জেগে উঠুন কালো আইনের বিরুদ্ধে

কার্টুন: তুলি
কার্টুন: তুলি

সাংবাদিক সমাজের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফলে ১৯৯১ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের আমলে ১৯৭৩ সালের প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনস আইনের পত্রিকা বন্ধসংক্রান্ত ধারাটি বাতিল করা হয়। বর্তমান সরকার সেই ধারাটি পুনর্বহালের চিন্তা–ভাবনা করছে বলে পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। এ নিয়ে সাংবাদিক ইউনিয়নের দুজন শীর্ষস্থানীয় নেতার অভিমত প্রকাশ করা হলো
তথ্যমন্ত্রী ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি হাসানুল হক ইনুর একসময়ের চিন্তাগুরু দুনিয়া কাঁপানো কার্ল মার্ক্সের কথা দিয়েই শুরু করি। জগদ্বিখ্যাত বহু লেখকের মতো তাঁর তারুণ্যও শুরু হয়েছিল নির্ভীক সাংবাদিকতা দিয়ে। প্রুশিয়ার রাজা আরোপিত সেন্সরশিপের কাটা-ছেঁড়া-লবণ-মাখা সমালোচনা করায় তাঁর Deuteche Jahrbucher পত্রিকাটি অক্কা পায়। অদম্য মার্ক্স এরপর কোলন থেকে বের করলেন Reinische Zeitung. ১৮৪২-এর মে মাসের কথা। রাজা, সংসদ সদস্যদের দুর্নীতি, অনিয়ম প্রকাশ করে চললেন। একদল এমপি বললেন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দরকার, কিন্তু এতটা না।
মার্ক্সের জবাব—এই আইন সভায় অংশগ্রহণকারী সংবাদপত্রের পক্ষে সমর্থনকারীরা কী রক্ষা করছেন সামগ্রিকভাবে এর সঙ্গে কোনো প্রকৃত সম্পর্ক নেই। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিষয়টি তাঁদের কাছে অতি আবশ্যক এমনটি কখনো দেখাতে আসেননি। এটি সম্পূর্ণ মস্তিষ্কের বিষয়, যেখানে হৃদয়ের কোনো ভূমিকা নেই। (মার্ক্স জার্নালিজম: দ্য গ্রাব স্ট্রিট ইয়ার্স, ক্রিস্টোফার হিচেনস, দ্য গার্ডিয়ান, জুন ২০০৭।)
রাশিয়ার জার নিকোলাস ওয়ান মার্ক্সের পত্রিকার ওপর বেজায় নাখোশ ছিলেন। তাঁর অনুরোধে প্রুশিয়ার রাজা শুধু পত্রিকাটিকে বন্ধ নয়, মার্ক্সকেও দেশছাড়া করলেন। মার্ক্স ছিলেন স্বাধীনচেতা। জোর গলায় বলতেন আমার পত্রিকাকে স্তব্ধ করার শক্তি কারও নেই।
এই উদাহরণ এ জন্য যে সভ্যতার উষালগ্নে ভিন্নমতের গণমাধ্যম হত্যার কাণ্ডকারখানা যেমন চলেছে, তেমনি তার বিরুদ্ধে সগর্জন প্রতিবাদও হয়েছে। ঔপনিবেশিক আইন সূত্র হিসেবে আমরা পেয়েছিলাম প্রিন্টিং প্রেসেস অ্যান্ড পাবলিকেশনস অ্যাক্ট। প্রকাশক-সম্পাদকের দায়িত্বশীলতা নির্ধারণের জন্য ১৮৬৭ সালে ব্রিটিশরা ‘প্রেস অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন অব বুকস অ্যাক্ট’ চালু করে। ১৯৩১ সালে হয় ‘প্রেস (ইমার্জেন্সি পাওয়ার্স) অ্যাক্ট’। ১৯৬০ সালে আইয়ুব শাহি দুটি আইনকে এক করে ‘প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনস অর্ডিন্যান্স’ (পিপিও) বানায়। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালে আলোচ্য আইন। পত্রিকার ডিক্লারেশন বা প্রকাশনার লাইসেন্স নিতে গেলে শর্ত সাপেক্ষে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা প্রশাসকের অনুমতি লাগবে। তিনি আবার চাইলে এর ডিক্লারেশনস বাতিল করে দিতে পারেন।
১৯৮২ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র পিপাসু মানুষের তীব্র আন্দোলন হয়েছিল। সাংবাদিক সমাজ তার অকুতোভয় শরিক ছিল এবং ’৯০-এর ২৭ নভেম্বর ডা. মিলন হত্যার পর জাতীয় প্রেসক্লাবে আমরা সিদ্ধান্ত নিই, যখনই ইমারজেন্সি জারি হবে, তখন থেকে সারা বাংলাদেশে পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ এবং এরশাদের পতন না হওয়া পর্যন্ত সাংবাদিকেরা কাজ করবেন না। সেদিন সন্ধ্যায় জরুরি অবস্থা চাপল, আমরাও ধর্মঘটে গেলাম। ভেঙে পড়ল স্বৈরাচার।
সাবেক প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের দায়িত্ব পাওয়ার পর সাংবাদিক সমাজের অনুরোধে সংবাদপত্রকে কালো আইন মুক্ত করার জন্য বিচারপতি মাহমুদুর রহমানের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেন। সিনিয়র সাংবাদিকেরা এর সদস্য ছিলেন। কমিটির সুপারিশে বিশেষ ক্ষমতা আইন এবং প্রিন্টিং প্রেসেস অ্যান্ড পাবলিকেশনস

অ্যাক্টে তখন কিছু সংশোধনী অধ্যাদেশের মাধ্যমে আনা হলো, যাতে সরকার নিজে কখনো পত্রিকা বন্ধ করতে পারবে না। একই সঙ্গে পত্রিকার ডিক্লারেশন পেতে ঝামেলা পোহাতে হবে না এবং জেলা প্রশাসক নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ডিক্লারেশন না দিলে প্রেস কাউন্সিল তা দিতে পারবে। কয়েক ক্ষেত্রে দিয়েছেও। যেমন, মরহুম সাংবাদিক এবিএম মূসা পেয়েছিলেন।
ঘটনার শেষ এখানেই নয়, খালেদা জিয়া নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর সাংবাদিকদের অনুরোধে সাড়া দিয়ে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের এতৎসংক্রান্ত অধ্যাদেশকে আইন হিসেবে সংসদে পাস করালেন। এরপর সংবাদপত্র প্রকাশনার জগতে বিপ্লব ঘটল এবং আকাশ সংস্কৃতির দরজাও তিনি খুলে দিলেন। খালেদা জিয়া করেছিলেন বলে এখন তা উল্টে দিতে হবে অথবা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ফসলকে নস্যাৎ করা হবে—এ ধরনের ভাবনা একান্তই অগ্রহণযোগ্য।
এখন ঘটনাবলি টপকে ২০১৪-তে চলে আসি। বর্তমান সরকারের আমলে আমার দেশ, দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টিভি, চ্যানেল ওয়ান বন্ধ। বৈদ্যুতিন বা ইলেকট্রনিক মিডিয়া বন্ধের জন্য বিটিআরসির নির্বাহী আদেশই যথেষ্ট। আমার দেশ ও ইনকিলাব-এর প্রেসে তালা ঝোলানো হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের অজুহাতে। এখন দারোগাই প্রেসে তালা দিতে পারেন এবং সাংবাদিকদের অজামিনযোগ্য ধারায় গ্রেপ্তার করতে পারেন।
তারপর পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী সংবিধানের সমালোচনা করা যাবে না, করলেই রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা। যে আইনের সম্ভাব্য সংশোধনী নিয়ে আমরা এখন উচ্চকণ্ঠ, ডিসিরা এখন পত্রিকা বন্ধ করতে না পারলেও গত কয়েক বছর নানা অজুহাতে যেমন অনিয়মিত প্রকাশনা, সরকারবিরোধী প্রচারণা, অশ্লীলতার দোহাইয়ে বহু পত্রিকার প্রকাশনা লাইসেন্স রদ করা হয়েছে। এসব নিয়ে মামলাও আছে জেলা আদালতগুলোতে।
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকতার দায়িত্বশীলতা নিয়ে সরকার ও সুশীল সমাজের মোড়লেরা যখন নানা নসিহতে মশগুল, সে মুহূর্তে প্রথম আলো খবর দিয়েছে যে সরকার ভাবছে পত্রিকা বন্ধের প্রত্যাহৃত ক্ষমতা আবার ফিরিয়ে আনার। সরকারের সবচেয়ে পেয়ারা আমলা হয়ে থাকেন ঢাকার জেলা প্রশাসক, ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার, পুলিশ কমিশনার, র্যাবের এডিজি প্রমুখ।
ঢাকার ডিসি স্বপ্নেপ্রাপ্ত আদেশেই হোক বা অন্য কোনো কারণে হোক, চিন্তা করেছেন ডিসিদের হাতে ওই ক্ষমতাটি আবার ফিরে আসুক। আবার বাকশালে প্রত্যাবর্তন! মন-মগজে প্রধানমন্ত্রী ও তথ্যমন্ত্রী কেন জানি আলোর বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন। আমরা এটা মানতে পারি না।
রবীন্দ্রনাথের মুক্তধারা নাটকে শিবতরাই এবং উত্তর কূটবাসীদের পরিচালকদের দ্বন্দ্ব সবারই উপভোগ্য। শিবতরাইয়ের মানুষদের চেনা যেত কান ঢাকা চুপি দেখে। তারা এমন টুপি পরত। কান ঢাকার অর্থ সাধারণ মানুষকে কোনো কিছু জানতে না দেওয়া বা ততটুকু জানতে দেওয়া, যতটুকু ক্ষমতাবান বা রাষ্ট্রপক্ষের জন্য স্বস্তিকর। কানে যেন সোজা কিছু ঢুকে না যায়।
নাটকে পাল্টা সংলাপও আছে—‘জগৎটা বাণীময় রে, তার যেদিকটাতে শোনা বন্ধ করবি সেদিক থেকে মৃত্যুবাণ আসবে’। এক পক্ষের কান ঢেকে নিয়ে অন্য পক্ষকে বুলি শিখিয়ে দিয়ে মুক্তধারা নাটকের সেই মৃত্যুবাণের আয়োজনই চলছিল চারদিক থেকে। সব দেশে সব সময়ই চলতে পারে সেই আয়োজন (শঙ্খ ঘোষ: কান ঢাকা টুপি)।
তাই, পত্রিকা বন্ধের কালো আইনের বিরুদ্ধে জেগে ওঠা ছাড়া কোনো পথ নেই।
শওকত মাহমুদ: সভাপতি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (একাংশ)।