গাজার গণহত্যা: বিশ্ববিবেক বসে নেই

ব্রাজিলীয় কার্টুন শিল্পী কার্লোস লুতোফের চিত্রময় প্রতিবাদ
ব্রাজিলীয় কার্টুন শিল্পী কার্লোস লুতোফের চিত্রময় প্রতিবাদ

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর চালানো গণহত্যায় বিশ্ববিবেকের নিশ্চুপ থাকা নিয়ে ক্ষোভ আর হতাশা ব্যক্ত করেছেন। প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ ফিলিস্তিনের গাজা ভূখণ্ডে বসবাসকারী জনতাকে যে বর্বর হামলার মুখে পড়তে হয়েছে, তার গভীরতা ও মর্মান্তিকতা উপলব্ধি করার জন্য। তবে যে অভিযোগ তিনি বিশ্ববিবেকের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে করছেন, সেটা মনে হয় যথাযথ হচ্ছে না।
বিশ্ববিবেক গাজার মর্মান্তিকতা দেখে চুপ করে বসে নেই। বিশ্বের সব বিবেকবান মানুষ ও রাষ্ট্র এই বর্বরতার নিন্দাই কেবল করছে না, বরং সেই সঙ্গে নিজেদের সাধ্যমতো যতটা সম্ভব পদক্ষেপও এর বিরুদ্ধে নিচ্ছে। তবে যারা নীরব থেকে সেই গণহত্যার পেছনে মদদ দিয়ে যাচ্ছে, আমরা তো জানি তারা হচ্ছে বরাবরের সেই বিবেকহীন গোষ্ঠী, বিশ্বজুড়ে অশান্তির ঝড় তুলে নিজেদের ফায়দা তুলে নিতে যারা সব সময় ব্যস্ত। আর সেই বিবেকহীনদের কাতারে বিশ্বের তথাকথিত সংবাদমাধ্যমের মোড়লেরা যুক্ত হওয়ায় বিশ্বের যে বিবেক সেই অমানবিকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছে, সেই সংবাদ থেকেও আমাদের হতে হচ্ছে বঞ্চিত। ফলে প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগের অঙ্গুলি সেই সব দিকে নির্দেশিত হলে সেটা মনে হয় আরও অনেক বেশি যুক্তিসংগত হয়ে উঠতে পারত। কেননা বারাক ওবামা বলুন, ডেভিড ক্যামেরন বলুন, ফ্রাঁসোয়া ওলঁাদ বলুন, কিংবা আমাদের ধর্মের রক্ষাকর্তা হিসেবে নিজেদের ঘোষণা করা রাজা-বাদশাহ, আমির-ওমরাহদের কথাই বলুন, বিশ্ববিবেক বলতে যা বোঝায় তার কোনো কিছুই কখনো এদের কাছ থেকে প্রত্যাশা করা যায়নি এবং ভবিষ্যতেও যাবে না। আর গাজার ঘটনায় এরাই আছে সবচেয়ে বেশি নীরব এবং বিশ্বের সংবাদমাধ্যমের মোড়লেরা এদের তোষামোদে সদা ব্যস্ত থাকায় সত্যিকার অর্থে বিবেক জাগ্রত হওয়ার খবর থেকেও আমরা হচ্ছি বঞ্চিত। বিশ্ববিবেক কোনো অবস্থাতেই নিশ্চুপ বসে নেই।
পশ্চিমের নেতৃস্থানীয় সংবাদমাধ্যম সেই সব সংবাদ কেবল সংবাদ চেপেই রাখছে না, বরং উল্টোভাবে এর সঙ্গে কোনটা সঠিক আর কোনটা ভুল পদক্ষেপ, সেই তালিমও বিশ্ববাসীকে দেওয়ার ব্রত নিয়ে ময়দানে এরা উপস্থিত আছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনের রুশ ভাষাভাষীদের রক্ষা করায় ব্রতী হওয়ায় তাঁর প্রশংসা দেশটির সংবাদমাধ্যমের কিছু প্রতিনিধি করায় পশ্চিমের সেই প্রভুতোষণের সংবাদমাধ্যম ও তাদের এদেশীয় অনুরাগীদের কাছে সেটা হয়ে ওঠে সংবাদমাধ্যমের হঠকারিতার জুতসই এক দৃষ্টান্ত। অন্যদিকে গাজা নিয়ে টুঁ–শব্দটি না করায় এদের মনোভাব এবং সত্য গোপনের সর্বাত্মক প্রয়াসের মধ্যে এদের অনুসারীরা খুঁজে পায় তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত হওয়ার প্রমাণ।
এবার দেখা যাক বিশ্ববিবেক বলতে আমরা যা বুঝি তা ঠিক কী বলছে গাজা নিয়ে এবং কোন পদক্ষেপই বা এদের পক্ষ থেকে গ্রহণ করা হচ্ছে ইসরায়েলকে বুঝিয়ে দিতে যে তাদের আচরণ মানব সভ্যতা বলতে আমরা যা বুঝি তার পরিপন্থী।
১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের যে সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের আবির্ভাব নিশ্চিত করা গিয়েছিল, সেই সিদ্ধান্ত অনুমোদনের পেছনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন তখন করে লাতিন আমেরিকার রাষ্ট্রসমূহ। প্রস্তাব পাস হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ৩৩টি ভোটের মধ্যে ১২টি এসেছিল লাতিন আমেরিকার দেশগুলো থেকে। ফলে ইসরায়েলের সঙ্গে সেই তখন থেকেই সেই সব দেশের সঙ্গে বজায় আছে খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। শুধু তা-ই নয়, আর্জেন্টিনার মতো কয়েকটি লাতিন দেশে বসবাসরত ইহুদি জনগোষ্ঠীও সেই সম্পর্ক গভীর করে তোলায় অবদান রাখে। ফলে মধ্যপ্রাচ্য সমস্যায় লাতিন দেশগুলো ১৯৮০-এর দশকের শেষ দিক পর্যন্ত ছিল মার্কিন অবস্থানের বলিষ্ঠ সমর্থক। আর সেই সমর্থনের প্রকাশ এরা সব সময়

তুলে ধরেছিল নীরবতার মধ্য দিয়ে, অর্থাৎ প্রভু যা বলছেন তার বিরুদ্ধাচরণ আমরা করছি না।
তবে আমরা জানি, লাতিন আমেরিকার সেই পুরো সময়, অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে ১৯৮০-এর দশকের শেষ দিক পর্যন্ত সময়ের ইতিহাস হচ্ছে কলঙ্কের এক ইতিহাস। সব কটি লাতিন দেশেই তখন ছিল ওয়াশিংটনের মদদপুষ্ট হয়ে পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতাসীন হওয়া তাঁবেদার সামরিক সরকার, পুরো অঞ্চলকে যুক্তরাষ্ট্রের বাড়ির পেছনের আঙিনা হিসেবে ধরে রাখার দায়িত্ব পালনে যেসব সরকার ছিল এক পায়ে দণ্ডায়মান। ফলে ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ প্রস্তাবের ওপর নেওয়া ভোটের হিসাবেও সেই বাস্তবতার প্রতিফলন সহজেই ফুটে উঠেছিল এবং পরবর্তী সময়ে মধ্যপ্রাচ্য প্রসঙ্গে সেই সব দেশের অবস্থানও সব সময়ই ছিল মার্কিন অবস্থানের পরিপূরক। কিউবার মতো ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রের ১৯৫০-এর দশকের একেবারে শেষ দিকে সেই বলয় থেকে বের হয়ে আসা এবং চিলিতে আলেন্দে সরকারের খণ্ডকালীন স্বাধীন অস্তিত্ব ঘোষণার প্রয়াস ছিল ব্যতিক্রমী কিছু ঘটনা মাত্র।
তবে ১৯৯০-এর দশকের সূচনালগ্ন থেকে পরিবর্তনের যে হাওয়া লাতিন আমেরিকাজুড়ে বইতে শুরু করে, তার প্রভাবে সেই মহাদেশের প্রায় সব দেশ এখন বলা যায় যুক্তরাষ্ট্রের রাহু থেকে মুক্ত হয়ে বের হয়ে এসেছে এবং এরাই এখন বিশ্ববিবেককে জাগ্রত রাখছে। ফলে গাজা প্রসঙ্গে বিশ্ববিবেক পুরোপুরি নীরব, সেই অভিযোগ করা হলে যেসব বলিষ্ঠ পদক্ষেপ ওই সব দেশ সাম্প্রতিক সময়ে গ্রহণ করে, তার প্রতি অবমাননা করা হবে।
ইসরায়েলকে সতর্ক করে দিতে শুধু বিচ্ছিন্ন একক পদক্ষেপ নিয়েই লাতিন আমেরিকার দেশগুলো বসে নেই, বরং একই সঙ্গে সমষ্টিগত পদক্ষেপও তারা গ্রহণ করছে। দক্ষিণ আমেরিকার রাষ্ট্রসমূহের বাণিজ্যিক জোট মেরকোসুর গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধ তদন্ত করে দেখার আহ্বান জাতিসংঘের প্রতি জানিয়েছে এবং আমরা জানি, সেই আহ্বানে সাড়া দেওয়ার মতো সৎ সাহস জাতিসংঘের বশংবদ মহাসচিবের নেই।
অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অঞ্চলের প্রায় সব কটি দেশ গাজার ঘটনায় বিলম্ব না করে বলিষ্ঠ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট িদলমা রুসেফ যেমন গাজায় ইসরায়েলি অভিযানকে গণহত্যা হিসেবে আখ্যায়িত করে জেরুজালেম থেকে দেশের রাষ্ট্রদূতকে ফিরিয়ে নিয়েছেন। আর্জেন্টিনা, পেরু, চিলি, এল সালভাদরও নিজ নিজ দেশের রাষ্ট্রদূতদের ইসরায়েল থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে এবং চিলির সংসদে গৃহীত এক সিদ্ধান্তে ইসরায়েলের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য আলোচনা স্থগিত রাখার নির্দেশ সরকারকে দেওয়া হয়েছে। বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেস আরও এক ধাপ অগ্রসর হয়ে ইসরায়েলকে সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং ইসরায়েলি নাগরিকদের ভিসা প্রদান নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত দেশটি গ্রহণ করেছে। অন্যদিকে ভেনিজুয়েলা ঘোষণা করেছে যে গাজার ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের দেশটি গ্রহণ করবে। ইকুয়েডরের প্রেসিডেন্ট রাফায়েল কোরেয়াও গাজায় ইসরায়েলি হামলার নিন্দা করে দেশের রাষ্ট্রদূতকে ইসরায়েল থেকে ফিরিয়ে নিয়েছেন।
অন্যদিকে নাগরিক পর্যায়ে ফিলিস্তিনের আক্রান্ত জনতার প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করে মিছিল-শোভাযাত্রার আয়োজন লাতিন আমেরিকার প্রায় সব কটি দেশে অনেকটা নিয়মিতভাবেই করা হচ্ছে। সেই সব দেশের সংবাদমাধ্যমও চুপ করে বসে নেই। গাজার শিশুদের দুর্দশার প্রামাণ্য ছবি টেলিভিশনে নিয়মিতভাবে সম্প্রচারিত হচ্ছে, সংবাদপত্র নিয়োজিত আছে সঠিক সংবাদ জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বে। ব্রাজিলের কার্টুন শিল্পী কার্লোস লুতোফ ইসরায়েলি আগ্রাসনের চেহারা তুলে ধরে বিশ্বের বিভিন্ন পত্রিকার জন্য নিয়মিতভাবে কার্টুন এঁকে চলেছেন অনেক দিন থেকেই। গাজার ঘটনায় এখন তিনি হয়ে উঠেছেন আরও অনেক বেশি সক্রিয়।
অন্যদিকে পশ্চিমের সংবাদমাধ্যমের সবটাই ইচ্ছাকৃত এবং সুচতুরভাবে এড়িয়ে চলছে। তবে তথ্যপ্রবাহে বিপ্লব নিয়ে আসা ইন্টারনেটের এই যুগে সেই নীরবতা পারছে না পুরো সত্যকে ধামাচাপা দিয়ে রাখতে কিংবা এর বিকৃত ছবি তুলে ধরতে। গাজার গণহত্যায় পশ্চিমের নেতৃত্বের পাশাপাশি রহস্যময় নীরবতা পালন করে চলেছে ইসলামি বিশ্বের নেতৃকুলও। ফলে অভিযোগের অঙ্গুলি নির্দেশ করতে হলে সরাসরি সেই সব দিকেই তা নির্দেশিত হওয়া দরকার। নয়তো বিশ্বের জাগ্রত বিবেককে একই কাতারে ফেলে দিয়ে সেই বিবেকবোধের অবমাননাই এর মধ্য দিয়ে হয়তো করা হতে পারে।

টোকিও
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক৷