ফিলিস্তিনি যুদ্ধ এবং কর্নেল তাহেরের একটি চিঠি

পৃথিবী কোথায় এসে ঠেকেছে, তা-ই ভাবছিলাম গাজার ঘটনাবলি দেখে। দেখছিলাম এককালের অত্যাচারিত ইসরায়েল ইতিহাসের পাকচক্রে কেমন পরিণত হয়েছে এক ভয়ংকর অত্যাচারীতে। একদিকে পশ্চিমা বড় শক্তিগুলোর স্বার্থ আর ষড়যন্ত্র, অন্যদিকে আরব বিশ্বের আপসকামিতা আর অনৈক্য ইসরায়েল-ফিলিস্তিন প্রশ্নটাকে পৃথিবীর মানচিত্রে গভীরতম একটা ক্ষত হিসেবে টিকিয়ে রেখেছে। গত শতাব্দী থেকে শুরু হওয়া এই সংকট আজকের এই শীতল যুদ্ধোত্তর আরব বসন্ত উত্তর পৃথিবীতে হয়ে উঠেছে আরও জটিল। সেই জটিল পাকচক্রে পড়ে কী করে গাজার নিরীহ মানুষ নির্বিচারে নিহত হচ্ছে, তা দেখে যখন বিমূঢ় হয়ে আছি, তখন হঠাৎ একটা চিঠির ওপর দৃষ্টি পড়ে চাঙা হয়ে উঠি। ফিলিস্তিনের যুদ্ধে অংশগ্রহণের আকাঙ্ক্ষা জানিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে এই চিঠিটা লিখেছিলেন কর্নেল তাহের, ১৯৭৩ সালে। কর্নেল তাহেরের জীবন এবং রাজনীতিবিষয়ক একটা বই লেখার সুবাদে তাহের পরিবারের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। তাদের পরিবারের একজন সদস্য কর্নেল তাহেরের স্ত্রী লুৎফা তাহেরের কাছে সংরক্ষিত এই চিঠিটা আমার নজরে আনেন। চিঠিটা ইংরেজিতে লেখা। চিঠির ব্যাখ্যার আগে এর একটা বাংলা অনুবাদ হাজির করছি:

এম এ, তাহের বি উ, লে. কর্নেল (অব.)
ম্যানেজার, সি-ট্রাক ইউনিট
৩০ আর কে দাশ রোড
নেতাইগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা
তারিখ: ১৩ অক্টোবর ১৯৭৩

.
.

জনাব প্রধানমন্ত্রী,
জেয়োনিস্ট আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আমাদের আরব ভাইদের লড়াইয়ের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করার জন্য একদল মুক্তিযোদ্ধাকে পাঠানোর ব্যাপারে আপনার যে আকাঙ্ক্ষার কথা ব্যক্ত করেছেন, তা মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমাদের বিশ্বাসী ভাইদের এই কঠিন পরীক্ষার সময় তাদের পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করতে যাওয়ার জন্য আমার ইচ্ছা ব্যক্ত করছি।
আমার যোগ্যতা প্রসঙ্গে বলতে পারি, আমার দুটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার অভিজ্ঞতা আছে। আমি ১৯৬৫ সালে ইন্দো-পাকিস্তান যুদ্ধে পাকিস্তানের প্রতি ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শিয়ালকোট সেক্টরে যুদ্ধ করেছি। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সর্ববৃহৎ সেক্টরকে নেতৃত্ব দেওয়ার সম্মান আমি পেয়েছি। আমার সেক্টরের ছেলেরাই প্রথম ঢাকায় পৌঁছে ঢাকাকে মুক্ত করে।
আমি উল্লেখ করতে চাই একটি বিপন্ন জনগোষ্ঠীর মুক্তি এবং ন্যায়বিচারের লক্ষ্যে চালিত যুদ্ধে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে আমার বর্তমান শারীরিক প্রতিবন্ধিতা যেন অযোগ্যতা বলে বিবেচিত না হয়। জনাব, আপনি অবগত আছেন যে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল স্যাম ব্রাউন, জার্মান সেনাবাহিনীর জেনারেল কাউন্ট ভন স্টফেনবার্গ, ব্রিটিশ বিমানবাহিনীর ডগলাস বাডার প্রমুখের মারাত্মক শারীরিক প্রতিবন্ধিতা থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁরা অসাধারণ যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে এও উল্লেখ করা যেতে পারে যে জেয়োনিস্ট সেনাবাহিনীর কমান্ডার জেনারেল মোসে দায়ানেরও শারীরিক প্রতিবন্ধিতা আছে।
জনাব, আপনি যদি আমাকে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে আমাদের আরব ভাইদের সহায়তা করার সদয় অনুমতি দেন, তবে আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ থাকব।

একান্ত আপনার
(স্বাক্ষর)
এম আবু তাহের বি উ, লে. কর্নেল (অব.)


লক্ষ করার ব্যাপার, চিঠিটা কর্নেল তাহের লিখছেন ১৩ অক্টোবর ১৯৭৩ সালে। স্মরণ রাখা দরকার যে সে সময় বহুল আলোচিত ২০ দিনব্যাপী আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ চলছে। ইসরায়েল দখলকৃত ফিলিস্তিন অঞ্চলকে দখলমুক্ত করতে মিসর ও সিরিয়ার যৌথ বাহিনী ইসরায়েলের ওপর আক্রমণ করে ১৯৭৩ সালের ৬ অক্টোবর। দুই পক্ষের ব্যাপক

ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং অবশেষে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি ঘটে ২৫ অক্টোবর ১৯৭৩ সালে। জানা যাচ্ছে, আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু হওয়ার সপ্তাহ খানেকের মাথায় বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ফিলিস্তিনে যুদ্ধ করার জন্য এ দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের পাঠানোর ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন।
কর্নেল তাহের এই চিঠি লেখার সময় সেনাবাহিনীর সদস্য নন। এর ঠিক বছর খানেক আগে নীতিগত প্রশ্নে তিনি সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেছেন এবং ম্যানেজার হিসেবে যোগ দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জের সি-ট্রাক ইউনিটে। অন্তরালে অবশ্য তখন জাসদ রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার প্রক্রিয়ায় আছেন। এমন একটা পর্যায়ে তিনি ফিলিস্তিন যুদ্ধে সশরীরে যুক্ত হওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করছেন। যোদ্ধা হিসেবে তাঁর যোগ্যতা প্রমাণের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে তিনি তাঁর পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। যুদ্ধে যোগ দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা তাঁর এতই তীব্র যে তিনি সে সুযোগ যেন কিছুতেই হাত ফসকে না যায়, সেটা নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীকে সচেতন করে দিচ্ছেন যেন তাঁর শারীরিক প্রতিবন্ধিত্ব এই ক্ষেত্রে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়।
আমরা জানি যে ১১ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহের যুদ্ধক্ষেত্রে শেলের আঘাতে একটি পা হারিয়েছিলেন। পৃথিবীর সামরিক ইতিহাস সম্পর্কে তাহেরের জানাশোনার পরিধি কতটা ব্যাপক তা বোঝা যায় যখন তিনি শারীরিক প্রতিবন্ধিতা যে যুদ্ধ পরিচালনায় কোনো বাধা না, সে যুক্তি দেখাতে গিয়ে অনেক সমরনায়কের নাম উল্লেখ করেছেন। তাহের যে সাম ব্রাউনের কথা বলেছেন, তিনি ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সেনাবাহিনীর সেনাকর্তা ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এবং ব্রিটিশ-আফগান যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে ভিক্টোরিয়া ক্রস পেয়েছিলেন। তাঁর একটা হাত ছিল না। প্রতাপশালী জার্মান জেনারেল স্টফেনবার্গের কথা উল্লেখ করেছেন তাহের, যিনি হিটলারকে হত্যা করে উৎখাত করার পরিকল্পনা করেছিলেন, যাঁকে পরে ফায়ারিং স্কয়াডে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তাঁরও একটা হাত ছিল না। ডগলাস বাডার দুর্ঘটনায় দুটি পা-ই হারিয়েছিলেন, তারপরও তিনি পাইলট হিসেবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বীরত্বের পরিচয় দেন এবং বহু খেতাব পান। তাহের এও স্মরণ করিয়ে দেন যে এমনকি ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধান মোসে দায়ানও শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী। কারণ, তাঁর একটা চোখ ছিল অন্ধ।
কর্নেল তাহের ফিলিস্তিনে যাওয়ার অনুমতি পাননি। ঠিক কোন কারণে তাঁকে ফিলিস্তিন যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি, সেটা আমাদের জানা নেই। তবে বাংলাদেশ থেকে বেশ কিছু তরুণ তখন ফিলিস্তিনে যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন। সে সময় ফিলিস্তিন, ভিয়েতনাম, কিউবার মুক্তিসংগ্রাম তৃতীয় বিশ্বের বহু তরুণের কাছে ছিল অনুপ্রেরণার বিষয়। সেই অনুপ্রেরণা থেকেই তাহের তাঁর সাম্প্রতিক যুদ্ধ অভিজ্ঞতা ফিলিস্তিনের মুক্তিসংগ্রামে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন ধারণা করা যায়।

উল্লেখ্য, তখনকার ফিলিস্তিনের যুদ্ধে আজকের মতো এমন ধর্মীয় লেবাস চড়েনি। লক্ষণীয়, তাহের এই যুদ্ধে যোগ দেওয়ার পেছনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, একটি বিপন্ন জনগোষ্ঠীর মুক্তি এবং ন্যায়বিচারের লক্ষ্যকে। মানুষের মুক্তির সংগ্রামে বরাবর সক্রিয় আগ্রহ ছিল তাহেরের। বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামকে তিনি আন্তর্জাতিক বিপন্ন জনগোষ্ঠীর মুক্তির সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত করতে চেয়েছিলেন। আজকের বাংলাদেশের তারুণ্য এক ভিন্ন প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে, আজকের ফিলিস্তিনের সংকটও নিয়েছে ভিন্ন রূপ, তবু চার দশক আগে লেখা এই চিঠি সাম্প্রতিক ফিলিস্তিনসংকটের পরিপ্রেক্ষিতে নানা মাত্রার অর্থ নিয়ে উপস্থিত হয় আমাদের সামনে।

শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
[email protected]