দারিদ্র্য কমে, অপুষ্টি কমে না কেন?

বাংলাদেশের শিশু পুষ্টি পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম আলোয় ১ আগস্ট একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। সেটি তৈরি করা হয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের ভিত্তিতে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ‘পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন ২০১৪’-এ দেখা যাচ্ছে, গত দুই বছরে দেশে তীব্র অপুষ্টির হার বেড়েছে ২ শতাংশ। এত অল্প সময়কালের মধ্যে অপুষ্টি বেড়ে যাওয়ার এই হার নিয়ে সত্যি সত্যিই আশঙ্কার কারণ আছে। প্রতিবেদনটিতে অপুষ্টি বেড়ে যাওয়ার পেছনে যেসব কারণ উল্লেখ করা হয়েছে, তার মধ্যে আছে শিশুকে বুকের দুধ না খাওয়ানো, খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা, আয়ের স্বল্পতা, মায়ের অপুষ্টি ইত্যাদি।
‘শিশু-অপুষ্টি’র এই বিষয়টি পরদিন প্রথম আলোর সম্পাদকীয়তেও স্থান পেয়েছে। সেখানে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, দেশে যেখানে অর্থনীতির উন্নয়ন হয়েছে এবং দারিদ্র্য কমেছে, পুষ্টি পরিস্থিতির সেখানে উন্নতি হওয়ার পরিবর্তে অবনতি হলো কেন? খাদ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে অপুষ্টি বাড়ার কারণ হিসেবে যে বিষয়গুলো দেখানো হয়েছে, সেগুলো তো আগেও ছিল। তার পরও শিশু পুষ্টি পরিস্থিতির চিত্র এত ধূসর কেন?
পুষ্টি ও জনস্বাস্থ্যে কাজ করার সুবাদে অনেকগুলো বছর ধরে দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে ঢাকা বা চট্টগ্রামের মতো বড় শহরের বস্তি ও ঝুপড়িতে আমার ঘুরে বেড়ানোর অবকাশ হয়েছে। সেখানে লক্ষ করেছি পুষ্টি নিয়ে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। শুধু দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা পরিবারগুলোতেই নয়, অপুষ্টির সাংঘাতিক প্রতাপ দেখেছি দারিদ্র্যসীমা অতিক্রম করা পরিবারগুলোয়ও। ঘরে খাবারের সংস্থান বা খাদ্যনিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নতি—এসবের আপাত কোনো প্রভাব শিশুদের পুষ্টিতে খুব একটা পড়তে দেখিনি। অনেক ক্ষেত্রেই বরং স্বল্প আয়ের এসব পরিবারে অপুষ্টি এসেছে দারিদ্র্যসীমা পেরিয়ে যাওয়ার একটি উপজাত হিসেবে। কিন্তু কেন এই অদ্ভুত বৈপরীত্য?
দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের দায়িত্বের পরিধি বেড়েছে। সাম্প্রতিক দশকগুলোয় আমাদের স্বল্প উপার্জনক্ষম গোষ্ঠীর মেয়েরা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত হতে শুরু করেছেন। তাঁরা ঘরের কোণ থেকে বেরিয়ে এসে যুক্ত হচ্ছেন অর্থনৈতিক নানাবিধ কর্মকাণ্ডে। এতে তাঁদের ব্যক্তিগত উপার্জন বাড়ছে। পারিবারিক পর্যায়ে তাঁদের তুলনামূলক আর্থিক সচ্ছলতা আসছে। নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো টপকাতে শুরু করেছে দারিদ্র্যের সীমারেখা। কিন্তু কিসের বিনিময়ে এটি ঘটছে?
স্বল্প আয়ের এই পরিবারগুলোয় আগের তুলনায় রোজগার বাড়ছে ঠিকই, তবে তা কোনোক্রমেই একটি পর্যায়ের ওপরে আর উঠছে না। তাই সে উপার্জনে চাকুরে মায়েরা তাঁদের অনুপস্থিতিতে শিশুর দেখভালের বিকল্প কার্যকর কোনো ব্যবস্থার সংস্থান করতে পারছেন না। দেশে এখনো এমন কোনো সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি, যেখানে স্বল্প আয়ের কর্মজীবী মা তাঁর সামর্থ্যের মধ্যে সন্তানকে সারা দিনের দেখভালের জন্য দিবাযত্ন কেন্দ্র ধাঁচের কোথাও রেখে যেতে পারেন; তাদের দেখভালের সুসংগত ব্যবস্থা করতে পারেন।
গ্রামাঞ্চলে তবু যৌথ পরিবার থাকায় শিশু আত্মীয়-পরিজনের মধ্যে বেড়ে ওঠার সুযোগ পায়। তার পরও মায়ের সঙ্গে থাকতে না পারার কারণে তাদের অনেকেই বঞ্চিত হয় মায়ের দুধ থেকে। এতে শিশুর বিকাশ ও বৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে মারাত্মকভাবে। নগরাঞ্চলে প্রায়ই দেখা যায়, বস্ত্রশিল্প বা কলকারখানায় কাজ করা নারীরা তাঁদের শিশুসন্তানকে বড় সন্তানের কাছে রেখে কর্মস্থলে যাচ্ছেন। পরিবারে শিশুর দায়িত্বের ভার এখন পর্যন্ত যতটা না বাবার, তার চেয়ে বেশি মায়ের। তাই মা যখন আর্থিক সংস্থানের বাড়তি দায়িত্ব পালন করছেন, তখন যত্নের ভাগ কম পড়ে যাচ্ছে শিশুর।
পুষ্টিবিজ্ঞান সম্পর্কে যাঁদের ধারণা আছে, তাঁরা সবাই জানেন, শিশুর অপুষ্টি রোধ ও পূর্ণ বিকাশের জন্য জন্মের পর থেকে প্রথম দুই বছর সময়কালটা অসম্ভব মূল্যবান। এ সময়ের মধ্যে শিশুর পুষ্টি নিশ্চিত করা তার সারা জীবনের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য জরুরি। শিশুকে তার প্রথম ছয় মাস বয়স পর্যন্ত কেবল বুকের দুধ দেওয়া এবং পরের ১৮ মাস বুকের দুধের পাশাপাশি বাড়তি খাবারের জোগান নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। অথচ স্বল্প আয়ের কর্মী মায়ের পক্ষে দুঃখজনকভাবে তা নিশ্চিত করার উপায় নেই। বাংলাদেশে বেশির ভাগ কর্মক্ষেত্রে শিশুকে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়ার ও সেখানে রাখার কোনো সুবিধা নেই। বর্তমানে যেখানে একজন নারী কর্মীকে তাঁর প্রাপ্য পাওনা আদায় করার জন্য লড়াই করতে হচ্ছে, সেখানে নারী ও শিশুবান্ধব কর্মক্ষেত্র তো দিল্লি দুরস্ত।
স্বল্প আয়ের এই মায়েরা শিশুকে বুকের দুধ দিতে পারছেন না। তার পরিবর্তে দিতে হচ্ছে কৌটার সস্তা দুধ, সেদ্ধ চালের গুঁড়া বা সুজির পানি। তিন-চার মাসের শিশুর ক্ষুধা মেটাতে তাকে যে বাড়তি খাবার দেওয়া হচ্ছে, তার অপরিপক্ব পাকস্থলী তা হজম করার জন্য আদৌ প্রস্তুত হয়ে ওঠেনি। এই পাকচক্রের বিপুল ভার এসে চেপে বসছে শিশুদের অপুষ্ট ঘাড়ে। সুবিধাবঞ্চিত নিম্ন আয়ের মায়েরা সংসারের রোজগার সামান্য বাড়াচ্ছেন বটে। কিন্তু তার বিনিময়মূল্য হিসেবে পরিশোধ করছেন শিশুর পুষ্টি আর স্বাস্থ্য। জীবনের সূচনাতেই এই শিশুদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়তি-নির্দিষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই ভার কাঁধে নিয়ে জাতি হিসেবে আমরা সামনে এগোব কী করে?
কিন্তু এই অজুহাতে তো মেয়েদের অকর্মণ্য করে ঘরের কোণে আটকে রাখা চলে না। তবে বাস্তবতা এই যে আমাদের নারী ও শিশুরা দারিদ্র্য, বৈষম্য আর অপুষ্টির এ এক দুর্বিষহ দুষ্টচক্রে এখনো আবদ্ধ হয়ে আছেন। এ চক্র ছিন্ন না করে আমাদের পক্ষে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে যাওয়া কঠিন। তাই নিজেদের স্বার্থেই এটি ছিন্ন করার পন্থা নিয়ে গভীরভাবে ভাবা দরকার।

আসফিয়া আজিম: জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টিকর্মী।