তাজউদ্দীন আহমদ এবং সরদার স্যার

তাজউদ্দীন আহমদ, সরদার ফজলুল করিম
তাজউদ্দীন আহমদ, সরদার ফজলুল করিম

১৯৮০ সালের একেবারে শুরুতে সবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছি। সবকিছু বড় বড় এবং নতুন। বলতে গেলে একেবারে কিছুই চিনি না। রুটিন এবং পাঠ্যসূচি হাতে পেয়ে সেগুলোই নাড়াচাড়া করি। মুখস্থ করে ফেলি ক্লাসরুম নম্বর, সিঁড়ির পথ, করিডর। অচেনা সবকিছুকে ঠেলে ঘড়ির কাঁটা ধরে বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকি রুমের সামনে। কিন্তু শিক্ষকের দেখা মেলে না, আমাদের ক্লাসও শুরু হয় না।
কিছুদিন পর একসময় সাহস করে ভেতরে ঢুকি। পরিচয় হয় একে একে। এরপর আরও কিছুদিন পর আমাদের রুটিনে শিক্ষকের নাম পরিবর্তন হয়। আমরা আমাদের প্রথম শিক্ষক হিসেবে পাই শওকত আরা আপাকে। তিনি আমাদের প্রাচীন গ্রিক সভ্যতা পড়াতে শুরু করলেন।
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁর প্রতিটি ক্লাসে উপস্থিত থেকে শুনতাম তাঁর প্রতিটি কথা। সক্রেটিস (স্কুলজীবন থেকে যিনি আমার আদর্শ, অন্তরের খুব কাছের মানুষ), প্লেটো, অ্যারিস্টটল পড়তে গিয়ে আমার শুধু মনে হয় আরও জানতে হবে, আরও জানতে হবে।
নিউমার্কেটে বইয়ের দোকানে দু-একজন সহপাঠীসহ বইয়ের খোঁজে ঘুরে বেড়াই। সরদার ফজলুল করিমের অনুবাদগ্রন্থ প্লেটোর রিপাবলিক কিনি। দর্শন কোষ কিনি। সরদার ফজলুল করিম রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক। স্যারকে সামনাসামনি দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যাই।
সহপাঠী ছোটন আর আমার মাথায় ঢোকে সরদার স্যারের কাছে রাষ্ট্রতত্ত্ব পড়ব।
একদিন স্যারের ক্লাসের বাইরে অপেক্ষা করতে থাকি। ক্লাস শেষে স্যারের পেছন পেছন হাঁটতে হাঁটতে বললাম, রাষ্ট্রতত্ত্ব পড়তে চাই। স্যার থমকে দাঁড়ালেন। খুব খুশি হলেন। বললেন, ‘আমি তো অনার্সের ক্লাস নিই না, তবে তোমরা যখন এসেছ আগ্রহ করে, এই আগ্রহকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।’ স্যার বললেন, ‘তোমরা আটজন এসো এক সঙ্গে, দেখি কী করা যায়।’
আমাদের প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হয়েছে দেরিতে, সঙ্গে নতুন একটা বিষয়, কেউ রাজি হলো না। স্যারকে এ কথা জানাতে গেলে তিনি মাঝে মাঝে দেখা করতে বললেন। সেই শুরু সরদার ফজলুল করিম স্যারের কাছে আমার অল্প অল্প যাওয়া।
অদ্ভুত লাগে মানুষটিকে। অসম্ভব পজিটিভ। বাবার সঙ্গে মিল খুঁজি। নিজের ভেতরে নতুন করে সাজাই সংসার, সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, বিশ্বচরাচর। অনন্ত জিজ্ঞাসা মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, স্বাধীন দেশে ১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও জেলহত্যা নিয়ে।
স্যারের সঙ্গে মাঝে দিয়ে দেখা নেই অনেক দিন। ১৯৮৬ সালে হঠাৎ একদিন তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি আম্মার (সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন) কাছে ফিরিয়ে দিতে এলেন বদরুদ্দীন উমর। তাঁর সঙ্গে আরও দুজন এবং সরদার ফজলুল করিম স্যার।
স্যার আমাকে এই বাসায় দেখে অবাক হলেন। আমি তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে জেনে বললেন, ‘কী সাংঘাতিক মেয়ে! এত দিন একবারও বলে নাই এর পরিচয়!’
স্যার স্বভাবসুলভ হাসতে হাসতে বললেন, ‘তাজউদ্দীন ও আমার জন্ম একই বছর, ১৯২৫ সালে। তাজউদ্দীন সম্পর্কে আমার একটা ধারণা অথবা বলা যায় দৃঢ় বিশ্বাস আছে, সেটা তোমাকে আরও আগে বলা যেত।’
স্যার ইংরেজিতে বলেন, ‘তাজউদ্দীন কেম বিফোর হিজ টাইম অ্যান্ড হি ইজ ইয়েট টু বি আন্ডারস্টুড।’ নিজেই বাংলা করলেন, ‘তাজউদ্দীন সময়ের অনেক আগে আবির্ভূত হয়েছেন, তাই তাঁকে বুঝতে আমাদের এখনো অনেক বাকি।’
আমি খাতায় লিখে রাখি।
এর পর থেকে যখনই দেখা হয় অথবা দীর্ঘক্ষণ ফোনে কথা, স্যার তাজউদ্দীন প্রসঙ্গ টানতেন প্রায় একই ছন্দে, একই শব্দে—‘আমার জন্ম ১৯২৫, তাজউদ্দীনেরও। কিন্তু দেখো, তাজউদ্দীন তাঁর ডায়েরি লিখতে গিয়ে বরিশালের কোনো অখ্যাত সরদার ফজলুল করিম ছাত্রদের প্রতিবাদ সভায় যোগ দিয়েছিল, সে কথা

লিখে রেখেছেন। আমি তো লিখিনি। মনেও রাখিনি কত কাউকে। তাজউদ্দীন লিখেছেন, সরদারের নাম, আরও অনেকের নাম।’
বাবার বন্ধু এবং শুভানুধ্যায়ী, যাঁদের প্রবল আগ্রহে ২৩ জুলাই ১৯৮৭ সালে প্রথম ছোট পরিসরে জন্মদিনের স্মরণ আয়োজন হয়েছিল, সরদার স্যার তাঁদের অন্যতম একজন।
১৯৭১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর বাংলা একাডেমি থেকে পাকিস্তান আর্মি সরদার স্যারকে ধরে নিয়ে টর্চার সেলে আটকে রাখে। স্যার সেই বর্ণনাও দিয়েছিলেন তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে, যা আজ শুধুই স্মৃতি। ছোটখাটো এই মানুষটিকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে মানসিক অত্যাচার করার সময়ে পাকিস্তান আর্মির লোকেরা চিৎকার করে বলত, ‘ইউ পিপল দ্য বাস্টার্ড সানস অব তাজউদ্দীন, উই শ্যাল টিচ ইউ আ গুড লেসন।’
‘আমি সরদার তখন ভাবতাম, তার মানে তাজউদ্দীন সঠিক পথেই আছে। আমাদের ভয় নাই। বঙ্গবন্ধু মুজিব তো ওদের হাতে বন্দী। তাই সব রাগ ওই তাজউদ্দীনের ওপর। তাজউদ্দীনকে পেলে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে—এমন ছিল তাদের দাঁত-মুখের ভঙ্গি।’
স্যার তাঁর স্ত্রীকে অত্যন্ত সম্মান করতেন। স্ত্রীর জন্য দুষ্টুমিতে ভরা কথা শুনে নির্মল আনন্দ উপভোগ করতাম খুব। চাচি মাঝে মাঝে নালিশ করতেন, স্যার পাশে থেকে হাসতে থাকতেন। ছেলেমেয়েদের খুব ভালোবাসতেন। স্যারের ভালোবাসা ছিল একটু ভিন্ন প্রকৃতির। মানুষের নিজস্বতা যে বিষয়টি, তাকে তিনি মূল্য দিতেন সবকিছুর ঊর্ধ্বে। বড় ছেলেটিকে নিয়ে চিন্তিত থাকতেন। কিন্তু সেখানেও ছিল অদ্ভুত এক মূল্যায়ন।
ঢাকার শ্যামলী, মগবাজার, মধুবাগ, ইন্দিরা রোডের বিভিন্ন বাসায় থেকেছেন তিনি। শক্ত মজবুত তাঁর মন। সতেজ তরুণ যুবক তিনি। বয়স হার মানে। পা ভাঙে। জোড়া লাগে। বাস ধরে ছুটে চলেন গাজীপুরে অথবা পুরান ঢাকার সেন্ট্রাল উইমেন্স বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে পড়াতে। আমাদের পাঠচক্রেও আসেন। একালের সক্রেটিস ছোটখাটো ফরসা মানুষটি। প্রশ্ন আর উত্তরের সিঁড়ি ভাঙেন। দৃষ্টি প্রসারিত। মুখে আলোর বন্যা।
১৯৮৯ সালে দৈনিক সংবাদ–এর ২১ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় সরদার স্যার লেখেন, ‘হেগেলের দুর্বোধ্য ভাষায় ইতিহাসের দর্শন তত্ত্বের একটি পরিচিত উক্তি হচ্ছে, “বুদ্ধিমানরা ইতিহাসের সঙ্গে যায়, নির্বোধকে ইতিহাস টেনে নেয়”। তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন আমাদের সমকালীন সঙ্গীদের অন্যতম সেই ব্যক্তি, যিনি ইতিহাসের গতিপথকে সচেতনভাবে অনুসরণ করেছেন। যিনি ইতিহাসের সঙ্গে গেছেন।’
সরদার স্যার তাঁর অ্যারিস্টটলের পলিটিকস বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণের মুখবন্ধে লিখেছেন, ‘ব্যক্তি মানুষের মৃত্যু থাকে। কিন্তু যথার্থ চিন্তাবিদের কোনো মৃত্যু থাকে না। আমাদের স্মৃতিতেই তাঁদের জীবন। এবং তাঁদের জ্ঞান ও চিন্তার ভান্ডারের বিশ্লেষণ ও অনুধাবনের মধ্যেই যেকোনো বর্তমানের অচিন্তনীয় সমৃদ্ধি।’
সরদার স্যারের সুরে সুর মেলাই, তাজউদ্দীন আহমদের মতো মানুষেরা যুগে যুগে জন্ম নেন না। এই ক্ষণজন্মা মহাপ্রাণ মানুষেরা বিশ্বকে আলোকিত করেন তাঁদের চিন্তায়, কর্মে, আহ্বানে, যা প্রতিনিয়ত পথ দেখায় আজ, আগামী এবং অনাগত ভবিষ্যৎকে। সুন্দর ভবিষ্যৎ, আত্মপ্রত্যয়ী বাংলাদেশ গড়ে তুলতে আমরা যেন তাঁদের অনুসরণ করতে পারি গর্বিত-ভালোবাসায়।
সিমিন হোসেন রিমি: সাংসদ, সমাজকর্মী ও লেখক। তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা।
[email protected]