ন্যাড়া, দিগম্বর ও এক আজব ফকির

দুটোই তিনি করে দেবেন: ন্যাড়া অথবা নাঙ্গা। পছন্দটা আপনার। এর জন্য কেবল কষ্ট করে তাঁর সমালোচনা করতে হবে। এমনভাবে নাম নিতে হবে, যাতে দেয়ালেরও কানে যায়। এলাকার মানুষও কম রসিক নন। সাংসদ মজিবুর রহমান ফকিরের সমালোচনা না শুনলে তাঁদের আনন্দ হয় না। আপনি গৌরীপুরে গিয়ে এহেন নেতার প্রশংসা শোনার শ্রোতা পাবেন না। কিন্তু নিন্দা সে তো জামাই-বউ চানাচুরের মতো কড়কড়ে, মচমচে, একেবারে তেলেভাজা।
পৃথিবীতে এ রকম মহান কজন, যিনি তোষামুদে নয়, সমালোচনায় সাড়া দেন! আর সেই সাড়া এমনই সাড়া যে আপনার বস্ত্র অথবা চুল কোনোটাই যথাস্থানে থাকতে পারবে না। সমালোচকের মাথা ন্যাড়া অথবা দেহকে দিগম্বর করার জন্য তিনি এক ‘সেবালয়’ খুলেছেন। সেই সেবালয়ে গত ২৩ জুন স্থানীয় একটি সরকারি কলেজের শিক্ষককে দিগম্বর করে মহাসড়কে প্রদর্শন করা হয়। গত ১ জুলাই সেবালয়ে ধরে এনে ন্যাড়া করে দেওয়া হয় এক ব্যক্তিকে। এর আগে আরেকজনকে ‘ন্যাড়া’ করতে গেলে তিনি অজ্ঞান হয়ে রক্ষা পান। মাথা ন্যাড়া করা তো চলতি ফ্যাশন। হলিউডের অনেক নায়কেরই মাথায় চুল নেই, তাতে কী? যাহোক, ফকিরি ‘সেবা’ গ্রহীতার সংখ্যা তার পরও কম নয়।
পৃথিবীতে এমনও শহর আছে, যেখানে পর্যটকেরা দিগম্বর হয়ে ঘুরে বেড়ান। অনেকে বলেন, এটাই নাকি সভ্যতা। পাশ্চাত্য সভ্যতার দিকে তাকিয়ে দেখুন, উন্নতি যত লম্বা পোশাক ততই খাটো। কিন্তু সামাজিক বিবর্তনের পথে পোশাকের বালাই কমানোর মতো ধৈর্য এই ফকিরের নেই। তিনি রাতারাতি আমাদের আদিম লাজলজ্জা দূর করায় উৎসাহী। অন্যান্য এলাকার সাংসদেরাও যদি তাঁর পথ ধরেন, তাহলে অর্ধসভ্য জাতি পুরোপুরি সভ্য হয়ে যাবে।
পৃথিবীর সেরা ভাস্কর্যগুলোর অধিকাংশই উলঙ্গ। গ্রিক দেবতাদের অধিকাংশের গায়েই পোশাক থাকতে দেখা যায় না। তাঁদের দিগম্বরী মূর্তি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাদুঘরগুলোতে শোভা পায়। সাংসদ ক্যাপ্টেন মজিবুর রহমান ফকির ভেবেছেন, দেব-দেবীরা যদি দিগম্বর থাকতে পারেন, পাশ্চাত্যে যদি দিগম্বর সভা চলতে পারে, তাহলে বাংলাদেশে দিগম্বর-সংস্কৃতি থাকতে পারবে না কেন? টাঙ্গাইলের আরেক সাংসদ ও মন্ত্রী যেমন বিদ্বান, সরকারি বনের জমিতে তিনি যেমন ব্যক্তিগত পাঠাগার স্থাপন করেন, সাংসদ ফকিরও তেমনি সংস্কৃতিমান; তিনি অভিনেতাও বটে। তাঁর অভিনীত ঈদের নাটক না দেখলে জানাই হতো না, এমন উত্তরাধুনিক সেবকের মধ্যে এক শিল্পী মন গুমরে মরছে।
আওয়ামী লীগের সাংসদ হলেও তিনি অন্যদের মতো নন। তাঁর দৃষ্টি নাপিতের মতো, মোটেই মুচির মতো নয়। সামনে দিয়ে কেউ গেলে মুচি তাকান তার পায়ের জুতার দিকে। আর নাপিতের চোখ যায় মাথার দিকে। কর্মীদের মধ্যেও তিনি এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠা করেছেন। জায়গায় জায়গায় ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মীরা এর পা ভেঙে দিচ্ছেন, ওর গোড়ালি কেটে নিচ্ছেন। তবে গৌরীপুরে তাঁরা পা না ধরে ক্ষুর চালাচ্ছেন মাথায়। সম্পূর্ণ বিনা পয়সায়! পুরাকালে লোকে চোর-ডাকাতদের ধরতে পারলে ন্যাড়া করে দিত, ন্যাংটা করে গাঁয়ের পথে পথে ঘোরাত। এটাই বাংলার প্রকৃত গ্রামীণ ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যও ফকির সাহেব ফিরিয়ে এনেছেন। তবে উল্টা করে। আগে গেরস্থ চোরের মাথা কামাত, এখন চোরেরা গেরস্থের মাথা কামায়।
তাঁর স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে বিপুল উন্নতি সাধিত হয়। কোটি কোটি টাকার অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি কেনা হয়। যত বড় সেবা, তত বড় ব্যবসা। সময়ের চেয়ে তিনি অনেক এগিয়ে। তিনি বিশ্বের সেরা চিকিৎসা-প্রযুক্তি আনতে পেরেছিলেন, কিন্তু সেগুলো চালানোর মতো টেকনিশিয়ান বঙ্গমুল্লুকে আর পাওয়া গেল না। তাতে প্রাইভেট ক্লিনিকগুলো তাঁর ওপর দারুণ খুশি। তিনি হাসপাতালকে দিয়েছেন যন্ত্রপাতি আর ক্লিনিকগুলোকে দিয়েছেন রোগীর প্রাচুর্য। বেসরকারি মেডিকেল কলেজ অনুমোদন, জেলায় জেলায় স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের পদোন্নতি, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যদের জমিদারির সুরক্ষা দেওয়ায় তাঁর অবদান রয়েছে। তাঁর সময়ের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে ৪৩৬ জনের চাকরির তদবির করে দেওয়া

চিঠি থেকে প্রমাণিত হয় তিনি কত জনদরদি। সেই চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমার শুভেচ্ছা নিবেন। আশা করি ভালো আছেন। আপনার নিয়ন্ত্রণাধীন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতায় (বিভিন্ন জেলার নাম) সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের বিভিন্ন পদে লোক নিয়োগ করা হবে। নিম্নবর্ণিত প্রার্থীদের নিয়োগের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশসহ প্রেরণ করা হলো।’
গৌরীপুরকে তিনি আবার স্বাধীন করেছেন। স্বাধীনতার মূল্য হিসেবে দয়া করে কিছু টাকা তিনি নিচ্ছেন, সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হলো, বাংলার হারিয়ে যাওয়া জুয়া-হাউজিকে ফিরিয়ে এনেছেন। বিনিময়ে প্রতিদিন দিতে হয় ৫০ হাজার টাকা। তিন বছর ধরে চলছে এই অবস্থা। জুয়া-হাউজি ছড়িয়ে পড়েছে মেলা থেকে বাড়িতে। টাকা নেওয়া হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, সাংসদের বিশেষ বরাদ্দের উন্নয়ন প্রকল্প থেকেও। রাজা হলে তো খাজনা নেবেনই। আগেকার যুগের রাজা-বাদশাহরা শত্রু রাজ্য জয় করে রাজকন্যাকে বিয়ে করে নিতেন, কিংবা রাজকন্যার বিনিময়ে রাজ্যটিকে ছাড় দিতেন। গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী নারী প্রার্থীকে তিনি প্রকাশ্য জনসভায় বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। ফকির সাহেব সেই ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করছেন, এটা তো সুখবর। কী রকম দিলদরিয়া মানুষ, যখন যা ইচ্ছা হয় করেন।
কিন্তু এলাকার মানুষ তাঁকে চিনল না। গৌরীপুর উপজেলা আওয়ামী লীগ থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এলাকাবাসী ও কলেজ শিক্ষার্থীরা মিছিল করে তাঁকে কলিকালের ন্যাংটা বাবা হিসেবে দেখার আগ্রহ পোষণ করেছেন। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিজের হাতে খাল কেটেছেন, রাষ্ট্রপতি এরশাদ নিজে কবিতা লিখে কবিদের দুঃখ-কষ্টের স্বাদ নিয়েছেন, মজিবুর রহমান ফকির নিজে দিগম্বর হয়ে তাঁর সেবালয়ের সুনাম অক্ষুণ্ন রাখবেন, এ আশায় তাই দোষ নেই।
ইতিমধ্যে সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। বিভিন্ন জেলায় জনপ্রতিনিধিদের রাজনৈতিক পোশাক খুলে পড়ছে। বেরিয়ে পড়ছে জনপ্রতিনিধি সেজে বসে থাকা সাংসদদের অনেকের মাফিয়া-গডফাদার-খুনি-দস্যু চেহারা। গণতন্ত্র হলো রাষ্ট্রের পোশাক, ক্ষমতার আভরণ। গত ৫ জানুয়ারির ভোটারহীন নির্বাচনের পর তাঁর মতো রাজনীতিক ও সাংসদেরা যেভাবে গণতন্ত্রকে দিগম্বর করা শুরু করেছেন, তাতে একদিন তাঁদের নিজ নিজ লজ্জাস্থানও উন্মুক্ত হয়ে যাবে। বিএনপির দৌড় সালাহ উদ্দিন হবেন তাঁদের আদর্শ। সে রকম কোনো এক শুভ দিনে হয়তো কোনো দুষ্টু বালক আঙুল তুলে বলে বসবে, ‘রাজা, পালাচ্ছ পালাও। কিন্তু তোমার কাপড় কোথায়?’
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
[email protected]