'আড়াই প্যাঁচ'

সেদিন এক পাঠক অভিযোগ জানালেন, ‘আপনারা শুধু সরকারের অপকর্ম দেখেন, বিরোধীদের ক্রিয়াকর্ম নিয়ে লিখতে পারেন না? এই যে ওঁরা ঈদের পর আবার আন্দোলনে যাবেন, সেটা নিয়েই লেখেন।’ তাঁকে শুধু হেসে বিদায় করেছি। কিন্তু সত্যি বলি, এসব লিখে কী হবে? কী হয়? কে শোনে এসব?
বাদ দিন রাজনীতি। আসুন রোজার মাসের ইফতারের গল্প করি। ঢাকার পুরোনো এলাকার ঐতিহ্যবাহী ইফতারের কথা নতুন করে বলার নেই কিছু। কিন্তু আপনারা নিশ্চয়ই একটা ব্যাপার খেয়াল করেছেন, সবকিছুর শেষে জিলাপি থাকবেই। সারা দিন চিনিবিহীন শরীরে যতটা সম্ভব চিনি প্রবেশ করানো জরুরি।
রোজা ছাড়াও বাঙালির কাছে জিলাপি সব সময়ই জনপ্রিয়। এর উৎপত্তি কোথায় জানা নেই আমার। তবে যত দূর শুনেছি, সেটা এই ভারতবর্ষেরই উদ্ভাবিত একটি মিষ্টি, সম্ভবত লক্ষ্ণৌ এর উৎপত্তিস্থল। আরব দেশেও জনপ্রিয় জিলাপি। কবে সেখানে গেছে জানি না, তবে বেশ আগেই গেছে।
আমি একবার লিবিয়ার ত্রিপোলির সুক বালাদিয়ায় (পৌরবাজার) জিলাপি দেখে কিনতে গিয়ে একটু ঝামেলায় পড়েছিলাম। আরবিতে কী বলে জানি না, তাই কী বলে চাইব বুঝতে পারছিলাম না। শেষমেশ দোকানদারকে আঙুল দিয়ে ইঙ্গিত করে বললাম, ‘এইটা দাও।’
সে বলল, ‘তিব্বি জিলাবি?’ তার মানে, ‘জিলাপি চাও?’
আমি ভ্যাবাচেকা খেলাম। আরব দেশেও এটার নাম জিলাপি। তবে যেহেতু তাদের বর্ণমালায় কোনো ‘প’ নেই, তারা বলে ‘জিলাবি’।
ছোটবেলায় দেখতাম শুধু মিলাদের শেষেই জিলাপি বিতরণ করা হতো। আর এখন তো সে ঠাঁই করে নিয়েছে অভিজাতদের মাঝে। ধনাঢ্য ব্যক্তিদের বিবাহে ভোজনপূর্বে এই জিলাপিই এখন দেখি আপ্যায়নের মুখরোচক সামগ্রী। তবে অবশ্য এর রূপের পরিবর্তন হয়েছে। হরেক রঙের জিলাপি দেখি ইদানীং। কেউ পুড়িয়ে গাঢ় খয়েরি করে, কেউ রং ছাড়া করে। কেউবা ব্যবহার করে জাফরানি রং। মোটা, চিকন, চিকনতর জিলাপি তৈরি হচ্ছে আজকাল। বড়, ছোট সব রকম। ব্যবহৃত হচ্ছে সুগন্ধি। একটু উন্নতমানেরও হচ্ছে—অমৃত (কেউ বলেন আমৃত্তি)। নির্ভেজাল ছানা দিয়েও জিলাপি হচ্ছে, ছানার জিলাপি।
ছোটখাটো চা-দোকানে শ্রমিক ভাইদের প্লেটেও জিলাপি দেখা যায়। আবার সেই জিলাপিই পাঁচতারা হোটেলের নামীদামি প্লেট-বাসনেও উপস্থিত হচ্ছে। তবে যা-ই হোক, সাইজ যেটাই হোক, একটি জায়গায় সব সমান। আর তা হচ্ছে এর প্যাঁচ। হ্যাঁ, আড়াই প্যাঁচ না হলে জিলাপি হয় না। এটাই নিয়ম।
এই আড়াই প্যাঁচের কারণেই জটিল মনের ব্যক্তিদেরও বলা হয় জিলাপি। ‘ভাই, আপনের পেটে তো দেখি জিলাপির পুরা আড়াই প্যাঁচ!’ এমনই কথাবার্তা আমরা বলে থাকি।
এই প্যাঁচেরই ধাঁধায় পড়ে গেলেন এক বাঙালি ভাই। সে কবেকার কথা কে জানে। বিকেল হতেই বউকে বলল, ‘বউ, আইজ হাটে যাইতে মন চাইতেছে।’
‘মন চাইতেছে যখন যান, কী কিনবেন হাটের থেইকা?’
‘দেখি কী কিনন যায়। যেইটা মনে ধরে সেইটাই আনুম।’
সারা হাট ঘুরে কিছুই তার মনে ধরল না। ফেরার সময় হঠাৎ চোখে পড়ে হাটের শেষ প্রান্তে রাস্তার ধারে এক লোক জিলাপি বানাচ্ছে। বাঙালি দাঁড়িয়ে পড়ল দেখতে। মজা পেল খুব। বিশেষ করে আড়াই প্যাঁচ দেখাটা তাকে আকৃষ্ট করল ভীষণ।
বাড়ি ফিরেই বউকে ডেকে বলে, ‘বউ, একটা দারুণ জিনিস দেইখা আসছি। তুমি জিনিসপত্র জোগাড়

করো, আমি জিলাপি বানামু।’
দুজনে মিলে পরদিনই বসে গেল জিলাপি বানাতে। বউ বেসন, তেল, গুড়, সুগন্ধি, চিনি, সামান্য ময়দা ইত্যাদি আর যা যা বলল স্বামী সবই জোগাড় করল। আর হ্যাঁ, অবশ্যই নারকেলের আধখানা মালা (ফুটোসহ) আনতে ভুলল না। কারণ, এটা ধরেই তো আড়াই প্যাঁচ দিতে হবে।
সব তৈরি, এখন জিলাপি বানানো হবে। নারকেলের মালায় বাঙালি ভাই বেসনের মিক্সচার নিল। ফুটোটায় একটা আঙুল দিয়ে ধরল। কড়াইতে তেল ফুটছে। বাঙালি বলে, ‘দেখো বউ, এবার কেমন করে জিলাপি বানাই।’ মালাটা নিল কড়াইয়ের ওপর, আঙুলটা ফুটো থেকে সরাল। আড়াই প্যাঁচ দিল।
কিন্তু হায় জিলাপি হলো না! আড়াই প্যাঁচ দেওয়া সত্ত্বেও সব মাল এক জায়গায় মুখ থুবড়ে পড়ল স্তূপীকৃত হয়ে। আবার চেষ্টা করল, এবারও ব্যর্থ।
মাথায় হাত দিয়ে বসল বাঙালি। হায় হায়, ইজ্জত যে যায়। বউও কী ভাবল তাকে, পাড়ার লোকেরা যারা দেখতে এসেছিল তারাই বা কী রকম ভেবে গেল! নিশ্চয়ই হাসি-তামাশা করবে এটা নিয়ে। করলও তারা মশকরা-মন্তব্য।
পরদিন সে ছুটে গেল সেই ময়রার কাছে। কেঁদে পড়ল তার পায়ে।
‘ভাইরে, ইজ্জত তো গেল!’
‘কেন, কী হয়েছে?’
সব খুলে বলতেই ময়রা বুঝে ফেলল ঘটনা। সে তো হেসেই অস্থির। তারপর আড়াই প্যাঁচ বোঝাতে শুরু করল তাকে।
ঘটনা কী হয়েছিল অনুমান করতে পারেন আপনারা? পারেননি? তাহলে শুনুন।
নারকেলের মালার ফুটো থেকে আঙুলটা সরিয়েই হাতের আড়াই প্যাঁচ দেওয়ার কথা। কিন্তু বাঙালি ভাই, আঙুল সরিয়ে হাতটা স্থির রেখে নিজের নিতম্বকে ক্যাবারে নর্তকীর মতো আড়াই প্যাঁচ ঘুরিয়েছিল। আর তাতেই সব মালামাল মুখ থুবড়ে পড়েছিল। একই জায়গায়।
আসলে সে জিলাপি বানানো দেখে এসেছিল, শিখে আসেনি। আর তাতেই বিপত্তি।
ঠিক যেমন আওয়ামী লীগের আন্দোলন দেখে এসেই আন্দোলন করেছিল জাতীয়তাবাদী দল । কিন্তু শিখে আসেনি কীভাবে করতে হয়। তাতেই তো মুখ থুবড়ে একাকার। এবার কি শিখে আসছে তারা?
দুঃখিত, এসব বলা আমার কাজ নয়। আমি রাজনীতি করি না, করতেও চাই না। আড়াই প্যাঁচের ভেতরই বাস করছি, অসুবিধা নেই। কিন্তু প্যাঁচ দেওয়ার চেষ্টা কখনোই করিনি, করতেও চাই না। এটা ছিল ঈদের আনন্দে আপনাদের একটু মিষ্টিমুখ করার চেষ্টামাত্র।
ঈদ মোবারক সবাইকে। সুন্দর এবং আনন্দঘন একটা ঈদ কাটুক আপনাদের সবার। সেই সঙ্গে গাজার নির্যাতিত, নিপীড়িত জনগণের জন্য মোনাজাতে সামান্য স্থান দিতে ভুলবেন না যেন।
পুনশ্চ: সামনে জমজমাট ফুটবল খেলা আসছে, খেলোয়াড়েরা মাঠে যা খুশি করুন, কিন্তু হুঁশিয়ার থাকবেন, দর্শক গ্যালারি যেন শান্তিপূর্ণ থাকে।

আবুল হায়াত: নাট্যব্যক্তিত্ব।