পাহাড়ি উচ্ছেদ করে দীঘিনালার নিরাপত্তা!

সম্প্রতি খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলায় বাবুছড়া নামক স্থানে বিজিবির ৫১ ব্যাটালিয়নের সদর দপ্তর স্থাপনের জন্য বিজিবি জমি দখলে নেওয়ার পর ওই এলাকার ২১টি পাহাড়ি পরিবার ভিটেছাড়া হয়েছে। এ ছাড়া আশপাশের এলাকার পাহাড়িরাও উচ্ছেদ-আতঙ্কে অনিশ্চিত প্রহর গুনছেন। গত ১৪ মে বিজিবির সদস্যরা গভীর রাতে বাবুছড়ায় অবস্থান নেন। এ আকস্মিক দখল-প্রক্রিয়া ভোরের আলো ফোটার পরে স্থানীয় পাহাড়িদের বিস্মিত করেছে।
কারণ, ২০০৫ সাল থেকে পাহাড়ি–অধ্যুষিত এ লোকালয়ে বিজিবির সদর দপ্তর স্থাপনের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। কিন্তু বিজিবির এ জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট (মামলা নং-৩৪৫৫-৩৪৬৪/২০০৫) করা হলে ওই বছরের ১৯ মে হাইকোর্ট এ জমি অধিগ্রহণের নোটিশ কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না মর্মে রুল জারি করেন এবং এ রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ভূমি অধিগ্রহণ নোটিশ স্থগিতের নির্দেশ দেন, যার এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। কিন্তু গত ১৫ মে আদালতের এ আদেশকে উপেক্ষা করে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিজিবিকে অধিগ্রহণকৃত জমিটি বুঝিয়ে দেওয়া হয়।
বিজিবির দখলকৃত জমির মধ্যে কেবল পাহাড়ি বসতভিটা ও জমি নয়, একটি সরকারি প্রাইমারি স্কুল, একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের জমিও রয়েছে। প্রাইমারি স্কুলটি বন্ধ করে দেওয়ার ফলে স্কুলের দুই শতাধিক শিক্ষার্থী শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিজিবির সদস্যরা সাধারণের জন্য চলাচলের রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে স্থানীয় পাহাড়িদের একপ্রকার অবরুদ্ধ করে দেন।
অন্যদিকে, বিজিবির বাধার কারণে প্রায় ২১টি পরিবার নিজের বাড়িঘর ছেড়ে স্থানীয় একটি উচ্চবিদ্যালয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলে এ স্কুলটির শিক্ষা কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে। এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে বিজিবির সদস্যদের বাগ্বিতণ্ডার ঘটনা ঘটে। গত ১০ জুন বাবুছড়ার স্থানীয় জনগণ বিজিবির সদর দপ্তর স্থাপনের প্রতিবাদে মানববন্ধন করতে গেলে বিজিবির সদস্যদের সঙ্গে সংঘর্ষে নারী-পুরুষসহ কমপক্ষে ১৮ জন পাহাড়ি আহত হন।
অন্যদিকে বিজিবির কয়েকজন সদস্যও আহত হয়েছেন বলে জানা যায়। এ ঘটনার পর চিকিৎসাধীন আহত চারজন নারীসহ ছয়জনকে হাসপাতাল থেকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং প্রায় আড়াই শতাধিক নারী-পুরুষকে আসামি করে বিজিবির পক্ষ থেকে মামলা করা হয়। আসামির তালিকায় ৩০ ও ৩২ নম্বর ব্যক্তিদ্বয় মৃত হলেও তাদের নামেও মামলা করা হয়েছে। এ ছাড়া একজন সরকারি কৌঁসুলির নামও এতে যুক্ত করা হয়েছে। তাই বিজিবির এ মামলা যে হয়রানিমূলক ও জনমনে ভীতি সঞ্চারের উদ্দেশ্যে করা হয়েছে, তা সহজে অনুমেয়।
সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাহাড়িদের বিরুদ্ধে গণহারে মামলা দেওয়ার প্রবণতা বেড়ে গেছে। বাবুছড়ার আগে বাঘাইছড়ির দ্বি-টিলা নামক স্থানে একটি ধর্মীয় উপাসনালয় (বৌদ্ধদের) স্থাপন করতে গেলে সেখানেও প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে। এ ছাড়া বন বিভাগকে দিয়ে চার শতাধিক লোকের বিরুদ্ধে বন আইনে মামলা [ধারা ১৯২৭ সালের বন আইন (সংশোধিত), ২০০০ সালের ২৬(১ক)] করা হয়েছে।

দুই
কিছুদিন আগে সরকার তিন পার্বত্য জেলায় সেনাবাহিনী, বিজিবি, আনসার, পুলিশ বাহিনীর পাশাপাশি ‘পাহাড়ি ব্যাটালিয়ন’ নামে র্যাবের একটি ‘বিশেষ’ ব্যাটালিয়ন গঠনের পরিকল্পনা নিয়েছে (সূত্র: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, দৈনিক যুগান্তর)। এ বিশেষ ব্যাটালিয়নটি চৌকস সদস্যদের দ্বারা পরিচালিত হবে এবং তাঁরা সার্বক্ষণিকভাবে একে-৪৭ রাইফেলসহ অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করবেন। এ ছাড়া পাহাড়ি এলাকায় যোগাযোগ সীমাবদ্ধতার কারণে এ বাহিনী হেলিকপ্টার ও স্পিডবোটে অভিযান চালাবে বলে খবরে প্রকাশ।
তাই এ বিশেষ ব্যাটালিয়ন গঠনের সংবাদে পাহাড়ের মানুষের মনে এ প্রশ্নই বারবার জাগছে—চারটি সশস্ত্র বাহিনীর সক্রিয় উপস্থিতির পাশাপাশি সন্ত্রাস দমনের নামে যদি আরও একটি বিশেষ ব্যাটালিয়ন যুক্ত করা হয়, তাহলে পাহাড়ে কেবল হেলিকপ্টারের গর্জন আর অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের ঝংকারের শব্দই শোনা যাবে। যে বাহিনীর (র্যাব) বিরুদ্ধে গঠনলগ্ন থেকে ক্রসফায়ার ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ বারবার উঠছে, আর তাদের ভাষ্যমতে, পাহাড়ি দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীদের (!) পাকড়াও করতে অত্যাধুনিক অস্ত্রের বিকল্প নেই!
তাই অদূর ভবিষ্যতে পাহাড়ে অস্ত্রের ঝংকার আর অহরহ ‘গুলিবিনিময়’ বা ক্রসফায়ারের

ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হবে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন।
২০১২ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের এক-তৃতীয়াংশ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য এখনো পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত রয়েছে (সূত্র: Militarization in the Chittagong Hill Tracts, Bangladesh: Published by IWGIA, Organising Committee CHT Campaign and Shimin Gaikou Centre, 2012)। পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী ছয়টি সেনানিবাস ছাড়া বাকি সব অস্থায়ী সেনাছাউনি পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সরিয়ে নেওয়ার কথা ছিল।
অথচ চুক্তির শর্তের তোয়াক্কা না করে একের পর এক চুক্তিভঙ্গের পদক্ষেপ যেমন, বিশেষ ব্যাটালিয়ন গঠনের সিদ্ধান্ত, যেখানে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার সদস্য থাকবেন, বান্দরবানের রুমায় সেনা গ্যারিসন, রোয়াংছড়ি উপজেলায় বিজিবির হেডকোয়ার্টার, দীঘিনালার বাবুছড়ায় বিজিবির হেডকোয়ার্টার স্থাপনের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে।
অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, নিরাপত্তার নামে সশস্ত্র বাহিনীর অধিক উপস্থিতি পাহাড়ের সবুজ স্নিগ্ধ পরিবেশ বারবার রঞ্জিত করেছে। তাই সেনাবাহিনী, বিজিবি, আনসার, পুলিশ বাহিনীর পাশাপাশি এ ‘বিশেষ ব্যাটালিয়ন’ গঠনের সিদ্ধান্ত যদি অচিরে বাস্তবায়িত হয়, তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য এটি নিঃসন্দেহে আরেকটি অশনিসংকেত হবে।
সম্প্রতি র্যাব পুনর্গঠন বা সংস্কারের কথা যেমন উঠে এসেছে, তেমনি অনেকে র্যাবের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাওয়ার কথাও বলেছেন। এমনতর পরিস্থিতিতে পাহাড়ে নতুন করে ‘বিশেষ ব্যাটালিয়ন’-এর নামে র্যাব মোতায়েনের খবরে পাহাড়ের মানুষ স্বাভাবিকভাবে উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েছেন। গত ১৬-১৭ বছরেও পার্বত্য চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়ায় পাহাড়ের মানুষের মনে যে অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতার বীজ জন্মেছে, সে আস্থাহীনতার মধ্যে ‘বিশেষ ব্যাটালিয়ন’ মোতায়েন করা হলে পাহাড়ের পরিবেশ বরং ক্রমে আরও অস্থিতিশীল ও অশান্ত হয়ে উঠবে।
তাই এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগে সরকারের বিষয়টি নিয়ে আরও ভালোভাবে চিন্তাভাবনা করা এবং স্থানীয় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ভালোমন্দ বিবেচনায় নেওয়া উচিত। একইভাবে দীঘিনালার বাবুছড়ায় পাহাড়ি–অধ্যুষিত লোকালয়ে বিজিবির সদর দপ্তর স্থাপনে বল প্রয়োগ না করে এমন একটি স্থানে এ সদর দপ্তর স্থাপন করা হোক, যেখান থেকে আন্তর্জাতিক সীমান্ত সুরক্ষা করা সহজতর হবে।
ইলিরা দেওয়ান: হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক।
[email protected]