও করা যায় না। পাঁচ থেকে সাত হাজার ডলার খরচ করলে দেশের একটি অদৃশ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে কেউ পিএচডি ডিগ্রি পর্যন্ত পেয়ে যেতে পারেন। বাংলাদেশে এমন পিএইচডি শ খানেক তো আছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়কে সে দেশে বলা হয় ‘ব্রিফকেস বিশ্ববিদ্যালয়’। সে দেশের সমস্যা হচ্ছে, তাদের ভ্রান্ত ভিসানীতির ফলে সে দেশে বি দেশি ছাত্রের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাওয়া। আর তাদের দেশের ছেলেমেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের প্রবণতা বর্তমানে তেমন নেই।
যুক্তরাজ্যে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষা নিতে হলে আগের চেয়ে তিন গুণ অর্থ খরচ করতে হয়। সে দেশের ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে তেমন আসছেন না। তাঁদের ভর করতে হচ্ছে বাংলাদেশের মতো গরিব দেশের ছাত্রছাত্রীদের ওপর। সেই সুযোগে প্রতারণা করার উদ্দেশ্যে উচ্চশিক্ষার নামে সেখানে গড়ে উঠেছে অনেক কলেজ আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতারিত হচ্ছেন লাখ লাখ টাকা খরচ করে যাওয়া এ দেশের মতো অনেক দেশের ছাত্রছাত্রীরা। তাঁদেরটা তাঁরা দেখবেন। এখন সময় আমাদের নিজেদেরটার দিকে নজর দেওয়ার। এই নজর কে বা কারা দেবেন, তা দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। তা না হলে এ ক্ষেত্রে নৈরাজ্য চলতেই থাকবে।
লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।