'বিহারি'সহ সব সংখ্যালঘুর কাছে ক্ষমা চাই

গত শবে বরাতের রাতের পরদিন ১৪ জুন সকালে মিরপুরের কালশী বিহারি ক্যাম্পে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও হত্যার ওপর বিভিন্ন পত্রপত্রিকা এবং টিভি-রেডিওতে যত সব খবর এবং প্রথম আলোতে সৈয়দ আবুল মকসুদ ও ফারুক ওয়াসিফসহ আরও কয়েকটি পত্রিকায় যেসব সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয় লিখেছেন, তাতে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া, বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সবার কাছে আমার একটিই কথা: ক্ষমা করুন। যে মোহাম্মদ ইয়াসীনের স্ত্রী, তিন ছেলে, তিন মেয়ে ও এক নাতিকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে, তাঁর কাছে এই সহজ-সরলÿ ক্ষমা প্রার্থনা যে একেবারেই, যথেষ্ট নয়, তা আমি নিশ্চিত জানি। আমার বা আমাদের যে কারও পরিবারে এমন, শুধু একজনের এমন, নৃশংস হত্যা আমাদের বিপর্যস্ত করে দেয়, সেই জায়গায় একজন মো. ইয়াসীনের এতজনের মৃত্যু—নারী, শিশু, কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীকে পুড়িয়ে মারা—সেই মানুষটিকে আমার দেখার তীব্র ইচ্ছা হয়েছিল, কিন্তু আমি সাহস করে উঠতে পারিনি। আমি একজন বাঙালি, বাংলাদেশি—আমাকে দেখে তাঁর ক্ষোভ বা আক্রোশের কথা বলছি না, আমার দিকে করুণ দৃষ্টি দিয়েও তিনি যদি তাকান আর সেই চাহনিতে নিশ্চয়ই তাঁর এই আকুতিটুকু তো থাকবে—আমি, আমরা ‘বিহারি’ বলেই আমাদের ওপর এমন হত্যা, নির্যাতন, অপমান, বিচারহীনতা, তখন আমি কী জবাব দিতে পারি? বাংলাদেশে আমরা কয়েক লাখ সংখ্যালঘু অবাঙালি ‘বিহারি’কে সহ্য করতে পারছি না, অথচ পাকিস্তানের বাসাবাড়িতে কাজ করে এমন কয়েক লাখসহ কয়েক গুণ বেশি বাংলাদেশি এখনো পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে নিম্নমানের কাজ করে যাচ্ছে বলে দায়িত্বশীল সূত্রে জেনেছি।

দুই.
মুক্তিযুদ্ধে দূরের লন্ডন থেকে একটু সম্পৃক্ত ছিলাম বলে অপরাধবোধটা বেশি মনে হচ্ছে। এই প্রসঙ্গে একটি স্মৃতি এখনো জ্বলজ্বল করে। আমার এই স্মৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে দুটি নাম, পল কনেট এবং ইলিন কনেট; তখন তাঁরা তরুণ এক দম্পতি। স্কুলশিক্ষক পল কনেট, মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পক্ষে সার্বক্ষণিক ভিত্তিতে কাজ করার জন্য পল কনেট তাঁর চাকরিই ছেড়ে দিলেন—চাকরি ছেড়ে দিয়েছিেলন ইলিনও। এই ইলিন ’৭১-এর আগস্টে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে বাংলাদেশের যশোর বর্ডার দিয়ে ঢোকার সময় ধরা পড়েলন এবং দীর্ঘমেয়াদি জেল দণ্ডে দণ্ডিতও হলেন। তখনই জানা গেল তাঁর গর্ভে বাচ্চা। ইলিন মুক্তি পেেলন বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর।
এই পল কনেট দম্পতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছে ম্যারিয়েটা—ম্যারিয়েটা প্রকোপে। দীর্ঘাঙ্গী, সুন্দরী অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির মেধাবী ছাত্রী, ’৭১-এ তাঁর লন্ডনের বাড়িটিই দিয়ে দিয়েছিেলন ম্যারিয়েটা, যেখানে স্থাপিত হলো কনেট দম্পতির ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’-এর অফিস—বেশির ভাগ ব্রিটিশকে নিয়ে একটি সংগঠন। এই ম্যারিয়েটা আত্মহত্যা করেলন বাংলাদেশ থেকে ঘুরে গিয়ে ১৯৭২-এর প্রথম দিকে। ম্যারিয়েটাকে নিয়ে আমার কয়েকটি লেখার একটি ছাপা হয়েছিল এই প্রথম আলোতে, কয়েক বছর আগে, এক ডিসেম্বরে।
মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য বাংলাদেশের বিদেশি বন্ধুদের শেখ হাসিনার আগের সরকার সম্মাননা দিল কয়েক দফায়, কিন্তু পল কনেট বা তাঁর স্ত্রীকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ব্যর্থতা ও হতাশাটা আমার বেশি মনে হচ্ছিল। কারণ, ’৭১-এ আমরা ঘনিষ্ঠ ছিলাম এবং আমাদের সরকারের গঠিত সম্মাননা কমিটির একজন সদস্য আমিও।
তারপর হঠাৎ সৌভাগ্য আমাদের। কয়েক বছর আগে, ‘অব অল প্লেসেজ’, কানাডায় এক ট্রেন জার্নিতে পল কনেটকে আবিষ্কার করলেন লে. জেনারেল হারুন–অর–রিশদ, আমাদের এক সাবেক সেনাপ্রধান। তাঁদের সম্মাননা জানানো হলো সিরিজের শেষ অনুষ্ঠানটিতে গত অক্টোবরের প্রথম দিকে। তখন পল ও ইলিন কনেটের আগ্রহে তাঁদের দেখিয়ে আনা হলো যশোর জেলও, যেখানে ইলিন জেল খেটেছেন।
আমাদের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, শামসুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী মানিক, ব্যবসায়ী শিল্পপতি আবদুল মজিদ চৌধুরী, একাত্তরে যুক্তরাজ্যে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের প্রধান এ জেড মোহাম্মদ হোসেন এবং একাত্তরের লন্ডনে আমাদের ‘ফকির সমিতি’র সদস্যরা পল কনেট ও ইলিনকে সংবর্ধনা দিলেন এক সন্ধ্যায় ঢাকার কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে, যেখানে ১৯৪৯-এর ২৩ জুন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। আমি এই সংবর্ধনায় থাকতে পারিনি। কারণ, জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের একজন সদস্য হিসেবে আমি তখন আলাদাভাবে নিউইয়র্কের পথে প্লেনে। তবে পরে, গত বছরের ৬ অক্টোবরের প্রথম আলোতে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে তাঁদের জন্য দেওয়া আরেক সংবর্ধনায়, এখন প্রবীণ, এই যুগলের

ছবিসহ ‘তারা বাংলাদেশের বন্ধু’ শিরোনামের খবরটি নিউইয়র্কে ইন্টারনেটে পড়েছি।

তিন.
এই পল কনেট ’৭২-এর ফেব্রুয়ারি কি মার্চের এক সকালে আমাকে টেলিফোন করলেন। আমাদের হাইকমিশন তখন নটিংহিল গেটের ২৪ পেমব্রিজ গার্ডেনে, এখন যেটি বাংলাদেশ সেন্টার।
পলের কণ্ঠ গম্ভীর, গত কয়েক মাসের পরিচিত ‘চিয়ারফুলনেস’-এর অভাব, তাঁকে বিচলিত মনে হচ্ছিল। বলেলন, মহিউদ্দিন, তোমাদের ওপর পাকিস্তানি গণহত্যার প্রতিবাদে আমার ও ইলিনের ভূমিকা তুমি সম্যক অবহিত। মার্চের প্রথম থেকে আমরা বরফ, তুষারপাতেও লন্ডনের পাকিস্তান হাইকমিশনের সামনে মোমবাতি হাতে ‘ভিজিল’ দিয়েছি। এখন মনে হচ্ছে, তোমাদের হাইকমিশনের সামনেও আমাদের দুজনকে ‘ভিজিল’ দিতে আবার আসতে হবে। আমাকে প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে তিনি বলতে থাকেলন, ব্রিটিশ পত্রপত্রিকা এবং টিভি-রেডিওতে খবর পাচ্ছি, খুলনাতে বিহারিদের ওপর তোমাদের বাঙালিরা খুন ও নির্যাতন শুরু করেছে। পল কনেট আরও বলতে থাকেলন, আমরা কিন্তু সব গণহত্যা, হত্যা, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, নির্যাতনের বিরুদ্ধে। আমরা বাঙালিদের ওপর গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগের বিরুদ্ধে ছিলাম, আমরা বাংলাদেশে সব অবাঙালি, বিহারিদের ওপর হত্যা, নির্যাতনের বিরুদ্ধেও থাকব।
পল কনেটকে সাক্ষাৎ করার জন্য দুপুরে মরহুম তসাদ্দুক আহমেদের পিকাডিলির ‘গঙ্গা’ রেস্টুরেন্টে লাঞ্চের দাওয়াত দিলাম। বললাম, তখন আরও কথা বলা যাবে। আর দ্রুত নতুন ডেপুটি হাইকমিশনার ফারুক চৌধুরীকে বিষয়টি জানালাম। পল কনেটকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য বা হয়তো আমার ওপর আস্থার অভাবের কারণে ফারুক চৌধুরী বিষয়টা ‘টেক-ওভার’ করলেন, পল কনেটকে তিনিই লাঞ্চে দাওয়াত দিলেন এবং সেদিনের মতো পল কনেটকে সামাল দিলেন।

চার.
মুক্তিযুদ্ধ অর্জিত বাংলাদেশে কোনো সংখ্যালঘুর ওপর অত্যাচার, নির্যাতন, ধর্ষণ হবে—এমন তো কথা ছিল না। বাংলাদেশে যে এখন কোনো সংখ্যালঘুই নিরাপদ নয়। বুঝলাম, বিহারিরা বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছে। কিন্তু যে বাংলাদেশের জন্য হিন্দু সংখ্যালঘুরা এমন দুর্ভোগ পোহাল ’৭১-এ, তারা কি নিরাপদে, শান্তিতে আছে? শান্তিতে কী আছে বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, সাঁওতাল, গারো, চাকমা, মারমা, আহমদিয়ারা? বাংলাদেশে কোনো সংখ্যালঘুই কি শান্তি, স্বস্তি ও নিরাপদে আছে?
আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারি না, সেদিন বিকেলে গণভবনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর চীন সফরের অর্জন এবং সাফল্যের ওপর প্রেস কনফারেন্স করলেন; কিন্তু মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে, তাঁর গণভবন থেকে মাত্র দুই মাইল দূরে, একটি পরিবারের নয়জনকে এমনভাবে পুড়িয়ে মারা হলো, আর তিনি সমবেদনার একটি হরফও উচ্চারণ করলেন না!! যাদের পুড়িয়ে মারা হয়েছে তারা যদি পৈতৃক সূত্রে বিহারি অবাঙালি হয়েও থাকে, তারা কি মানুষ নয়? তাদের জন্য কি সহানুভূতি-সমবেদনা থাকতে নেই?
বিহারিরা, অবাঙালিরা ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে; তো চীনারাও তো প্রবলভাবেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। ইয়াহিয়া খানকে দেওয়া তাদের অস্ত্র দিয়ে কত হাজার বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছে। চীনের ভেটোর কারণেই তো আমরা ’৭২-এ জাতিসংঘের সদস্য হতে পারলাম না। আর চীন তো বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় স্বীকৃতি দিলই না। স্বীকৃতি দিল বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ১৫ দিন পর, ৩১ আগস্ট, ১৯৭৫-এ; স্বীকৃতিদানকারী দেশগুলোর তালিকার সর্বশেষ দেশ হিসেবে। চীনের আমরা এখন এত ঘনিষ্ঠ বন্ধু, চীনের সব অতীত অপরাধ আমরা মাফ করে দিতে পারলাম। আর যারা ’৭১-এ জন্মায়নি বা শিশু ছিল, তাদের কেন পুড়িয়ে, গুলি করে মারা হচ্ছে!
মিরপুরের এসব ঘটনার জন্য অভিযুক্ত মিরপুরের সাংসদ ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ কয়েক বছর আগে পুলিশ সার্জেন্ট শরিফুল ইসলামকে মারধর করেছিলেন। শরিফুল ইসলামের অপরাধ, ইলিয়াস মোল্লাহর রাস্তায় আটকে থাকা গাড়িটি বের হওয়ার জন্য অন্য সব গাড়িকে সরিয়ে রাস্তা করে দেননি। তখন ইলিয়াস মোল্লাহকে আসামি করে যখন এই পুলিশ সার্জেন্ট থানায় মামলা করলেন, তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন মন্তব্য করেছিলেন—মামলা করতে গেলেন কেন তিনি। আমাদের বললেই তো মীমাংসা করে দিতাম। কী তামাশাই না করলেন সাহারা খাতুন!
মহিউদ্দিন আহমদ, সাবেক সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়