সেনাবাহিনীই যেখানে সর্বময় শাসক

৩ জুলাইয়ের যে অভ্যুত্থানে মিসরে জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে উৎখাত করা হয়েছে, তা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটতে পারে যেকোনো দেশেই।
মিসর ও পাকিস্তানের মধ্যে রাজনৈতিক সাদৃশ্য আছে। উভয় দেশেরই সেনাবাহিনী ক্ষমতাধর ও লুণ্ঠনপ্রবণ; ব্যাপক সামরিকায়ন ঘটেছে উভয় দেশেই। উভয়েরই সিভিল সোসাইটি দুর্বল, তারা বোঝে না যে নির্বাচনী প্রতিযোগিতা, স্বাধীন তত্ত্বাবধান, বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা ইত্যাদি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শক্তিশালী না হওয়া পর্যন্ত রাজনীতিতে উদার গণতান্ত্রিক মানসিকতা কখনোই আসবে না। মিসর ও পাকিস্তান উভয় দেশেই সামরিক বাহিনী ও তাদের গোয়েন্দাবৃত্তি রাজনৈতিক দলগুলোসহ সমাজের অধিকাংশ প্রধান প্রতিষ্ঠানের পরতে পরতে ঢুকে পড়েছে।
মিসরের অর্থনীতির প্রায় ৪০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে সামরিক বাহিনী। সামরিক বাহিনীর ক্রমবর্ধমান ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের মধ্যে রয়েছে পর্যটনশিল্প, রিয়েল এস্টেট, নির্মাণশিল্প, ভোগ্যপণ্যসহ অনেক কিছু। পাকিস্তান ও তুরস্কেও অনেক ব্যবসা-বাণিজ্যের মালিকানা রয়েছে সেনাবাহিনীর হাতে। পাকিস্তানের রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় সামরিক বাহিনী অন্যতম প্রধান ক্রীড়নক। জ্যেষ্ঠ জেনারেলরা ও তাঁদের পরিবারগুলোর সদস্যরা জমিজমাসংক্রান্ত বড় বড় কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত—এমন খবর পাওয়া গেছে, কিন্তু সেগুলো আবার অচিরেই আড়াল করা হয়েছে। যেমন, রেল বিভাগের এবং একটি সামরিক লজিস্টিকস ও সরবরাহ কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করা থেকে বিরত করা হয়েছে পাকিস্তানের দুর্নীতিবিরোধী প্রধান সংস্থা ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টেবিলিটি ব্যুরোকে। জানা যায়, জ্যেষ্ঠ কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তার হস্তক্ষেপের কারণে তদন্ত থেমে গেছে। বিশ্ব পুঁজিবাদী অর্থনীতির সঙ্গে সামরিক বাহিনীর বিচ্ছিন্নতা এত বেশি যে সামরিক কমান্ডাররা প্রায়ই বুঝতে পারেন না, তাঁদের কর্মকাণ্ডের ফলে প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়।
পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করার চেষ্টা হয়েছে চারবার। প্রথম চ্যালেঞ্জটি আসে ১৯৭১ সালে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চরম পরাজয়ের পর, যে যুদ্ধের পরিণতিতে বাংলাদেশ (সাবেক পূর্ব পাকিস্তান) সৃষ্টি হয়। জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রথম প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো সামরিক বাহিনীর ক্ষমতার রাশ টানার যে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তা ব্যর্থ হয় প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠানকে তিনি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন বলে।
সামরিক বাহিনীর ক্ষমতার প্রতি দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ ছোড়ার চেষ্টা করেন জুলফিকার আলী ভুট্টোর মেয়ে বেনজির ভুট্টো, যিনি দুবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। প্রথমবার ১৯৮৮ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত, দ্বিতীয়বার ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত। প্রতিবারই নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাঁর ঐকমত্যে পৌঁছা ও সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করার উদ্যোগ ব্যর্থ হয় এবং দুর্নীতির অভিযোগে তিনি অপসারিত হন। (ক্ষমার প্রতিশ্রুতি পেয়ে ২০০৭ সালে দেশে ফেরার অল্প দিন পরই তিনি হত্যার শিকার হন।)
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ এ দায়িত্ব পালন করছেন তৃতীয়বারের মতো। বেনজির ভুট্টোর দুই মেয়াদের মাঝখানে প্রথমবার এবং ১৯৯৭ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয়বার তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। প্রতিবারই তিনি সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষমতা দুর্বল করার চেষ্টা করেন সামনের সারির কিছু সামরিক কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। কিন্তু বেশ কয়েকজন সেনাপ্রধানকে অপসারণ করার পর ১৯৯৯ সালে জেনারেল পারভেজ মোশাররফের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থানে তাঁর সরকারকে অপসারণ করা হয়। গত মে মাসে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে নওয়াজ শরিফ আবার ক্ষমতায় এসেছেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর গত ৬৬ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম একটি নির্বাচিত সরকার আরেকটি নির্বাচিত সরকারের কাছে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করল। তবে নওয়াজ শরিফ এবার সামরিক বাহিনীর ব্যাপারে কী অবস্থান নেন, তা দেখার বিষয়।
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর রাশ টেনে ধরার একটা শেষ চেষ্টা করেছিলেন প্রয়াত বেনজির ভুট্টোর স্বামী আসিফ আলী জারদারি, যিনি ২০০৮ সাল থেকে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন। একসময় তাঁর পদটির ক্ষমতা ছিল বটে, কিন্তু এখন প্রেসিডেন্টের পদ মূলত আলংকারিক। আর তাঁর দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি গত নির্বাচনে নওয়াজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লিগের কাছে পরাজিত হয়েছে। তিনি যে প্রেসিডেন্ট হিসেবে পাঁচ বছরের মেয়াদ অক্ষুণ্ন রেখে এখনো দায়িত্ব পালন করে যেতে পারছেন, সেটা সম্ভব হয়েছে কেবল সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা প্রভাব-প্রতিপত্তি মেনে নেওয়ার মাধ্যমেই। পাকিস্তানের অনেক বিভ্রান্ত মানুষ এটাকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সাফল্য বলে তালি বাজাচ্ছেন। কিন্তু জারদারি টিকে আছেন শুধু এ কারণে যে তিনি তাঁর নিহত স্ত্রী ও নিহত শ্বশুরের পথ অনুসরণ করতে নারাজ। জারদারির এ কৌশলের সমস্যা হলো, এর মাধ্যমে সরকারের আয়ু বাড়ানো সম্ভব হতে পারে, কিন্তু প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাকে এটা চ্যালেঞ্জ করে না। আবার, জারদারির এ কৌশল খুব একটা কাজেও আসেনি। তিনি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকাচ্ছিলেন এ রকম অভিযোগ করা থেকে জেনারেলরা বিরত হননি। ২০১১-১২ সালে অভিযোগ ওঠে, যুক্তরাষ্ট্রে জারদারি সরকারের রাষ্ট্রদূত হুসেইন হাক্কানি পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে দুর্বল করতে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন। (হাক্কানি কূটনৈতিক পদ থেকে অপসারিত হয়ে এখন বোস্টন ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করছেন।)
পাকিস্তানের ইতিহাস বিবেচনায় রাখলে মনে হয়, মিসরের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট মুরসির উচিত ছিল গত বছর প্রতিরক্ষামন্ত্রী, সেনাপ্রধান ও সামরিক বাহিনীর অন্যান্য জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করার আগে সুশাসন ও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটিয়ে বেসামরিক শাসনের পক্ষে ব্যাপকভিত্তিক সমর্থন সৃষ্টি করা। এটা একটা পরিহাসের বিষয় যে, আগের প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে সরিয়ে তিনি যে জেনারেলকে ওই পদে নিয়োগ করেছেন, সেই জেনারেল আবদুল ফাত্তাহ এল-সিসিই শেষ পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে ৩ জুলাইয়ের অভ্যুত্থানে মদদ দিয়েছেন।
ভায়োলেন্স অ্যান্ড সোশ্যাল অর্ডারস শীর্ষক গ্রন্থের লেখক তিন লেখক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডগলাস সি নর্থ, জন জোসেফ ওয়ালিস ও ব্যারি আর অয়েনগ্যাস্ট চাইবেন মিসরকে একটি ‘ফ্র্যাজাইল ন্যাচারাল স্টেট’ হিসেবে চিহ্নিত করতে, যেখানে অভিজাত গোষ্ঠীগুলো কেবল নিজেদের স্বার্থ হাসিলে তৎপর থাকে, কোনো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারে না। ফলে সহিংসতা ও নৈরাজ্য দেখা দেয়। কারণ, অভিজাত গোষ্ঠীগুলোর প্রত্যেকে চেষ্টা করে নিজের আধিপত্য ও লাভ সর্বোচ্চ মাত্রায় বাড়াতে, সবার স্বার্থের কথা ভেবে আপস-সমঝোতায় যায় না।
পাকিস্তান ও মিসরের মতো সমাজে ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের প্রাথমিক হাতিয়ার হচ্ছে সামরিক বাহিনী। তাই ক্ষমতার সুফলগুলো বের করে নিতে অভিজাত গোষ্ঠীগুলোকে অবশ্যই সামরিক বাহিনীর সঙ্গে মিলেমিশে চলতে হয়, অথবা তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। এর মধ্য দিয়ে সামরিক বাহিনী সুযোগ পায় সম্ভাব্য সংস্কারকদের ব্যর্থ করে দিতে ভাগ করো ও জয় করো নীতি ব্যবহার করার। ২০১১ সালে প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে যে সেক্যুলার, উদারপন্থীরা মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন এবং সেনাবাহিনী তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়েছে, আজ সেই তারাই আবার সামরিক বাহিনীর শরণাপন্ন হয়েছেন। কিন্তু এবার মুসলিম ব্রাদারহুডকে হটানোর জন্য।
সামরিক প্রাধান্য বিশেষভাবে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে যখন তা সমাজের অভ্যন্তরে ঢুকে যায়: বিচার বিভাগ, রাজনৈতিক দল, বিশ্ববিদ্যালয়, গণমাধ্যম, নাগরিক সংগঠন—সবর্ত্র তাদের প্রভাব বিস্তৃত হয়। পাকিস্তানে এ রকমটাই ঘটেছে; এখানে সেনাবাহিনী নিষ্ঠুর বলপ্রয়োগের নীতি থেকে সরে এসে নানা রকম সুযোগ-সুবিধা ও মৃদু চাপ দিয়ে সমাজের বিভিন্ন অংশকে বশ মানানোর কৌশল অবলম্বন করেছে। মিসরে ধর্মনিরপেক্ষ, উদারপন্থী নাগরিকেরা ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর মানুষেরা একটা সময় সেনাবাহিনীকে ধিক্কার দিয়েছেন, আজকে তাঁদের অনেকেই সেনাবাহিনীকে এক নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে গ্রহণ করেছেন। মুসলিম ব্রাদারহুডের ব্যাপারে তাঁদের ভীতি থেকেই এ ধরনের অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এ রকম পরিবেশে প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অভ্যুদয়ের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তার পরিবর্তে সামনের দিনগুলোতে মিসরকে সম্ভবত কোনো না কোনো ধরনের ‘সামরিক-নির্দেশিত গণতান্ত্রিক’ শাসনব্যবস্থার মুখোমুখি হতে হবে, যেমনটি ঘটেছে ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান ও ক্ষমতাধর জেনারেলরা আছেন এমন কিছু দেশে।
এই প্রক্রিয়ার দুঃখজনক দিকটা বেশ পরিষ্কার: এতে সামরিক বাহিনী গণতন্ত্রকে পোষ মানানোর সুযোগ পায়, কিন্তু সে জন্য তাদেরকে ভোটারদের কাছে জবাবদিহি করতে হয় না, শাসন-প্রক্রিয়া উন্নত করার দায়দায়িত্বও নিতে হয় না।

নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সামান্য সংক্ষেপিত অনুবাদ।
আয়েশা সিদ্দিকা: পাকিস্তানের গবেষক ও সামরিক-রাজনৈতিক বিশ্লেষক। মিলিটারি ইনক: ইনসাইড পাকিস্তানস মিলিটারি ইকোনমি গ্রন্থের লেখক।