ক্ষমতা

বিসিএস কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা
বিসিএস কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি তাদের ৪৫তম বার্ষিকী উপলক্ষে তিন দিনব্যাপী উৎসব ও পুনর্মিলনীর আয়োজন করে ৪, ৫ ও ৬ জুলাই। স্লোগান ছিল ‘সাংবাদিকতায় সততা ও শুদ্ধাচার: গণতন্ত্র, সুশাসন, জবাবদিহির অঙ্গীকার’। উৎসব উপলক্ষে ঢাকা থেকে আমরা কয়েকজন সাংবাদিক রাজশাহীতে গিয়েছিলাম। গিয়েছিলেন বর্তমানে বিভিন্ন পেশায় আছেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সাবেক সদস্যরাও। সব মিলিয়ে নবীন ও প্রবীণদের এক আনন্দঘন সম্মিলনী। সেমিনারে মুখস্থ কথাবার্তার বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা হয়। তাঁরা সবাই স্বীকার করেন যেখানে সাংবাদিকতা, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও প্রশাসনযন্ত্রের সর্বত্র সততার দুর্ভিক্ষ চলছে, সেখানে এ ধরনের সেমিনার-আলোচনা খুবই জরুরি। সর্বগ্রাসী সংকট থেকে যাঁরা মুক্তির পথ দেখাবেন, সেই রাজনীতিকেরাই পথহারা। তাঁরা একে অপরের ওপর দোষ চাপিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছেন।
দেশটা যে ভালো চলছে না, সেই সহজ সত্য কথাটি রাজনীতিকেরা স্বীকারই করতে চাইছেন না। তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা বহাল হবে কি হবে না, সে বিতর্কে না গিয়েও যে কথাটি বলতে চাই, এই সংকটের পুরো দায় রাজনীতিকদেরই। একটি দেশে সরকার ও বিরোধী দল ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করলে নির্বাচন নিয়ে পাঁচ বছর পর পর এ ধরনের সংকট ও অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ার কথা নয়। এর জন্য বাংলাদেশের ১৫ কোটি মানুষ দায়ী নয়, দায়ী হলেন যাঁরা এখন রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন, অতীতে করেছেন এবং ভবিষ্যতে করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
রাজশাহীতে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে আলোচনায় দুটি বিষয় অগ্রাধিকার পায়—রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও সিটি করপোরেশন নির্বাচন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরোধীপক্ষ এককাট্টা হলেও সরকার-সমর্থকেরা দুই ভাগে বিভক্ত। সাবেক উপাচার্য আবদুস সোবহান ও বর্তমান উপাচার্য মিজান উদ্দিন আহমদের সমর্থকেরা একে অপরের মুখ দেখেন না। তাঁদের এই বিরোধের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের গত নির্বাচনে প্রায় সব কটি পদে সরকার-সমর্থকদের ভরাডুবি ঘটেছে। আগের উপাচার্যের আমলে যাঁরা ক্ষমতাবান ছিলেন এখন তাঁরা বঞ্চিত, আবার সেই সময়ে যাঁরা বঞ্চিত ছিলেন এখন তাঁরা দারুণ ক্ষমতাবান। ক্ষমতা কেবল ভোটে বদলায় না, ব্যক্তির আসা-যাওয়ায়ও বদলে যায়।
আমরা যখন রাজশাহীতে যাই, সিটি করপোরেশনের নবনির্বাচিত মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন ও সাবেক মেয়র খায়রুজ্জামান—কেউই সেখানে ছিলেন না। খায়রুজ্জামান ঢাকায় গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে। তাঁর সঙ্গে টেলিফোনে কথা হলো। আগের ভুল-ত্রুটি শুধরে জাতীয় নির্বাচনে জয়ের জন্য সবাইকে নিয়ে কাজ করার কথা জানালেন তিনি। আর মোসাদ্দেক হোসেন এসেছিলেন গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিরোধী দলের সমর্থক প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালাতে। কিন্তু একজন শুভানুধ্যায়ী যখন তাঁকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন, প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা নিয়ে তাঁর নির্বাচনী এলাকায় ঢোকা ঠিক হবে না, তখন আর তিনি গাজীপুরে গেলেন না। উত্তরার একটি বাড়িতে বসে প্রচারাভিযান চালিয়েছেন। কেবল তিনি নন, সরকারি ও বিরোধী দলের এ রকম অনেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদার ব্যক্তি উত্তরায় বসে নির্বাচনী প্রচার চালিয়েছেন। পৃথিবীর আর কোনো গণতান্ত্রিক দেশে এটি হয় না। কিন্তু সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশে হয়।
রাজশাহীতে দলমত-নির্বিশেষে যাঁদের সঙ্গেই আলাপ হয়েছে সবাই স্বীকার করলেন, সাবেক মেয়র খায়রুজ্জামান শহরের উন্নয়নে প্রচুর কাজ করেছেন। তিনটি বিশাল মার্কেট করেছেন। পদ্মার তীরে দুই কিলোমিটার দীর্ঘ বিনোদন কেন্দ্র হয়েছে। সড়কগুলো প্রশস্ত করা হয়েছে। শেষ মুহূর্তে গ্যাস-সংযোগ দেওয়ার ব্যবস্থাও তিনি করেছেন।
এত কিছু করার পরও খায়রুজ্জামান হারলেন কেন?
অন্ধ দলীয় সমর্থক ছাড়া সবাই বললেন, ক্ষমতা। ক্ষমতাসীনদের মানুষ বরাবরই সন্দেহের চোখে দেখে। তারা ক্ষমতার দাপট পছন্দ করে না। এখানে ব্যক্তি খায়রুজ্জামানের সাফল্য ম্লান হয়ে গেছে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মী-সমর্থকদের দাপটে। তাঁরা বললেন, মেয়র ভালো মানুষ, কিন্তু তাঁকে ঘিরে একটি চক্র গড়ে উঠেছিল, যারা সিটি করপোরেশনের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করত। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ওয়ার্ড—সর্বত্র নিয়ন্ত্রণের রাজত্ব।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক জানালেন, বিএনপির আমলে যেমন ছাত্রলীগের অনেক ছেলে ক্যাম্পাসে আসতে পারেনি, তেমনি আওয়ামী লীগের আমলেও বিরোধী পক্ষের অনেক ছেলে ক্যাম্পাসে আসতে পারছে না। ক্যাম্পাস থেকে শিবির বহিষ্কৃত হওয়ায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু ছাত্রলীগের অব্যাহত মাস্তানি তাঁরা মেনে নিতে পারছেন না। শ্রেণীকক্ষে ও পরীক্ষার হলে ঢুকে ছাত্রলীগের নেতারা প্রতিপক্ষ ছাত্রসংগঠনের কর্মীদের জোর করে নিয়ে গেছেন। তাঁদের ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ রাখতে হয়েছে। অনেকে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। একজন শিক্ষক ছাত্রলীগের জবরদস্তিতে বাধা দিলে এক ছাত্রনেতা তাঁকে এই বলে শাসিয়েছেন, ‘আপনি জানেন, কার সঙ্গে কথা বলছেন?’
এটা হলো ক্ষমতার দাপট।
খায়রুজ্জামান নিজে হয়তো ক্ষমতার দাপট দেখাননি। কিন্তু যাঁরা কাছাকাছি ছিলেন, তাঁরাই সিটি করপোরেশনের সব কাজ করতেন। আর দলে যে অংশটি সেসব কাজ পেত না, স্বভাবতই তারা নিষ্ক্রিয় ছিল। ২০০৮ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নাগরিক কমিটিকে যেভাবে কাজে লাগানো হয়েছিল, তাতে মনে হতো খায়রুজ্জামান দলমত-নির্বিশেষে সবার প্রার্থী। এবারে আওয়ামী লীগ একাই কৃতিত্ব নিতে চেয়েছে। জাতীয় পার্টি তো বটেই, ১৪ দলের নেতা-কর্মীদেরও দূরে রাখা হয়েছে।
এ ব্যাপারে আলাপ হয় নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব সৈয়দ সাফিকুল আলমের সঙ্গে। পেশায় চিকিৎসক। কিন্তু সমাজসেবাই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। মুক্তিযুদ্ধ পাঠাগারও গড়েছেন। বললেন, স্থানীয় রাজনীতির চেয়ে জাতীয় রাজনীতিই সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছে। তবে জাতীয় নির্বাচনে ফল ঘুরে যেতে পারে বলে তিনি আশাবাদী। কথা হয় বিজয়ী প্রার্থীর প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট ও বিএনপির রাজশাহীর সহসভাপতি তোফাজ্জেল হোসেনের সঙ্গেও। তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, জামায়াতের সমর্থন ও হেফাজতের প্রচারণার কারণেই কি আপনারা জিতেছেন? তিনি বললেন, না, এখানে হেফাজতের তেমন তৎপরতা নেই। আর সিটি করপোরেশন এলাকায় জামায়াতের ভোট ১৫ হাজারের বেশি হবে না। কিন্তু তাঁদের প্রার্থী জিতেছেন অনেক বেশি ভোটে।
অনেকেই মনে করেন, চার সিটি করপোরেশন নির্বাচন যদি আওয়ামী লীগের জন্য টর্নেডো হয়, গাজীপুরে হয়েছে সুনামি। আর এই সুনামির জন্য স্থানীয় নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে দলের শীর্ষ নেতৃত্বও কম ভূমিকা রাখেননি। জাহাঙ্গীর নাটক এবং এরশাদের দোয়া-রহস্যের পর আওয়ামী লীগের শিবিরে হতাশা দেখা দেয়। গাজীপুরেও প্রার্থীর যোগ্যতা বা উন্নয়ন কাজে আসেনি। সরকারবিরোধী হাওয়াই বেশি কাজ করেছে। আর নির্বাচনের সময় গাজীপুরের রাস্তাঘাটের যে অবস্থা ছিল, তাতে উন্নয়নের কথাও জোর দিয়ে বলা যায় না।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন যখন হয়, তখন প্রধানমন্ত্রী বিদেশে ছিলেন। দেশে ফিরে তিনি সবার কাছে জানতে চেয়েছেন, নির্বাচনী ফল এ রকম হলো কেন? কেন তাঁর দলের সৎ ও যোগ্য প্রার্থীরা হেরে গেলেন? কেন দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত প্রার্থীদের জনগণ ভোট দিয়ে জিতিয়ে আনল। তিনি আক্ষেপ করে বলেছেন, এত উন্নতির পরও যদি মানুষ ভোট না দেয়, তাহলে উন্নতি করে কী লাভ?
প্রধানমন্ত্রীর কথায় আত্মসমালোচনার চেয়ে ক্ষোভ-অভিমানই বেশি প্রকাশ পেয়েছে। গত সাড়ে চার বছরে তাঁর সরকার অনেক ভালো কাজ করেছে, যার স্বীকৃতি নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন গতকালও দিয়েছেন। কিন্তু এত সব ভালো কাজের সঙ্গে কিছু মন্দ কাজও করেছে। সবচেয়ে মন্দ কাজ হলো ব্যর্থতা স্বীকার না করা।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, তাঁর সরকার যদি দুর্নীতিই করবে, তাহলে দেশে এত উন্নতি হলো কীভাবে? প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই জানেন, উন্নতির সঙ্গে দুর্নীতির সম্পর্ক সব সময় বিরোধাত্মক নয়। দুটো সমান্তরালেই চলে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতির দেশে। আর সরকারের উন্নয়ন মানেই ঠিকাদারি। আর ঠিকাদারি মানে টেন্ডারবাজি। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-সমর্থক প্রার্থীরা যে হলফনামা নির্বাচন কমিশনে জমা দিয়েছেন, তা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, কেবল সিটি করপোরেশনের উন্নতি হয়নি, তাঁদের ব্যক্তিগত উন্নতিও যথেষ্ট হয়েছে। কারও কারও আয় ও সম্পদ বেড়েছে হাজার গুণ। মানুষ এগুলোও ভালো চোখে দেখেনি।
সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের ব্যাপারে গণমাধ্যম কিংবা বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ প্রধানমন্ত্রীর পছন্দ না হলে তিনি মাঠপর্যায়ে খোঁজখবর নিতে পারেন। প্রতিটি সিটিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব ও কর্মীরা বিভক্ত। সরকারের শেষ সময়ে এসে সুবিধাপ্রাপ্ত ও সুবিধাবঞ্চিত নেতা-কর্মীদের বিভাজনটি আরও প্রকট হয়েছে।
নির্বাচনের পর বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র শওকত হোসেন সংবাদ সম্মেলন করে যে বক্তব্য দিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী সেটি পড়ে দেখলে তিনি তাঁর প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন। শওকত হোসেন বলেছেন, তাঁর পরাজয়ের জন্য আবুল হাসানাত আবদুল্লাহই দায়ী।
প্রধানমন্ত্রী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজয়ের জন্য বিরোধী দলে অপ্রপচার, গণমাধ্যমের পক্ষপাত, টিভিতে টক শোওয়ালাদের ‘অসত্য বয়ান’ এবং ভোটারদের নির্বুদ্ধিতাকে দায়ী করেছেন। কিন্তু শওকত হোসেনের অভিযোগ সম্পর্কে কিছুই বলছেন না। দলের অন্য নেতারাও চুপ। শওকত হোসেন অসত্য অভিযোগ আনলে তাঁর বিরুদ্ধে দল কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না? আর তাঁর বক্তব্য সত্য হলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে কেন ছাড় দেওয়া হচ্ছে? বাদী ও বিবাদী দুজনকে নিয়ে মামলা চলতে পারে, দল চলে না। সেটি নারায়ণগঞ্জে প্রমাণিত হয়েছে। বরিশালেও প্রমাণিত। প্রধানমন্ত্রী কি সারা দেশেই তার প্রমাণ দেখতে চান?
প্রধানমন্ত্রী কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন। ভিডিও ফুটেজ দেখে মৌখিক পরীক্ষায় তাঁদের বাদ দেওয়ার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, যারা যারা রাস্তায় ভাঙচুর করে, তারা চাকরি পাওয়ার যোগ্য নয়। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের দুটি দিক আছে। আমরাও মনে করি, আন্দোলনের নামে রাস্তায় আগুন দেওয়া কিংবা উপাচার্যের বাসভবনে আগুন দেওয়া জঘন্য কাজ। তাই বলে প্রধানমন্ত্রী তাদের মৌখিক পরীক্ষা থেকে বাদ দিতে পারেন না। তিনি আইনি ব্যবস্থা নিতে পারেন। আর কোটাবিরোধীদের বিরুদ্ধে যদি তিনি আইনি ব্যবস্থা নেন, তাদের ওপর আক্রমণকারী ছাত্রলীগ বাদ যাবে কেন?
দেশের প্রধানমন্ত্রী তো বেছে বেছে কারও বিরুদ্ধে আইনের প্রয়োগ এবং কারও প্রতি তা রহিত করতে পারেন না।
সোহরাব হাসান: সাংবাদিক।