এখনো বিবিসি ভরসা

বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রচারের জন্য বিবিসির (ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশন) ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা আছে। ১৯২২ সালে এক রাজকীয় সনদের মাধ্যমে এ বিধিবদ্ধ সংস্থাটি প্রতিষ্ঠিত হয়, ক্রমান্বয়ে এর কলেবর বাড়ে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বাধীনতার পক্ষশক্তির জন্য তথ্যনির্ভর খবরের বড় উৎস ছিল বিবিসি। শুধু শহর-নগরে নয়, গ্রাম-গ্রামান্তরেও সমাদৃত হয়েছে বিবিসির সংবাদ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে জোরদার করার মনোবলে প্রভূত ইতিবাচক অবদান রেখেছে। স্বাধীনতার পরেও সময়ে সময়ে এর খবরই শুনতে হতো আমাদের। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময়ও বিবিসি ছিল বস্তুনিষ্ঠ খবরের প্রধান উৎস। শাসকের রক্তচক্ষু স্থানীয় সংবাদপত্রগুলোর উপেক্ষা করার সুযোগ ছিল খুবই কম। আর বেতার-টিভি ছিল সরকারি। তাই বিবিসিই ভরসা। বিশেষ ক্ষমতা আইনবলে সংবাদপত্র বন্ধ করার বিধানটি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হয়ে স্থায়ীভাবে রদ করে গেছেন। ১৯৯৬-এর পর বেসরকারি টিভি চ্যানেল আসতে শুরু করে। খবর প্রচারে সীমাবদ্ধতা ক্রমান্বয়ে কেটে আসছে। কিন্তু পুরোপুরি যে কাটেনি তাও মাঝেমধ্যে দেখা যায়।
কয়েক দিন আগে হঠাৎ করে দু-একটি সংবাদপত্র বিবিসি বাংলার সূত্রে খবর দিল, ভারতের অঙ্গরাজ্য ত্রিপুরায় ১০ হাজার টন চাল-গম পাঠাতে ট্রানজিট দিয়েছে বাংলাদেশ। এ দেশের নৌপথ ও আশুগঞ্জ বন্দর ব্যবহার করে এ খাদ্যশস্য ৪৫ কিলোমিটার সড়কপথ পেরিয়ে আগরতলা যাবে। ত্রিপুরার খাদ্য ও গণবণ্টন দপ্তরের মুখ্য সচিবের বক্তব্য উল্লেখ করে বিবিসি খবরটি প্রচার করে। ভারতীয় পক্ষ আশা প্রকাশ করেছে এ ব্যবস্থা সফল হলে এভাবেই ত্রিপুরায় যাবে ভারতের অন্য অঞ্চলের পণ্যসামগ্রী। এ প্রক্রিয়ায় ট্রানজিট ফি বা অন্য কোনো মাশুল নেওয়া হবে কি না, এর কোনো জবাব দেয়নি ভারতীয় পক্ষ। ত্রিপুরায় চাল-গমের চালান পাঠানোতে বাংলাদেশ ভূখণ্ড ব্যবহারে নীতিগত কোনো আপত্তি তেমন কেউ করার কথা নয়। তবে এ সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের সম্পূর্ণ নীরবতা প্রক্রিয়াটিকে অস্বচ্ছ আর প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। অতীতেও ত্রিপুরায় পণ্যসামগ্রী ট্রানজিটে একই পথে একই ধরনের অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নেওয়া হয়েছিল। আর এরূপ হতে থাকলে অকারণ সন্দেহ আর বিভ্রান্তি সৃষ্টির আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ট্রানজিট কোনো ছোটখাটো বিষয় নয়। একটি সার্বভৌম অধিকারের ওপর অন্যকে শরিকদার করতে দেশের জনগণকে সুস্পষ্টভাবে জানানো দরকার।
ত্রিপুরা আমাদের অতি নিকট প্রতিবেশী একটি ছোট ভারতীয় রাজ্য। ১৯৭১ সালে এর লোকসংখ্যা ছিল সাড়ে ১৫ লাখ। সে সময়ে এ রাজ্য বাংলাদেশ থেকে যাওয়া ১৬ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিল। এ বিবেচনায় ত্রিপুরাবাসী বাংলাদেশের কাছে কিছু বেশি দাবি করতেই পারে।বাংলাদেশও এ বিষয়ে সংবেদনশীলতার পরিচয় দিয়েছে সময়ে সময়ে। আগে একবার খাদ্যশস্যের চালান গেছে বিনা মাশুলে।গেছে সে রাজ্যে ৭৬৩ মেগাওয়াট একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অতি ভারী মালামাল। এসব মালামাল দুর্গম পাহাড়ি পথে আনা প্রায় অসম্ভব ছিল। ২০১১ সালে সহযোগিতার হাত বাড়াল বাংলাদেশ।এ ধরনের ওভার ডাইমেনশনাল বিপুল পরিমাণ কার্গো পার করার জন্য কয়েকটি বিকল্প রাস্তা করা হয়। আখাউড়া রেলসেতু-সংলগ্ন স্থানে তিতাস নদের মূল স্রোতোধারায় বাঁধ দিয়ে ৪৫০ মিটার রাস্তাও নির্মিত হয়। কয়েক মাসব্যাপী চলে বিনা মাশুলে এ মালামাল পারাপারের কাজ। ২০১৩ সালের জুনে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু হয়।অতিসম্প্রতি সুষমা স্বরাজের সফরকালে সিদ্ধান্ত হয়েছে এ বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বাংলাদেশ ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কিনতে পারবে।সিদ্ধান্তটি ইতিবাচক।
এখানে উল্লেখ করা যায় যে আশুগঞ্জ থেকে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলার দূরত্ব ৪৫ কিলোমিটার। আর কলকাতা থেকে গুয়াহাটি হয়ে এর দূরত্ব এক হাজার ৬৫০ কিলোমিটার। এমনকি স্থলপথেও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে কলকাতা থেকে আগরতলার দূরত্ব ৩৫০ কিলোমিটার। তাহলে সহজে অনুমান করা যায়, বাংলাদেশকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করলে ত্রিপুরায় পণ্য পরিবহন ব্যয় ও সময় অনেকাংশে কমে যাবে। অন্যদিকে এ দেশের রাস্তা, বন্দর ও নৌপথ রক্ষণাবেক্ষণের খরচ বাড়তে থাকবে। নৌপথে জলযানের নির্গত বর্জ্য পরিবেশের ক্ষতি করবে। বাংলাদেশের কিছুটা প্রশাসনিক ব্যয়ও হবে। এসব দিক বিবেচনায় বেঁচে যাওয়া খরচের একটি অংশ ট্রানজিটের মাশুল হিসেবে ধার্য করা অত্যন্ত যৌক্তিক।শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে দু-একবার বিনা মাশুলে যেতে দেওয়া যায়। কিন্তু এ রকমই চলতে থাকা অযৌক্তিক ও অস্বাভাবিক।বাংলাদেশের মানুষ প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক চায়। তবে এটাও চায় যে তা হবে ন্যায্যতা ও বাস্তবতার আলোকে। ত্রিপুরার বিদ্যুৎ আমাদের বাজারমূল্য দিয়েই কিনতে হবে। তাই স্বাভাবিক। এ দুর্লভ জিনিস ভারত দিচ্ছে, তার জন্য আমরা অবশ্যই কৃতজ্ঞ। ঠিক তেমনি ট্রানজিটও একটি বিরল সুযোগ। এর বাজারমূল্য নির্ধারণ খুবই কঠিন। তবে খোলা মনে বাস্তবতার আলোকে আলোচনার মাধ্যমে একটি ন্যায়সংগত মাশুল ধার্য করতে আর বিলম্ব করা উচিত নয়। তদুপরি বৃহত্তর পরিসরে তা করতে হলে আগে অবকাঠামো জোরদার করা অত্যাবশ্যক।
এমনিতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে কিছুটা টানাপোড়েন আছে। উভয় দেশে এমন কিছু লোক আছে, যারা দেশ দুটোর মাঝে ভালো সম্পর্কের প্রতিকূলে থাকে। সুযোগ পেলেই তারা মাঠে নেমে পড়ে।বৃহৎ শক্তিশালী এ প্রতিবেশীর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। ঠিক তেমনি সাতটি পার্বত্য রাজ্যের মধ্যে ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশও ভারতের কাছে একইভাবে প্রাসঙ্গিক।১৯৭৪ সালের ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি কার্যকর করতে কিছু আইনি ব্যবস্থা ৪০ বছরেও নেওয়া হয়নি। ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানি সমতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে বণ্টনের কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। এর একটি তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিও চূড়ান্ত হয়ে তিন বছর ঝুলে আছে। সীমান্তে তুচ্ছ কারণে ভারতীয় রক্ষী বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা করছে। পৃথিবীর অনেক দেশের নাগরিক ভারতে পৌঁছে ভিসা নেওয়ার সুবিধা পান। কিন্তু যাঁরা সেটা পান না, তাঁদের মধ্যে আমরাও আছি। অতিসম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করেছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি এ বিষয়গুলো বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছেন নতুনভাবে। তাঁদের সরকার সবেমাত্র ক্ষমতায় এল। আমরা আশা করতে থাকব, তাঁরা সমস্যাগুলোর প্রতি দ্রুত মনোযোগ দেবেন। অবশ্য সাম্প্রতিককালে ভারত থেকে আমরা ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কিনতে পারছি। ত্রিপুরা থেকে আরও ১০০ মেগাওয়াট পাওয়ার আশ্বাস মিলেছে। কিন্তু মূল সমস্যাগুলো সমাধানে বারবার আশ্বাসের অতিরিক্ত আর কিছুই মিলছে না। তা সত্যেও আমরা চাই, দুটো দেশের মাঝে সম্পর্ক জোরদার হোক। কেটে যাক সব বিঘ্ন। এবারের সুষমা স্বরাজের সফরের পর উভয় পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে একটি চমৎকার সূচনা হয়েছে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের। সূচনা শুভ হোক, এ প্রত্যাশা রইল।
দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত সবচেয়ে বড় দেশ। সুতরাং প্রতিবেশীদের প্রতি তাদের দায়িত্ব বেশি। সহযোগিতার ডালি নিয়ে তাদেরই এগিয়ে আসার কথা। ভারতের একসময়কার প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত ইন্দর কুমার গুজরাল প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতি তাঁদের ভূমিকা সম্পর্কে পাঁচ দফার একটি ঘোষণা দিয়েছিলেন। এর নীতিগুলো সমন্বিতভাবে গুজরাল ডকট্রিন নামে পরিচিত। এর প্রথম দফাটাই হচ্ছে ভারত তার প্রতিবেশীকে যতটুকু পারে দিয়ে যাবে। এর জন্য পারস্পরিক লেনদেনের কোনো বিষয় থাকবে না। সজ্জন এ প্রয়াত নেতার বাস্তবধর্মী নীতি ভারতের সরকারগুলো খুব কম ক্ষেত্রেই অনুসরণ করে। বরং আমরা ছোট প্রতিবেশী হয়েও পারস্পরিক লেনদেনের ধার না ধেরেই যতটুকু পারি তা দিয়ে যাচ্ছি। গুজরাল ডকট্রিনের দ্বিতীয় তত্ত্বটি হচ্ছে, কোনো দক্ষিণ এশীয় দেশ তার ভূখণ্ডকে অন্য রাষ্ট্রগুলোর পক্ষে ক্ষতিকারক কোনো কাজে ব্যবহার করতে দেবে না। অতীতে যা-ই হোক, ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশ অবিচলভাবে এ নীতি অনুসরণ করছে।
বাংলাদেশ সরকারের ভারতনীতি বিশেষ করে ট্রানজিটের ব্যাপারে জনমনে তেমন নেতিবাচক কোনো মনোভাব নেই। কিন্তু সংশয় দেখা দেয় যখন এসব সিদ্ধান্ত হয় অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়। মালামাল পরিবহনের জন্য বারবার কোনো মাশুল না নেওয়ার নীতিও প্রশ্নবিদ্ধ। এ-বিষয়ক চুক্তি বা সম্মত যৌথ কার্যবিবরণী হওয়ার খবর সরকার আমাদের গণমাধ্যমকে সরাসরি দেয়নি। এটা বিস্ময়কর ঠেকে যখন এ খবর পেতে আমাদের বিবিসির ওপরই ভরসা করতে হয়।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
[email protected]