রাজনীতিকদের নিষিদ্ধ করার 'বোর্ড' কই?

ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান ‘দোষ’ করেছেন, এটা মেনে নিয়েই দেশ আজ দুই ভাগে বিভক্ত। সাকিবের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি), অনেকেই এর বিরোধিতায় নেমেছেন, আবার পক্ষেও যুক্তির অভাব নেই। প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে পাঠকদের মতামতে দুই পক্ষেরই অবস্থান প্রায় সমানে সমানে। ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক-বিতর্কের শেষ নেই। এসব বিতর্ক চলুক, বিতর্ক হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ, সাকিব বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল ক্রিকেটার, দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলোয়াড় ও আন্তর্জাতিকভাবে নাম্বার ওয়ান ক্রিকেটারের স্বীকৃতি পাওয়া একজন, এমন এক খেলোয়াড়ের বিরুদ্ধে ছয় মাসের নিষেধাজ্ঞাসহ দেড় বছরের জন্য বিদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের খেলা বন্ধের শাস্তিটি যে যথেষ্ট কঠোর!
এত কঠোর শাস্তি পাওয়ার কারণগুলো আমরা জেনেছি। বিসিবির মতে, সাকিবের ‘বিরাট আচরণগত সমস্যা’ রয়েছে এবং তাঁর এই সমস্যা ‘দলের অন্যদের মধ্যেও সঞ্চারিত হচ্ছিল’। ফলে ‘দৃষ্টান্তমূলক’ শাস্তির প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। নিজের ভুলের জন্য বিসিবির সভাপতির কাছে দুঃখ প্রকাশ করেও পার পাননি সাকিব। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের শৃঙ্খলার প্রশ্নে বিসিবি তো আর আপস করতে পারে না! দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে গেছে বা যাচ্ছে বলে যাঁরা আক্ষেপ করেন, তাঁদের উদ্দেশে বলি, দেখুন, বিসিবির মতো প্রতিষ্ঠান এখনো দেশে রয়েছে, কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতা যাদের রয়েছে! বর্তমান শাস্তির পাশাপাশি ভবিষ্যতে এ ধরনের কিছু করলে সাকিবকে যে আজীবন বহিষ্কার করা হতে পারে, সেই হুঁশিয়ারিও দিয়ে রেখেছেন।
ক্রিকেটের চেয়ে নিশ্চয়ই দেশ বড়। বিসিবির মতো প্রতিষ্ঠান আছে বলে হয়তো সাকিবের মতো খেলোয়াড়ের আচরণের ‘সমস্যা’ দূর করার চেষ্টা হবে, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে অন্যদের সতর্ক করা হবে। এর মধ্য দিয়ে হয়তো দেশের ক্রিকেট ‘বাঁচাবে’, কিন্তু দেশ বাঁচাবে কে? যাঁরা দেশ চালান বা যাঁরা ভবিষ্যতে দেশ চালাতে চান, তাঁদের আচরণের সমস্যা দূর করবে কে? তাঁরা ভুল করলে ‘দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির’ ব্যবস্থা করবে কে? রাজনীতি থেকে নানা মেয়াদে ও প্রয়োজনে আজীবন তাঁদের নিষিদ্ধ করবে কে? ‘বিরাট আচরণগত সমস্যা’ থাকার পরও তো অনেক রাজনীতিবিদ দিব্যি রাজনীতি করে যাচ্ছেন। তাঁদের এই আচরণ কি দলের অন্যদের মধ্যে ‘সঞ্চারিত’ হচ্ছে না? এর পরও তো তাঁরা দল থেকে বরং বাহবাই পেয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের পাশে থাকার আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের পক্ষ থেকে। শৃঙ্খলার দরকার কি শুধুই বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের, দেশ চালান যাঁরা বা যে রাজনৈতিক দল, তাদের দরকার নেই!
সাকিবভক্তরা হয়তো কষ্ট পাবেন, এর পরও বলি, আসুন, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে আমরা আদর্শ মানি। এর আদলে ‘বাংলাদেশ রাজনীতি বোর্ড’ ধরনের কিছু একটা গড়ে তোলার আওয়াজ তুলি। তবে এই বোর্ডের সভাপতিকে অবশ্য বিসিবির সভাপতির চেয়েও কঠোর হতে হবে। কারণ, আচরণে ‘বিরাট সমস্যা’ থাকার পরও সাকিব বিসিবির নির্দেশে দেশে ফিরে এসেছেন। বোর্ডে এসে আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করেছেন, ভুল স্বীকার করে দুঃখও প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের কোনো রাজনীতিবিদ কবে কখন তাঁদের ভুল স্বীকার করেছেন বা এর জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন? দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে বিদেশে দিন কাটানো রাজনীতিবিদদের তো আদালতের নির্দেশও দেশে ফিরিয়ে আনতে পারছে না। আরও শক্তিশালী বোর্ড ও আরও কঠোর চেয়ারম্যান ছাড়া রাজনীতিবিদদের সামলানো যাবে বলে মনে হয় না।
রাজনীতিবিদেরা নিশ্চয়ই বলবেন, তাঁদের জন্য ‘বাংলাদেশ রাজনৈতিক বোর্ড’ ধরনের কিছুর দরকার নেই। কারণ, তাঁরা জনগণের জন্য রাজনীতি করেন, জনগণই হচ্ছে তাঁদের সেই বোর্ড। জনগণই বিচার করবেন কারা রাজনীতিতে থাকবেন বা থাকবেন না, রাজনীতিবিদদের শাস্তি বা নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা জনগণের হাতেই রয়েছে। গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর কি আর তা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে? নয় কোটি ২০ লাখ ভোটারের মধ্যে প্রায় সাড়ে সাত কোটি ভোটার তাঁদের ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। ‘জনগণের বোর্ড’ তো আর কাজ করছে না!
অন্যায় করলে দণ্ড নিশ্চিত এবং প্রয়োজনে তা ‘দৃষ্টান্তমূলক’ এবং গুরু দণ্ড—বাংলাদেশে এমন বিধান সম্ভবত দেশটির ক্রিকেট দলের জন্যই আপাতত প্রযোজ্য থাকছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল খেলোয়াড়টিই এর বলি হোক! আমরা তো আর ক্রিকেট খেলি না, কেউ রাজনীতি করি, কেউ সাংবাদিকতা, আমাদের ভয় কী! আমাদের তো আর বোর্ড নেই!
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
[email protected]